শহর কলকাতায় এখন মুসলমান সমাজের আধিপত্য আর অতীত দিনের মতো নেই। অথচ, শহর কলকাতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে রয়েছে মুসলমানদের পদচারণা। শহর কলকাতার উত্থানের সঙ্গে তাই মুসলমান ভাবানুষঙ্গ সম্পৃক্ত। কলকাতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মশাল জ্বালানোর ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আজ বিস্মৃতপ্রায়। নওয়াব যুগ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তীতে শহর কলকাতায় মুসলমানদের সেই অনালোকিত ইতিহাস রোমন্থন করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবেত্তা ও সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদ। আজ দ্বিতীয়াংশ।
(গত রবিবারের পর)
শহর কলকাতার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ১৯ শতক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শতাব্দী। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার মন্তব্য করেছেন, পলাশী যুদ্ধের পর বাংলায় আধুনিক যুগের সূচনা হয়। বস্তুত তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় ১৯ শতকে। কেননা আধুনিক ভারতের জনক রামমোহন রায় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বসবাসের নিমিত্তে আগমন করেন এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানচর্চা ও ধর্মালোচনার জন্য ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন। বস্তুত, ১৮০০ থেকে ১৮৫৮-তে মহারানীর ঘোষণা পত্র পর্যন্ত (Queen’s declaration) এক ব্যাপক পরিবর্তনের সময়। পর্যায়ক্রমে সে বিষয়গুলো শুধুমাত্র উল্লেখ করা যাক বিষয়টিকে অনুধাবনের জন্য। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে এটি রূপান্তরিত হয়। উক্ত সালেই স্কুলবুক সোসাইটি এবং ১৮১৮ সালে স্কুল সোসাইটি এবং যথাক্রমে ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জ্ঞানরাশি কলকাতার বাইরেও চর্চিত হতে থাকে। যেমন ১৮৩৬ সনে হুগলি মহসিন কলেজ এবং ১৮৫৩ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পেছনে একটা কারণও ছিল— ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের অধিকৃত কলকাতায় কেরি ও তার সহযোগীদের আশ্রয় দেয়নি। ফলত, তারা দিনেমার অধিকৃত শ্রীরামপুরকেই তাদের কার্যক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়। মনে রাখা দরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদে আধুনিক শিক্ষার জন্য মাত্র এক লাখ টাকা মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু ১৮২৩ সাল পর্যন্ত ইংরাজি শিক্ষার জন্য উক্ত তহবিল থেকে কোনও খরচ করা হয়নি। অর্থাৎ তখনই কলকাতা আধুনিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যথার্থ অংশ নিতে পারেনি। ইতোমধ্যে অবশ্য ডিরোজিও-র নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল এবং ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টায় আধুনিক জীবনের ক্ষেত্রে সাড়া দেওয়ার মানসিকতা (Response to change) তৈরী হচ্ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মহাত্মা রামমোহনের উদ্যোগে এবং লর্ড বেন্টিঙ্কের আইন প্রণয়নের মারফত সতীদাহ প্রথা নিবারণ এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন তৎকালীন বিচারে, এক বৈপ্লবিক বিষয়। এই সময়কালকে নিয়ে বাঙালি বাবু শ্রেণির ঐতিহাসিকবর্গ বেশ শ্লাঘা বোধ করে থাকেন। যদিও এই জাগৃতি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ এবং প্রবাদ প্রতীম ঐতিহাসিক সুশোভন চন্দ্র সরকার সন্দেহ পোষণ করে থাকেন। যদিও বাঙালি বুদ্ধিজীবী বর্গের বৃহৎ অংশের মতো এই সময়কাল হচ্ছে আধুনিক কলকাতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর পেছনে রয়েছে এই মানসিকতা: অন্যবিধ উপাদানগুলিকে অস্বীকার করা, ভিন্নতর জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করা, নিজেদের জাত্যাভিমান প্রমাণ করার জন্য ইতিহাসের যথার্থ সত্যকে ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা, কলকাতা নির্মাণের অন্য প্রাদেশিক জনগণের ভূমিকাকে অস্বীকার করা এবং উপনিবেশবাদী লেখার উপর ভিত্তি করে কলকাতার ইতিহাস চর্চা করা যথার্থ “Rational mind” এর পরিচয়বাহী নয়। কেননা, কলকাতা বহুজাতিক জনশ্রেণীর বাসস্থান এবং কলকাতার ইতিহাস প্রমাণ করে বহুস্বরবাদিতা।
এবারে কৌতূহলোদ্দীপক একটি বিষয়ের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা যাক। সেটি হচ্ছে— কলকাতার সার্বিক অবস্থানে ও উত্থানে ইসলামাশ্রয়ী মুসলমান ভাবানুসঙ্গ। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে দস্তকের অপব্যবহারের কারণে বাংলার নবাবদের সঙ্গে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ঐতিহাসিক বিশেষ প্রেক্ষাপটে তরুণ নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা যোগদান করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ সিরাজ কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কাশিমবাজারের ইংরাজ কুঠিটি দখল করে নিলেন (৪ জুন ১৭৫৬)। ৫জুন, ঠিক পরের দিন কলকাতার অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং ১৬ জুন কলকাতা পৌঁছবার পর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করলেন। তিনদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকার পর গভর্নর ড্রেক (Dreake) সেনাবাহিনীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কলকাতা ছেড়ে ফলতায় পালিয়ে যান। কুড়িজন ফোর্ট উইলিয়ামের ইংরাজ সৈনিকবর্গ আত্মসমর্পণ করে। নবাব সিরাজ কলকাতার নাম পরিবর্তন করে ‘আলিনগর’ নামে চিহ্নিত করার মারফত তাঁর নামে আধিপত্য কায়েম করেন। এরপর নবাব সিরাজ সেনাপতি মানিকচাঁদের উপর কলকাতার ভার ছেড়ে দিয়ে অন্যবিধ সঙ্কট মোকাবিলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মানিকচাঁদ মাদ্রাজের ফোর্ট উইলিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করে রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়ার্টসনের নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী নিয়ে আলিনগর তথা কলকাতা আক্রমণ করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি ক্লাইভ ও ওয়ার্টসনের বাহিনী আলিনগর আক্রমণ করে। এইরূপ পরিস্থিতিতে নবাব সিরাজ তার সুদক্ষ সেন্যবাহিনী নিয়ে আলিনগর থেকে ইংরাজ কোম্পানিকে বহিষ্কার করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। নবাব সিরাজ আলিনগর পৌঁছানোর আগেই ইংরাজ কোম্পানি এই সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন রকম যুদ্ধ না করে নবাবের সঙ্গে উপটৌকন মারফত সর্ম্পক স্বাভাবিক করে নেওয়াটাই বেশি জরুরি। এই উদ্দেশ্যে নবাবকে অভিবাদনের মধ্যে দিয়ে একটি চুক্তি করতে রাজি করে। এই চুক্তি ইতিহাসে ‘আলিনগরের সন্ধি’ (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭) নামে পরিচিত। ইংরাজ কর্তৃপক্ষ নবাব সিরাজের কিছু শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধিটি স্বাক্ষর করে। তৎকালীন কলকাতার নাম আলিনগর যার কিয়দংশ এখন আলিপুর নামে পরিচিত। বস্তুত, মানিকচাঁদের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করে তাকে কারারুদ্ধ করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দিলে খুব সম্ভব আজকেও কলকাতা আলিনগর নামেই পরিচিত হয়ে থাকত। কলকাতার ইতিহাসে এটিই ভাবানুসঙ্গ সম্পর্কিত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রায়ই এক বছর আলিনগর তথা কলকাতা সিরাজের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার সময়ে চিৎপুর অঞ্চলে দুটো সুদৃশ্য ইমামবাড়া নির্মাণ করেছিলেন। এটি তাঁর স্থাপত্য প্রীতি ও ধর্মীয় মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
শহর কলকাতার প্রাথমিক নির্মাণকালে তালতলা অঞ্চল ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। তার কতকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নজির পেশ করা যাক। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস সময়ের দাবি মেনে আজকের হাজী মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারের স্থাপন করেন। Calcutta Madrasah-তে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ইসলাম ধর্ম ও আইন সংক্রান্ত বিষয় পড়ানো হত। আরবি, ফার্সি ও উর্দু ছিল শিক্ষার মাধ্যম। বেশ কিছুকাল পরে ইংরাজিও পড়ানো হত এবং কলকাতা মাদ্রাসায় বহু সময়েই ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল নিযুক্ত থাকতেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে উনিশ শতকের কোনও একসময়ে চিকিৎসশাস্ত্রও পড়ানো শুরু হয়েছিল। সন্নিহিত অঞ্চলে, আজকের পার্ক স্ট্রিটে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত ও এশিয়া মহাদেশ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোনস্। জোনস্ ছিলেন Orientalist বা প্রাচ্যবাদী। কলকাতা মাদ্রাসাতেও প্রাচ্যবাদী শিক্ষাকেই সময়ের প্রয়োজনে গুরুত্ব দেওয়া হত। কেননা ১৯ শতকের আগে কলকাতায় আধুনিক শিক্ষা তখনও প্রবেশ করেনি। তালতলা অঞ্চলের ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেন, গার্ডনার লেন, স্মিথ লেন, কলিন লেন, মার্কেট স্ট্রিট, দেদারবক্স লেন, ইমদাদ আলি লেন, মৌলভি লেন, ওয়ালিউল্লা লেন অঞ্চলে তৎকালীন সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তেমনতর সময়ে মুসলিম জনজীবনের বহু পরিচয় আজও বহন করে চলেছে। যেমন— মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা, ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান এবং বিশ শতকের তিনের দশকের রোকেয়া সাখোয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলগুলিতেই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নয়া উত্থিত বাঙালি হিন্দু সমাজের শিক্ষাদীক্ষার কেন্দ্র যদি আজাদ হিন্দ বাগ (হেঁদুয়া) থেকে কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত হয়, তাহলে ইসলামধর্মী মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার স্থানটি তাহলে ছিল হাজী মুহাম্মদ মহসিন স্কোয়ার।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ মন্তব্য করেছেন যে কলেজ স্কোয়ারের গোলদীঘি থেকে মহসিন স্কোয়ারের গোলদিঘীর দূরত্ব এমন কিছু নয়। কিন্তু চিন্তাভাবনা ছিল বিপরীতমুখী। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে হাজী মুহাম্মদ মহসিনের ১২৫০ বিঘে ওয়াকফ সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ কলকাতাতে রয়েছে। সতীশ মুখার্জি রোড, কালীঘাট, চেতলা, বেহালা অঞ্চলেও অন্যান্য ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের ব্যাপক ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। টালিগঞ্জ ক্লাব ৩০৫ বিঘে, রয়্যাল কলকাতা ক্লাব ৮৫ বিঘে, শ ওয়ালেস (Shaw wallace) বিল্ডিং ৭৮ হাজার বর্গফুট ওয়াকফের সম্পত্তি হিসাবে চিহ্নিত ছিল। এই বিষয়গুলো মুসলিমম ভাবানুসঙ্গের পরিচয় বহন করে।
এবারে কলকাতার দক্ষিণাংশের মেটিয়াব্রুজের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে লখনউ থেকে কলকাতার মেটিয়াব্রুজে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানান্তরিত করে। এই শহরে নবাব ওয়াজেদ প্রায় তিরিশ বছরের উপরে বসবাস করেছিলেন। ধর্ম, সাহিত্য-সংস্কৃতি (তাহজিব তামাদ্দুন) ইত্যবিধ বিষয়ে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা তিনি করেছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে কলকাতা নানদিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি যে সব প্রাসাদ ও ইমারত নির্মাণ করেছিলেন, তার অপব্যবহার হয়। যেমন— জবরদখলকারীদের দ্বারা সেইসব সম্পত্তি, কারখানা, এবং নানাবিধ বৈষয়িক কাজকর্মের মারফত ঘিঞ্জি আবাস এলাকায় পরিণত হয় মেটিয়াব্রুজ।
“তাঁর উত্তরাধিকার বলতে এখন শুধু বিরিয়ানির কথাই মনে পড়ে। রন্ধন বিষয়কে তিনি একটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। আজকের কলকাতায় মোগলাই খানার যে রমরমা তার শুরুয়াত ওয়াজেদ আলি শাহের রসুইখানায়। আজ মেটিয়াব্রুজের গলিঘুঁজিতে নবাবি ছোট লখনউ-এর সংস্কৃতি চিহ্ন, বিশেষত তাঁর প্রিয় কত্থক নৃত্যচর্চা খুঁজতে গেলে, কেমন হবে?” (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪)।
এই সমস্ত বিষয়ের উপর গবেষণা ও আলোচনা না হওয়ার ফলে এমন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার প্রায়ই হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু অত্যন্ত অল্প হলেও কিছু গবেষক তো রয়ে গিয়েছেনই। যেমন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সাংস্কৃতিক এই কর্মকাণ্ডের বিশেষত নৃত্যসংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করেছেন শ্রুতি ঘোষ। ‘মোলাকাত্ মেটিয়াব্রুজ সে’ নামক তথ্যচিত্রে ওয়াজেদ আলি শাহ্-এর সময়কালীন বিশেষ এক সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, যা বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এই অঞ্চলের কাচ্ছি সড়ক রোডের নাম ওয়াজেদ আলি শাহের স্মৃতি বহন করছে। শতরঞ্জ কা খিলাড়ি ওয়াজেদ আলি শাহ্ শের শায়েরির প্রখর ভক্ত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কবির সহযোগে যেমন— ফারসি কবি রুমি, হাফিজ, শেখ সাদি, খৈয়াম এবং মিরের কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করতেন। তিনি নিজেও ফার্সি সাহিত্যের একজন বিখ্যাত গজল রচয়িতাকার অর্থাৎ দক্ষ কবি ছিলেন। এই সমস্ত বিষয়গুলো ইসলাম সংক্রান্ত ভাবধারাকে বহন করে। তাঁর বিশেষ একটি কীর্তির রাজকীয়, ‘সিবতাবাদ ইমামবাড়ার’ মতো বিশাল ধর্মীয় প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্যটি ইন্দোসারাসেনিক (Indo-Saracenic) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করছে।
এবারে দক্ষিণ কলকাতা থেকে মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে আসা যাক। দুনিয়া জোড়া খ্যাতিসম্পন্ন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সন্নিহিত অত্যন্ত অভিজাত, ব্যাপক ভূসম্পত্তিসহ বাগবাগিচা, নানাবিধ ফোয়ারা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে নিয়ে আসা বাঁশের ঝাড়, যথার্থ বলতে কি একটা অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ মুর্শিদাবাদের নবাববর্গের যে প্রাসাদ স্থাপিত হয়ে রয়েছে, তা যেমন ঐত্যিহাসিক তেমনি একটি মর্যাদাপূর্ণ ইমারত, ইন্দো-ইরানিয়ান স্থাপত্যের মর্যাদাপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তুর্কো-আরব ও ইরানি সভ্যতার বিকাশ এই প্রাসাদের অধিবাসীদের মধ্যে বহমান, যা নয়াভাবে উত্থিত হিন্দু সম্প্রদায় থেকে যে বাবু সম্প্রদায়, তারা সেই জীবন পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৯ শতকীর বাবু সম্প্রদায়ের যে অংশ অভিজাত হয়ে উঠেছিল তারা পরিধান করতেন ইরানি টুপি, শেরওয়ানি, আচকান, চুড়িদার এবং জোব্বা বা আলখাল্লা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বোপরি প্রকৃত অর্থে রুচিবান বাঙালি সংস্কৃতির উত্তুঙ্গ ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আলোচ্য পার্ক স্ট্রিটের এশিয়াটিক সোসাইটিতে তৎকালীন হিন্দুস্থানের প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার রসদ আলোচন্য প্রতিষ্ঠানে মিলতে পারে। নবাবি জমানার ইতিহাস রচনা করতে করতে গেলে সিয়ার-উল-মোতাখেরিন ও রিয়াজ-উস-সালাতিন্ অপরিহার্য উপাদান। এই গ্রন্থ দুটির ব্যাপক অংশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত আছে।
পর্তুগালের প্রিন্স হেনরি দ্য (Navygator) নেভিগেটর সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার করতে আগ্রহী ছিলেন। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-দা-গামা কালিকটে এসে পৌঁছান। তাঁকে যে নাবিক কালিকটে নিয়ে এসে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন তার নাম আবদুল মজিদ। তিনি একজন আরবীয় মুসলমান। মনে রাখতে হবে, একদা পুরো ভূমধ্যসাগর আরবিয় মুসলমানরা নিজেদের কব্জায় রেখেছিলেন। সমুদ্রপথে তাদের আধিপত্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। ইউরোপীয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলো যখন সমুদ্রপথে হিন্দুস্থানে পৌঁছাবার পরিকল্পনা করেছে, তখনই আরবীয় মুসলমান নাবিকদের সহযোগিতা নিতেই হয়েছে। এভাবেই ব্যাপক নাবিক এবং নৌযানের অন্যান্য নানা কর্মচারীরা জাহাজপথে কলকাতা এসেও আশ্রয় নেন। বিশেষ করে এই সমস্ত কর্মচারীবর্গ এবং ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিবর্গ খিদিরপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সমুদ্র পথে পাড়ি দেওয়ার প্রশ্নে মুসলমানদের কোনও ছুঁৎমার্গিতা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তেই তাদের যাতায়াত ছিল।
ফলত, গোটা খিদিরপুর অঞ্চলটাই মুসলমানপ্রধান বসতি হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে। স্বভাবতই সেখানে মুসলিম ভাবাদর্শের নানান প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, ধর্মশিক্ষাকেন্দ্র, বিভিন্ন পীর ফকিরদের আস্তানা গড়ে উঠে। ফলত, উক্ত অঞ্চলে উত্তর কলকাতার জীবন পদ্ধতি থেকে ভিন্নধর্মী চিন্তাচর্চার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। স্থানিক নামের মধ্যেও তার কিছু পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন— মোমিনপুর। ‘মোমিন’ অর্থ আল্লাহতে যাদের বিশ্বাস রয়েছে।
প্রসঙ্গটিকে এবার ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে নিয়ে যাওয়া যাক। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের প্রিন্স উইলিয়ামের নামে ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে তাবৎ হিন্দুস্তানের শাসক ছিলেন বাদশাহ ঔরঙ্গজেব। ফলত, ঔরঙ্গজেবের অনুমতিতেই তারা ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণের বিশাল পরিমাণ জমি সংগ্রহ করে। মুঘল-সম্রাটের প্রতিনিধিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এইভাবে সুপারিশ করে যে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর শত্রুতা থেকে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য একটি দুর্গ নির্মাণের দরকার। মুঘল সম্রাটের সঙ্গে কোনও সংঘর্ষের জন্য এটা নয়। ফলত, এই সিদ্ধাস্ত নেওয়া যেতে পারে যে ইসলামধর্মী মুঘল শাসক গোষ্ঠীর সহযোগিতাতেই তারা এই দুর্গ নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল। কলকাতার বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চল ফোর্ট উইলিয়ামের ও আলিপুর থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রেড রোড, ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ, পুরো ময়দান এলাকা ও গভর্নর হাউস অঞ্চলটির সম্পর্কে বেশ কিছু অভিজ্ঞ মানুষ এমন অভিমত পোষণ করেন যে, উল্লেখিত এলাকাগুলো তরুণ নবাব সিরাজের কলকাতা আক্রমণ ও আলিনগর নামে রূপান্তরিত করার সময় মুসলমানদের মালিকানাধীন ছিল। এই বিষয়টি বিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি পাক্ষিক অথবা সাপ্তাহিক পত্রিকায় আলোচিত হয়েছিল। এই ভূসম্পত্তির মালিকানা সর্ম্পকে বলতে গিয়ে জিলা হুগলি অঞ্চলের কোনো এক জমিদার পরিবারের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যদিচ এই জোতজমাদির দলিল দস্তাবেজ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে আপাতত নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যতা ইন্দো-পার্সিয়ান বা ইন্দো-ইরানিয়ান। আলোচ্য অঞ্চলে একমাস প্রিন্সেপ ঘাটই গ্রেকো-স্পার্টার (Greco-sparter) স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য বহন করছে।
আদি কলকাতার উত্তর পশ্চিমাংশ অঞ্চলটি ইতিহাসগতভাবেই বৃটিশ কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের মারফত ধনসম্পদশালী হয়ে ওঠার নব্য সমাজই ওই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে। ১৭২২ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সমগ্র বাংলাকে ২৫টি জমিদারি ও ১৩টি জায়গির দানের বন্দোবস্ত করেন। সেইসময় কলকাতার বাকি অংশে চারজন মুসলিম জমিদার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। ‘বাংলার নবজাগৃতি’ নামক গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ সেই হদিসটি দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে লক্ষ্য করা গেল বৎসরের বিশেষ সময়ে খাজনা পরিশোধ করা (সূর্যাস্ত আইন) এবং ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে মুসলমান জমিদাররা সঠিকভাবে কাগজপত্র সংরক্ষণের সুব্যবস্থা না থাকার কারণে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ইংরাজদের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার ফলে মুসলমান জমিদার, জায়গিরদাররা ধ্বংস হয়ে গেল। কলকাতার ভূসম্পত্তির মালিকানা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় এবং নবউত্থিত হিন্দু শ্রেণি একদা ভূমিহীন, কিন্তু ঘটনাক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে ব্যাপক অর্থশালী হয়ে ওঠার কারণে এই সমস্ত সম্পত্তি খরিদ করে নেয়। ক্রমেই মুসলমানরা কলকাতাতে আধিপত্য হারাতে শুরু করল। কলকাতার ব্যাপক অঞ্চলে পীর ফকিরের আস্তানা ও দরগাহ থাকার সুবাদে দরগাহ রোড হিসাবে চিহ্নিত এলাকা, এন্টালি অঞ্চলে মৌলা আলি দরগা ও মসজিদ, মীর্জাপুর অঞ্চলে জুবিলি হোস্টেল ও মাদ্রাসা, হায়াত খান লেন ও কায়সার স্ট্রিটে ওয়াকফ সম্পত্তি, বু-আলি হোস্টেল ও মসজিদ, ছকু খানসামা লেন, বুধু ওস্তাগর লেন, বৈঠকখানা অঞ্চল, রাজাবাজার, গ্যাস স্ট্রিট এবং মানিকতলায় ওয়াকফ সম্পত্তি, পীরের আস্তানা , মসজিদ মুসলিম সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়ে থাকে। (চলবে...)
অনুলিখন : সাবিনা সৈয়দ
পড়ুন: শহর কলকাতার উত্থান ও মুসলমান ভাবানুষঙ্গ/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct