বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস।কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। পঞ্চম কিস্তি।
১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর অযোধ্যার নির্মোহী আখড়ার মোহন্ত রামেশ্বর দাস নতুন একটি মামলা দায়ের করেন (Suit No. 26 of 1959)। এই আখড়ার সাধুরা উনিশ শতকে বাবরি মসজিদের পাশে রামমন্দির তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। তখনকার আদালত তাঁদের বিরত করেন। আখড়ার প্রধান ছিলেন ভাস্কর দাস। ইনি ১৯৪৬ সালে ১৮ বছর বয়সে অযোধয়ায় আসেন সংসগকৃত শিখতে। তাঁর মতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বাবরি মসজিদের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে। রামের জন্মস্থানের অধিকার একমাত্র নির্মোহী আখড়ার আছে।
সরকারি ব্যবস্থা ও আদালতের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে এবার মুসলমানরা পথে নামলেন। মন্দির-মসজিদ বিবাদের চতুর্থ মামলাটি ভারতের মুসলিমদের প্রথম ও একমাত্র মামলা ( Suit No. 12 of 1961)। মামলা পেশ করা হয় ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের কেন্দ্রীয় কমিটি ও আরও ৯ জন মুসলিম দায়ের করেন এই মামলা। মামলায় বিবাদীরা হলেন---গোপাল সিং বিশারদ, পরমহংস রামচন্দ্র দাস, নির্মোহী আখড়া, মোহন্ত রঘুনাথ দাস, উত্তরপ্রদেশ সরকার, ফৈজাবাদের কালেক্টর, ফৈজাবাদের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, রিসিভার প্রিয়দত্ত রাম ও অন্যান্য কয়েকজন।
মামলার আর্জিতে প্রার্থনা করা হয়েছে :
ক] ABCD চিহ্নিত ভূমিটিতে অবস্থিত সৌধকে মসজিদ বলে ঘোষণা করা হোক ; সাধারণের কাছে যা বাবার-ই-মসজিদ নামে পরিচিত। EFGH চিহ্নিত ভূমিটি, যা ‘গঞ্জে শাহিদান’ নামে পরিচিত, তাকে মুসলমানদের কবরস্থান বলে ঘোষণা করা হোক।
খ] মসজিদে অবস্থিত হিন্দুদের দেববিগ্রহ ও অন্যান্য পুজোর সামগ্রী অপসারিত করে মসজিদ ও কবরস্থান মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
কিন্তু আদালত কোন সুস্পষ্ট রায় ঘোষণা করলেন না। একের পর এক বিচারক এলেন আর গেলেন, রায় আর বেরোল না। বাবরি মসজিদে রামলালার মূর্তি স্থাপনের কারিগর ছিলেন যাঁরা, সেই কে কে নায়ার ও গুরুদত্ত সিং সরে গেলেন রামজন্মভূমি আন্দোলন থেকে। তবে তাঁরা যোগ দিলেন ভারতীয় জনসংঘে। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রামজন্মভূমি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন যে অক্ষয় ব্রহ্মচারী, অন্য সাধুদের দ্বারা তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হবে তিনি চলে গেলেন লক্ষ্মৌ। অভিরাম দাস ও অন্যান্য সাধুরা অযোধ্যায় রামায়ণপাঠের আয়োজনে মুখর হয়ে উঠলেন।
রামজন্মভূমি আন্দোলনকে আপনাপন স্বার্থে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন সেই ভারতীয় জনতা দলের জন্ম হল ১৯৮০ সালে। ভারতীয় জনসংঘ ছিল তাদের পূর্বসূরী। ১৯৭৭ সালে জনতা দলের সঙ্গে জনসংঘ নির্বাচনে লড়েছিল। সংসদের ৪০৫ টি আসনের মধ্যে জনতা দল পায় ২৯৯ টি আসন, জনসংঘ পায় ৯৩ টি। প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে চৌধুরী চরণ সিং-এর সঙ্গে বিরোধে সরকারের পতন হয়। ১৯৮০এর নির্বাচনে জনতা দল লাভ করে ৩১ টি আসন, জনসংঘ লাভ করে ১৫ টি। জনতা দলের সঙ্গে বিরোধের পরে জনসংঘের সদস্যরা ১৯৮০ সালের ৫-৬ এপ্রিল এক জাতীয় কনভেনশনে মিলিত হয়ে ভারতীয় জনতা দল নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী হন তার সভাপতি।
১৯৮১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলার মীনাক্ষীপুরমের একটি ঘটনায় রক্ষণশীল হিন্দু, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা দল তাদের কর্মসূচি প্রচারের হাতিয়ার লাভ করে। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নিরন্তর অত্যাচারিত হয়ে মীনাক্ষীপুরমের ৪০০ হিন্দু পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে হিন্দু নেতারা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
১৯৮৪ সালে নয়াদিল্লির বিজয়ন ভবনে এক ধর্মসংসদের আহ্বান করেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। সংগঠনের প্রধান মুখপাত্র অশোক সিংহল। প্রচারপত্রে লেখা হল : ভারতভূমি পবিত্র ; এখানকার প্রত্যেক পুরুষ রাম, আর প্রত্যেক নারী দেবী। সেই পবিত্রভূমিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে। তাই হিন্দু ধর্ম আক্রান্ত। তাকে রক্ষা করতে হবে। উদ্ধার করতে হবে রাম জন্মভূমি।
এই ধর্মসংসদ হিন্দু পরিবার ও সমাজের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে দিল ; সরকার যাতে রামমন্দির হিন্দুদের হাতে তুলে দেন সে দাবিও করা হল।
ইন্দিরা গাঁধি মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য করণ সিং বললেন, ‘ হিন্দুধর্ম সঠিক রাস্তায় হাঁটছে না, সঠিক কর্তব্য পালন করছে না , তাই ধর্মান্তরীকরণের ঘটনা ঘটছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনীতিকে হিন্দুধর্মের নীতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, পণপ্রথা দূর করতে হবে, অস্পৃশ্যতা দূর করতে হবে, আমাদের পবিত্র ধর্মস্থানগুলিকে রক্ষা করতে হবে । কি লজ্জার কথা, আমরা এখনও রামের জন্মভূমিতে পবিত্র আলোক জ্বালাতে পারলাম না।’
মাস কয়েক পরে বিহারের সীতামারীতে দেখা গেল এক বিচিত্র শোভাযাত্রা। রাম-জানকী রথযাত্রা। সীতামারী কেন ? মানুষের বিশ্বাস এখানেই সীতার জন্ম। রথ মানে রামায়ণের যুগের রথ নয়, এ যুগের মোটরচালিত রথ। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ভারতীয় জনতা দলের কর্মসূচিতে রথযাত্রা অপরিহার্য। এই শোভাযাত্রায় সামিল হন প্রায় ৫০০০ মানুষ। শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন অশোক সিংহল। ১২ দিন পরে শোভাযাত্রা উপস্থিত হয় অযোধ্যায়। সরযূ নদীর তীরে। সেই পবিত্র নদীর জল হাতে নিয়ে শোভাযাত্রার অংশগ্রহণকারীরা রামজন্মভূমি উদ্ধার করে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করেন।
ভক্তি পরিণত হয় আন্দোলনে, তারপরে রাজনীতিতে।
রথ আবার চলতে শুরু করেছিল। কিন্তু থেমে যেতে হল। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। নিহত হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি।
ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজীব গাঁধি। ১৯৮০ সালে সঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে ইন্দিরার আহ্বানে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। চার বছর বাদেই প্রধানমন্ত্রী। এ যেন ‘ এলাম দেখলাম জয় করলাম’। তিনি ঘটনাচক্রে যেমন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তেমনি ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়লেন মন্দির-মসজিদ বিতর্ক ও হিন্দু-মুসলিম বিবাদে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct