শহর কলকাতায় এখন মুসলমান সমাজের আধিপত্য আর অতীত দিনের মতো নেই। অথচ, শহর কলকাতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে রয়েছে মুসলমানদের পদচারণা। শহর কলকাতার উত্থানের সঙ্গে তাই মুসলমান ভাবানুষঙ্গ সম্পৃক্ত। কলকাতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মশাল জ্বালানোর ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আজ বিস্মৃতপ্রায়। নওয়াব যুগ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তীতে শহর কলকাতায় মুসলমানদের সেই অনালোকিত ইতিহাস রোমন্থন করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবেত্তা ও সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদ।
১৮ শতকের কলকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানটি, এই ভৌগলিক অঞ্চল বস্তুত খুব স্বাভাবিক অর্থে বসবাসযোগ্য ছিল না। ষোড়শ শতকের পর থেকে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলি হিন্দুস্তানে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আগমন করতে থাকে। যেমন--পোর্তুগীজ, ডাচ্, ওলন্দাজ, দিনেমার, আর্মেনিয়ান, ফরাসী এবং বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। এদের মধ্যে ইংরাজরা সবার শেষে এলেও পরিস্থিতিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তৎকালীন তুর্ক-আফগান শাসনের শেষের দিকের যৎকিঞ্চিৎ সময়পরবর্তীতে অতি শক্তিশালী মুঘল শাসক গোষ্ঠীর সহযোগিতার ফলে অন্যবিধ ইউরোপীয় জাতিগুলিকে দুর্বল করে ফেলে এবং ইংরাজ বণিকগোষ্ঠী পরিস্থিতিগত কারণেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর সবিশেষ কারণ ছিল মুঘল শাসকবর্গ ও তাদের প্রাদেশিক শাসকগোষ্ঠীর সহযোগিতা ইংরাজরাই বস্তুত ভোগ করেছিল।
উন্নত অর্থব্যবস্থার টানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথমে সুবে বাংলার দিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত করতে সচেষ্ট হয় এবং সাফল্যও পায়। ১৭০৭ থেকে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তৎকালীন সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে জিলা মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। এর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ, জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জ, জঙ্গিপুর, ফারাক্কাবাদ, ভগবানগোলা, লালগোলা, আখেরিগঞ্জ, কালিকাপুর এবং বহরমপুর তৎকালীন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক নানান কারণে তৎকালীন বাংলার শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে দস্তক-এর অপব্যবহারের জন্য সর্ম্পক খারাপ হতে থাকে। স্বভাবতই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায় দুশো কিমি দক্ষিণে তাদের আশ্রয়স্থল, ব্যবসাকেন্দ্র এবং ব্যবসাকে সুরক্ষিত করার জন্য চন্দননগর, শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া ইত্যকার স্থানের অন্যবিধ ইউরোপীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর থেকে আরও কিছু দক্ষিণে, কলকাতায় তাদের সামরিক শক্তির কেন্দ্রস্থল গড়ে তোলে এবং যুদ্ধ বা খণ্ডযুদ্ধের সম্ভাবনায় তারা তাদের দূর্গকে সুরক্ষিত করে। সময়ের প্রেক্ষাপটে এমনতর পরিস্থিতিতে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ নির্মাণ করে। বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, বিভিন্ন ইউরোপীয় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলো বঙ্গোপসাগর থেকে ডায়মন্ডহারবারের মধ্যে দিয়ে নদীপথে সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তাদের সংযোগ রাখত। ইংরাজ গোষ্ঠীর কলকাতায় এত রমরমার কারণ হল কেন্দ্রীয় মুঘল শাসক এবং বাংলার তৎকালীন শাসকবর্গের সেই সময়ের পৃষ্ঠপোষকতা। বস্তুত ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফরের নওয়াবিয়ানার জমানায় ২৪ পরগনার খাজনা আদায়ের অধিকারও তারা পায় এবং ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বিনাশুল্কে বাণিজ্যিক ছাড়পত্র, দস্তক পাওয়ার পর তারা অতি শক্তিধর হয়ে ওঠে এবং নওয়াববর্গের বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংগোপনে নানা ষড়যন্ত্রের মারফত ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশি যুদ্ধের নামে একটি খণ্ডযুদ্ধের (skirmish) বা কামান লড়াই নাটকিয়ানার মধ্যে দিয়ে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ফলত এই সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি যে তৎকালীন মুসলমান রাজনৈতিক ক্ষমতার মদতে কলকাতায় ব্রিটিশরা তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পেরেছিল। ইতিহাস সচেতন পাঠকবর্গ অবশ্যই এ বাবদে ওয়াকিফহাল যে, কলকাতার ‘ইন্ডিজেনাস পিপল্’ বা স্থানিক জণগণ সেখানে অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন ও বসবাস করত। এদের সঙ্গে হুগলি, ব্যারাকপুর, শ্রীরামপুর, চন্দননগর, নৈহাটি, কৃষ্ণনগরের লোকজনদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে কোনও মিল ছিল না। তৎকালীন কলকাতা অঞ্চলের লোকেদের আর্থিক অবস্থা এবং জীবনযাত্রা ছিল নিম্নমানের। পলাশিযুদ্ধের পর ইতিহাসের নয়াগতি এবং পরিস্থিতিগত কারণে কলকাতার বিভিন্ন ভূমি অঞ্চল মুর্শিদাবাদের নওয়াববর্গের কাছে থেকে ইংরাজরা কখনও উপঢৌকন, কখনও বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে লিখিতভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকে ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্যতামূলকভাবে জোত-জমাদি হস্তগত করেছিল এবং সেই সমস্ত জায়গায় নাগরিক জীবন যাপনের জন্য নানাবিধ ইমারত, প্রাসাদ, নানান অট্টালিকা নির্মিত হতে থাকে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে আজকের জাতীয় গ্রন্থাগারের বিশাল ইমারতটি বাংলার নওয়াব মিরজাফর গিফট্ হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংসকে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে এই ইমারতটি আলিনগরের (আজকের আলিপুর) বেলভেডিয়ার রোডের ‘সাহেব বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক ছিলেন খান বাহাদুর আসাদুল্লা। অবশ্য সেই বছরই অবসৃত হন। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আলিপুর চিড়িয়াখানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সেইসব অঞ্চল বাংলার নওয়াবদের থেকেই অধিকৃত হয়েছিল।
কলকাতা শহর অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন অর্থাৎ Relatively young city. সুবে বাংলায় ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, শ্রীরামপুর, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর ও ব্যারাকপুর (বারবাকপুর) পুরনো শহর হিসাবে ইতিহাস স্বীকৃত। বিস্ময়কর বিষয় হল এই যে কলকাতা সর্ম্পকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যতিক্রম হিসাবে রাধারমন মিত্রের (১৮৯৭-১৯৯২) ‘কলিকাতা দর্পণ’ একটি বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থ। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে ইউরোপের চার্লস ডিকেন্স ‘কেন্ট’ এবং ‘হায়াম’ নামক দুটো অঞ্চল সর্ম্পকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে স্থানাঞ্চল এবং মানবজীবন সেখানে এক হয়ে গেছে। “A Tale of two cities” তো প্রবাদবাক্য বা মিথের পর্যায়ে পড়ে। আর্থার হেমিংওয়ে-এর জীবনকে কি তাঁর প্রাণের শহর পাম্পালোনা থেকে আলাদা করা যায়? প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে সাধারণভাবে শিবনাথ শাস্ত্রী, অমৃতলাল বসু, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, শ্রীপান্থের লেখা গ্রন্থ এবং ১৯ শতকী বাংলা সাহিত্যের কিছু গ্রন্থের যেমন---হুতুম পেঁচার নকশা, আলালের ঘরে দুলাল, কুলীন কুল সর্বস্ব, সধবার একাদশী, প্যারীচাঁদ মিত্রের নানাবিধ নকশা, টেকচাঁদ ঠাকুরের কলকাতার নানাবিধ দর্পণ থেকে কলকাতার সমাজসংক্রান্ত কিঞ্চিত পরিচয় পাওয়া যায়। প্যারীচাঁদ মিত্রকে জেমস লং, চার্লস ডিকেন্স ও মলিয়ের সাথে তুলনা করেছেন। তবে এঁরা প্রাচ্যবাদী (orientalist) ও ‘ঔপনিবেশিক দালাল’ পর্যায়ের আলোচক। কলকাতার উত্থান সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ হল— Echoes from old Calcutta-(Bastid), Calcutta Gazette Bengal past & present (Ref: The Statesman News Paper) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আগ্রহ উদ্দীপক বিষয় হল এই যে একজন দক্ষিণ ভারতীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চক P. T. Nayar (পি. টি. নায়ার) (1933-2024) কলকাতার উত্থান সম্পর্কে সার্বিক আলোচনা করেছেন। তিনি খেদের সঙ্গে বলতেন— ‘আরে, who knows the history of Calcutta!’ তিনি সম্প্রতি চল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে কলকাতাকে জীবন্ত করে রেখে গেলেন। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল— “A history of Calcutta’s street (1987)”, “James Princep : Life & Work”, “South-Indian’s in calcutta”, “Calcutta’s Tarcentenary Bibliography-1993”.
প্রকৃত অর্থে কলকাতা শহর ১৯ শতকের প্রথম থেকে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিত হতে থাকে। হুগলি নদী বা গঙ্গা নদীর পশ্চিমদিকের জেলাঞ্চল থেকে যত লোক এসেছে, তার থেকে বেশি পরিমাণ লোক এসেছে বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, নওহাটি (আজকের নৈহাটি), তিতুগড় (টিটাগড়), সৈয়দপুর (সোদপুর), বারবাকপুর (ব্যারাকপুর), বসিরহাট, বারাসত এবং অপেক্ষাকৃত দক্ষিণ অংশের ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে। এইসব অঞ্চল থেকে বিস্তর লোকপত্র কলকাতায় নানাবিধ কাজ ও কায়িক পরিশ্রমের জন্য বসতি স্থাপন করে। যারা নয়াবসতি নির্মাণ করতে এল, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক বিচারে তথাকথিত নিম্নবর্গের মুসলমান। এই সমস্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র যে হিন্দুরা এসেছিল তারাও অধিকাংশ থেকে ছিল নিম্নবর্ণের। হালসময় থেকে ষাট বছর আগেও লবণহ্রদ এলাকায় গরিব মৎস্যজীবীরাই বসবাস করত। এই অঞ্চলটি জলাশয়ের মধ্যে পড়ে। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ভূমিভিত্তিক এলাকাগুলোতে কৃষিজীবী মুসলমানরা চাষবাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এই সমস্ত শ্রমজীবী লোকেরা কলকাতার জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। টালা থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত যে অঞ্চলটিকে আধুনিক কলকাতার সীমারেখা বলে ধরা হয়, তার মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলো চারজন মুসলমান জমিদার দেখভাল করতেন। সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ তাঁর গ্রন্থ “বাংলার নবজাগৃতি”-তে এই চারজন মুসলমান জমিদারের তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯ শতকী কলকাতার উত্তরাংশের বরাহনগর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাঙালি মুসলমান জাগরণের অগ্রনায়ক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নওয়াব আবদুল লতিফ। উক্ত অঞ্চলে ব্যাপক ওয়াকফ সম্পত্তি আজও দৃশ্যমান। যদিচ অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো বেদখল হয়ে গেছে। দলিল দস্তাবেজ সাপেক্ষে সেগুলি কিন্তু আজও ওয়াকফ সম্পত্তি। সন্নিহিত আলমবাজার, কামারহাটি অঞ্চল ও একদা মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে পরিচিত ছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে উত্তরাংশের এই আলমবাজার থেকে দক্ষিণে অযোধ্যার নওয়াব ওয়াজেদ আলি শাহের মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত মূল কলকাতার মানিকতলা, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের পীরের আস্তানা, আজকের দিনের খান্না সিনেমার পূর্ব দিকাঞ্চল নারকেলডাঙা, রাজাবাজার, মীর্জাপুর, বৈঠকখানা রোড, মওলা আলি (মৌলালি), এন্টালি, জোড়াগির্জা, পার্কসার্কাস, ৪নং পুল, শামসুল হুদা রোড, সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ, সার্কাস অ্যাভিনিউ, নাসিরুদ্দিন রোড, কড়োয়া রোড, ঝাউতলা রোড (আজকের ফজলুল হক সরণি), পার্ল রোড, মল্লিকবাজার, পুরো পার্ক সার্কাস অঞ্চল, থিয়েটার রোড, ইলিয়ট রোড, ম্যাকলিয়ড স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, আবদুল লতিফ স্ট্রিট, রডন স্ট্রিট (গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান তথা জলপাইগুড়ির নবাবদের বাসকেন্দ্র), পুরো তালতলা অঞ্চল, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড (ওয়েলেসলি স্ট্রিট), ধর্মতলা, জানবাজার, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (মির্জা গালিব স্ট্রিট), জাকারিয়া স্ট্রিট ও কলুটোলা আজকের দিনেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান এলাকা বলে পরিচিত। যদিও এই অঞ্চলগুলোতে কিয়দংশে ইহুদি, পার্সি এবং বিশেষত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জনবসতি উল্লেখযোগ্য হারে ছিল। বৌবাজারের বো-ব্যারাক অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মুসলমান এবং খ্রিস্টধর্মী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। বস্তুত মারাঠাডীচের (মারাঠাখাল) পূর্ব-উত্তরদিকে বেলগাছিয়া থেকে শুরু করে বাগবাজার গ্যালিফ স্ট্রিট, শোভাবাজার, শ্যামবাজার, গিরিশ স্ট্রিট, আপার চিৎপুর রোড, (মহর্ষি দেবেন্দ্র রোড), লোয়ার চিৎপুর রোড (রবীন্দ্র সরণি), রাধাবাজার (লালবাজার), বিডন স্ট্রিট, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট (বিধান সরণি), সিমলা রোড (ঋষি অরবিন্দ সরণী), গ্রে স্ট্রিট, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেনিউ- এই অঞ্চলগুলো মূলত হিন্দু এলাকা হিসাবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে বিদ্বৎ সমাজের একটি বিরাট অংশ এই বিশ্বাস করে থাকেন যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে জব চার্নক ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে সুতানুটি গ্রামে কুঠি স্থাপন করেন এবং সেই সুবাদেই নাকি কলকাতা নগরের পত্তন হয়েছে। কিন্তু একথা মোটেও যথার্থ নয়। তার কারণগুলি নিম্নরূপ:
১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুরের জমিদারি লাভ করে। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজরা হুগলি জেলায় তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তৎকালীন মুঘল শাসকগোষ্ঠী ইংরাজদের বিতাড়িত করে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের আগে মুঘল সম্রাট ফারুক শিয়ারের কাছ থেকে কোনও স্বীকৃতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পায়নি এবং ওই বছরই কোম্পানি তৎকালীন ২৪ পরগণার ৩৮টি গ্রাম কেনার চেষ্টা করলেও নওয়াবের বিরোধিতায় তারা সফল হতে পারেনি। উপরন্তু নওয়াব মুর্শিদকুলি খাঁ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি জন সুরম্যান ও এডওয়ার্ড স্টিফেনসনকে কোনও গুরুত্ব দেয়নি। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের সময়ে কলকাতার পথ অতি দুর্গম, ডাকাতির ভয়, পরিস্থিতি ভীষণই প্রতিকূল ছিল। কারণ সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শাসন এলাকা প্রায়ই ছিল না বললেই চলে। সেইসময়ে যানবাহন বলতে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, নৌকা, পালকি ইত্যাদি ছিল। উপরোক্ত অঞ্চলে ইংরাজ জাতির পক্ষে কোনও মতেই বসবাস সম্ভব হচ্ছিল না। কেননা কেন্দ্রীয় মুঘল শাসকের প্রতিনিধি এবং তৎকালীন বাংলার শাসক ও অভিজাত সমাজের সঙ্গে ইংরাজদের সংঘর্ষ ও মতবিরোধ চলছিল। দেশজ বণিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সর্ম্পকে ছিল খুবই খারাপ। এমনতর পরিস্থিতিতে জব চার্নক কলকাতার শহরের পত্তনকারী জমিদার একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোম্পানির সামান্য মাপের একজন কর্মচারী এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কলকাতা শহরের পত্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটালেন— সেটা যৌক্তিক অর্থে বাস্তবোচিত নয়। তাহলে এই প্রচারটির কারণ কি?
ইসলামধর্মী মুসলমান শাসকদের হুকুমতকে যারা বিষবৎতুল্য মনে করত এবং যারা ব্রিটিশ শাসনকে ‘বিধাতার আশীর্বাদ’ স্বরূপ বিবেচনা করত, তারা এই মতের প্রবক্তা। এমন একটি শহর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জমিদান ও জমি ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক নানান পরিস্থিতিতে এক নগর জীবনের শুরু হল— সেকথা ভাবতে এবং বিশ্বাস করতে বাঙালি জাতিসত্তার জন্য যারা গর্বিত, তাদের পক্ষে কষ্টদায়ক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে ১৭৭৬-এর দিকে টাকশাল স্থানান্তরিত করল। যদিচ সিটি মুর্শিদাবাদের মাত্র ছ কিলোমিটার দক্ষিণে কাশিমবাজার এবং নয়াভাবে উত্থিত বহরমপুরে যে প্রশাসন ক্ষেত্র তৈরি করেছিল–এটি ব্যারাক স্কোয়ার নামে পরিচিত। যেখান থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস প্রাথমিক পর্যায়ে শাসন পরিচালনা করতেন। এমনবিধ সময়ে কোম্পানির চ্যার্টার অ্যাক্ট অনুযায়ী কলকাতাতেই তাদের শাসন কেন্দ্র গড়ে তুলল। কেননা পলাশির যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঐতিহাসিক কারণেই অনেকখানি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল। ইতোমধ্যে লর্ড কর্ণওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মারফৎ একটা নতুন জমিদার শ্রেণি উত্থানের পথ প্রশস্ত করলেন। মুঘল নওয়াবি জমানার অভিজাতবর্গ সিটি মুর্শিদাবাদ ও প্রায়ই দ্বিতীয় রাজধানী হুগলিতে বসবাস করতেন। স্বভাবতই তারা এই নতুন পরিস্থিতিতে স্বস্তিবোধ করছিলেন না। তাদের সকল সম্পত্তি ও বিষয়াদি নিয়ে নিজ নিজ এলাকাতেই বসবাস করতেন। কিন্তু ব্যতিক্রম হল যারা ভাগ্যানুসন্ধানী এমন শ্রেণি যেমন শীল, বসাক, নন্দী, গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক, ক্ষৌরকার এমনবিধ লোকেরা ইংরাজদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য মারফৎ অর্থ উপার্জন করে ধনবান হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে তারা ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে। এইসময় কলকাতায় এইসব ধনাঢ্য বাঙালি হিন্দু সুবর্ণবণিক শ্রেণির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি নাম উল্লেখ করা যায়--- লক্ষ্মীকান্ত বড়াল, দত্তরাম দত্ত, রামমোহন পাল, মথুরামোহন সেন, নৃত্যচরণ সেন, রামসুন্দর পাইন, স্বরূপচাঁদ শীল, জগমোহন শীল, আনন্দমোহন শীল, স্বরূপচাঁদ আঢ্য, কানাইলাল বড়াল, সনাতন শীল, লক্ষীকান্ত ধর, মোতিলাল শীল, রামহরি বিশ্বাস, রামচরণ রায় ও নীলমণি মল্লিক (সূত্র : ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বিনয় ঘোষ এবং দ্য বেঙ্গল ডিরেক্টার অ্যান্ড আল-ম্যানাক— ১৮০৫, ১৮০৬)।
এরা শিক্ষিত হয়ে ওঠার পরে নানাবিধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে শুরু করে। (যেমন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে স্কুলবুক সোসাইটি এবং হিন্দু কলেজ)। আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে এই সব প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাপক অবদান রেখেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এশিয়ায় প্রথম মেডিকাল কলেজ হিসাবে কলকাতা মেডিকাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা যেতে পারে এই ঘটনার মারফত হিন্দুস্তানের পূর্বাংশ আধুনিক হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য, লেনদেন, জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাগ্রহণ, গ্রামীণ বাজার এলাকায় মহাজনী কারবার ও মজুতদার শ্রেণি ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সমাজের এই নয়া উত্থিত শ্রেণি, যারা সমাজে আর্থিক দিয়ে বেশ স্বচ্ছল, তারা ক্রমে কলকাতায় বসবাসে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে এবং এই নয়া শ্রেণি আধুনিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের মারফৎ তারা ‘বাবুসমাজ’ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠে। এরা প্রথম থেকে যথার্থ অভিজাত হিসাবে স্বীকৃত ছিল না। ফলত, কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠায় এরা যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে,---এটা যথাযথভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদিচ তারা তাদের নিজস্ব অট্টালিকা, ইমারতাদি, নিজস্ব ব্যবসাকেন্দ্র, আমদানি-রফতানি কেন্দ্র স্থাপন করে নগরায়ণে অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল।
পুনশ্চঃ বলে রাখা জরুরি ব্রিটিশদের পূর্বেই নানা ইউরোপীয় জাতি তথা পর্তুগীজদের আগমন বাস্তব ঘটনা। শ্রীরামপুর, চন্দননগর, চুঁচুড়াতে তারা স্থায়ীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কলকাতার মুরগিহাটা অঞ্চল এককভাবে পোল্ট্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুরগির ব্যবসার কারণে অঞ্চলটি ‘মুরগিহাট্টা’ নামে আজও পরিচিত। এই বিষয় থেকে প্রমাণিত হয় যে জব চার্নকের আগেও ইউরোপীয় একটি জাতি সেখানে ব্যবসাজনিত কারণে সম্পৃক্ত ছিল। উপরন্ত জব চার্নক সংক্রান্ত কোনও নথি কলকাতা থেকে পাওয়া যায়নি। কলকাতা গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকেন যে মাদ্রাজ ফোর্ট উইলিয়ামে কিছু তথ্য রয়েছে। কিন্তু সেই সমস্ত তথ্য আজও জনসমক্ষে সেভাবে আসেনি। পরিষ্কার উচ্চারণ করা যাক, কলকাতার আদি বসবাসকারীরা ‘উচ্চ অভিজাত’ নয় ভাগ্যান্বেষী, বর্ণবাদীদের চোখে নিম্নশ্রেণীর লোকেরা কলকাতায় বসবাস শুরু করে। এরা প্রাথমিক পর্যায়ের জনগণ। অথচ লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে বাঙালি শিক্ষিত জাতিসত্তার দাপটে কলকাতার আংশিক ইতিহাসকে পূর্ণ ইতিহাস (Total History) বলে চালানো হচ্ছে। (এর পর আগামী সপ্তাহে)
অনুলিখন : সাবিনা সৈয়দ
পড়ুন: শহর কলকাতার উত্থান ও মুসলমান ভাবানুষঙ্গ/২
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct