বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। দশম কিস্তি।
রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
১৯৯০ সালের ২৩/২৪ জুন হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত ধর্ম সম্মেলনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সিদ্ধান্ত করেন যে বাবর-ই্-মসজিদ প্রাঙ্গণে ৩০ অক্টোবর রাম জন্মভূমি নির্মাণের জন্য করসেবা শুরু হবে। মন্দির নির্মাণ ব্যাপারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বিজেপি।
এই পটভূমিতে লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রার পরিকল্পনা। গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যা। আদবানি প্রতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর সোমনাথ মন্দির দর্শন করতে আসতেন। এই দিনটি তাঁর কাছে শুভ। কারণ ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্মদিন।
কিন্তু সোমনাথ মন্দির কেন?
এর একটা কারণ আদবানি তাঁর নিজের আত্মজীবনীতে বলেছেন। এই মন্দির মুসলমান আক্রমণ ও অত্যাচারের প্রতীক, ‘The choice of Somnath as the starting point of the Yatra had a powerful Symbolic value, made evident by repeated references to it as the target of Muslim tyranny against the Hindus. The intention was to contextualise Ayodhya in the historic lineage of Muslim aggression and then to seek legitimacy for Mandir movement by drawing a parallel. The parallel the Sangha Parivar drew was with the reconstruction of the Somnath Temple’ ( My Country My Life) .
সোমনাথ মন্দির থেকে যাত্রা শুরু করার আরও দুটি কারণ সাংবাদিক লীনা মিশ্র উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘Temple Rerun : Tracing Ram Rath Yatra ; 25 years later’ প্রবন্ধে।
প্রথমত, সোমনাথ মন্দির পুননির্মাণের ব্যাপারে নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরোধী অবস্থান। সর্দার বল্লভভাই পটেল স্বাধীনতার পরে এই মন্দির পুনর্নিমাণের কথা ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, যিনি বল্লভভাইএর মতো নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির বিরোধী ছিলেন, পুননির্মিতত মন্দির উদ্বোধন করেন।
দ্বিতীয়ত, সোমনাথ বিধানসভা আসনে মুসলিম ভোট ছিল ২০%, অবশিষ্টের মুখ্য অংশ ছিল ওবিসি ভুক্তদের। এখানকার হিন্দুদের একত্রিত করাও আদবানির উদ্দেশ্য ছিল।
রাম মন্দির নির্মাণকে সামনে রেখে হিন্দু জনমত সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন আদবানি। প্রথমে পদযাত্রার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পায়ে হেঁটে ১০/১২ হাজার মাইল যেতে সময় লাগবে অনেক। বিচক্ষণ প্রমোদ মহাজন বাষ্পচালিত গাড়িকে রথের আকৃতি দেবার প্রস্তাব দেন। বিধায়ক ভরত পাণ্ডে বলেছেন রথযাত্রা শুরু করার আগে বাপুজিনগরের পপাতলাল সোনি আদবানির কপালে দেন রক্ততিলক।
সাংবাদিক আর কে সুধামন সে রথের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন : একটা প্রাচীন যুগের রথের আকৃতিতে তৈরি করা হল একটি টয়োটো ট্রাক। সাজানো হল গেরুয়া রঙ আর রামচন্দ্রের ছবি দিয়ে।তবে তার ভেতরে ছিল আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।ভেতরে ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ। প্রয়োজন হলে আদবানি সেখানে ঢুকে ক্লান্তি অপনোদন করতে পারতেন। সে রথের সামনের দিকটা ছিল খোলা। জনসংযোগের জন্য। রথের সঙ্গে ছিলেন ১০০০ জন করসেবক ও স্বেচ্ছাসেবক। দিনে ৬টি সভা করতেন আদবানি। হিন্দু হার্টল্যাণ্ডের ভিতর দিয়ে দিনে ১২ ঘন্টা চলত রথ মানুষের ধর্মীয় আবেগ জাগ্রত করতে করতে।
রথ অবশ্য পুরোটাই গড়গড়িয়ে চলতে পারে নি। বিহারের সমস্তিপুরে রথকে আটকে দেন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। আদবানিকে ভরে দেন প্রিভেন্টিভ কাস্টডিতে। উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিং যাদবও বাধা দিয়েছিলেন।হিন্দু ভোটের বিভাজনের হিসেব ছিল তাঁদের।
১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর।এদিন মধ্যরাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামস্বামী বেঙ্কটরমন জারি করলেন এক অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স [ Rama Janmabhumi-Babri Masjid ( acquisition of Area ) Ordinance ]।এই অধ্যাদেশের মূল বিষয়গুলি :
১] অবিলম্বে এই অধ্যাদেশ কার্যকর করতে হবে।
২] অধ্যাদেশ বলবৎ হওয়ার পর বাবর-ই-মসজিদ অঞ্চল সংক্রান্ত যাবতীয় স্বত্ত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বর্তাবে।
৩] সংশ্লিষ্ট জমিতে অবস্থিত যাবতীয় ইমারত, ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি অধিগৃহীত জমির অর্ন্তভুক্ত বলে গণ্য করা হবে।
৪] অধ্যাদেশ বলবৎ হওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট জমি নিয়ে আদালত বা ট্রাইবুনালে যদি কোন মামলা বা আপিলের বিচার মুলতবি থাকে তবে তা খারিজ বলে গণ্য করতে হবে।
৫] প্রয়োজনবোধে সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের হাতে স্বত্ত্ব অর্পণ করতে পারবেন।
৬] অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোন্ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা করা যাবে না।
৭] অধিগৃহীত জমি, ইমারত, ঘরবাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি অযোধ্যার কোর্ট রামচন্দ্র গ্রামে অবস্থিত। এর চৌহদ্দি --- উত্তরে হনুমান গঢ়ি ও ডুরাহি কুনওয়া সড়ক, দক্ষিণে খসড়া ১৭২ নং দাগ, পশ্চিমে দাগ নং ১১০৫, ১১০৬ ও ১১১৮ এবং পূর্বে নজুল দাগ নং ৫৭৭ এর সড়ক।
এই অধ্যাদেশকে মুসলিম সমাজ মেনে নিতে পারেন নি। তার কারণগুলি :
১] বলবৎ ল্যাণ্ড অ্যাকুইজিশন আইনকে তোয়াক্কা না করে, নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার খর্ব করে মসজিদ, গোরস্থান ও সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করা সংবিধান বিরোধী।
২] মুলতবি মামলা খারিজ করা হলে সুবিচার পাওয়ার অধিকার থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা হবে।
৩] অধ্যাদেশ বলে বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্য সম্পত্তির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ নয়। ‘প্রয়োজনবোধে বিজ্ঞপ্তি জারি করে অন্য কোন কর্তৃপক্ষের হাতে জমির স্বত্ত্ব অর্পণ করতে পারার’ মূলকথা হল বর্তমান মালিকদের বঞ্চিত করে জমি শ্রীরামমন্দির নির্মাণের জন্য পথ প্রস্তুত করা।
৪] অধ্যাদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গে এলাহবাদ হাইকোর্টে ১৪ অগস্ট ১৯৮৯এর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ বলবৎ থাকে না ; এবং করসেবা ইত্যাদিও বেআইনি থাকে না।
৫] অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপুরণ দেবার কথা বলা হলেও কে ক্ষতিপুরণ দেবে এবং কাকে দেবে, তার কোন উল্লেখ নেই।
৬] এরকম অধ্যাদেশ মেনে নিলে ভবিষ্যতে যে কোন মসজিদ অধিগ্রহণের পথ প্রস্তুত হয়ে যায়।
৭] অধ্যাদেশ বলে সুপ্রিম কোর্টেরও আর রায় দানের ক্ষমতা থাকে না, তাঁরা সরকারকে শুধু পরামর্শ দিতে পারেন। সে পরামর্শ রাষ্ট্রপতি মানতে বাধ্য নন।
মুসলমান সমাজ এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে ৩০ অক্টোবর ভারত বন্ধের ডাক দেন। শেষ পর্যন্ত অধ্যাদেশটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct