বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস।কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। ষষ্ঠ কিস্তি।
রাজীব গাঁধি আধুনিক মনোভাবাপন্ন ও প্রযুক্তির প্রসারে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু রাজনীতিতে অপরিণত ছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি জড়িয়ে গেলেন রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহাসিক বিবাদে।
শাহবানু নামে এক বিবাহবিচ্ছিন্না নারী তাঁর প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে, দাবি করেছিলেন খোরপোষ। সেই নারীর পক্ষে রায় দিলেন মহামান্য আদালত। প্রধানমন্ত্রী রাজীব স্বাগত জানালেন সেই রায়। তাঁরই নির্দেশে সংসদে আরিফ মহম্মদ খান রায়ের পক্ষে বক্তৃতা করলেন। কিন্তু এই রায় মেনে নিতে পারেন নি মুসলমান ধর্মীয় নেতারা। যাতে এই রায় কার্যকরী না হয় তার জন্য তাঁরা চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর উপর। বিব্রত প্রধানমন্ত্রী তখন সন্ধান করতে থাকেন নতুন আইনের।
আমরা আগেই দেখেছি ১৯৮৪ সাল থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে তাঁরা মথুরার কৃষ্ণ জন্মস্থান বা কংসের কারাগার ( শাহী মসজিদ, ঈদগাহী মসজিদ) ও বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির (গয়ানবাফি মসজিদ) উদ্ধারেরও দাবি জানাতে থাকেন। এর জন্য সমাবেশ, পদযাত্রা, রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। ১৯৮৪ সালের ৭ অক্টোবর গঠিত হয় ‘ শ্রীরাম জন্মভূমি মুক্তিযজ্ঞ সমিতি’। তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন ডি তেওয়ারির মধ্যস্থতায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি এম এল ফোতদারের সঙ্গে মুক্তিযজ্ঞ সমিতির আলোচনা হয় মসজিদটি তাঁদের হাতে তুলে দেবার ব্যাপারে। ইন্দিরা গাঁধির আকস্মিক মৃত্যুর পরে এসব আলোচনা চাপা পড়ে যায়।
১৯৮৫ সালের অক্টোবরের পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরিষদের নেতারা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও ফৈজাবাদের জেলা শাসকের সঙ্গে দেখা করেন। প্রশ্ন ওঠে মসজিদে তালা লাগানোর ব্যাপারে। ফাইল তলব করে দেখা যায় মসজিদের প্রধান ফটকে তালা লাগানোর নির্দেশ কোন আদালত দেয়নি।
১৯৮৫ সালের ১৯ নভেম্বর রাম নবমীর মেলার সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের যে কথা হয় তার ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট ফাইল তলব করে দেখেন যে বাবর-ই-মসজিদের প্রধান দরজায় তালা লাগাবার কোন আইনি নির্দেশ নেই। ১৯৮৬ সালের ২৫ জানুয়ারি তরুণ আইনজীবী উমেশচন্দ্র পাণ্ডে ফৈজাবাদ সদর আদালতে তালা খুলে দেওয়ার আর্জি পেশ করেন। ২৮ জানুয়ারি উমেশচন্দ্র পাণ্ডের আবেদন সম্পর্কে মুন্সেফ আদালতের বিচারপতি জানালেন মূল মামলার (১২/১৯৬১) নথিপত্র তাঁর কাছে না থাকায় তিনি রায় দিতে পারছেন না। হাইকোর্ট থেকে নথিপত্র চেয়ে পাঠানো হল। ৩১ জানুয়ারি রায় না দেবার বিরুদ্ধে ফৈজাবাদের জেলা জজের আদালতে উমেশচন্দ্র আপিল করেন। ১৯৮৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি। জেলা জজ কোন নোটিশ না দেওয়ায় এবং কোন শুনানি না করায় ১৯৫০ সালের ২ নম্বর মামলার বিবাদী মহম্মদ ফারুক ও ১৯৬১ সালের ১২ নম্বর মামলার বাদী মহম্মদ হাসিম আপিলের বিরোধিতায় অংশগ্রহণের আবেদন জানান। তাঁদের আবেদন খারিজ হবে যায়।
এরপর জেলা জজ কৃষ্ণমোহন পাণ্ডে জেলাশাসক ইন্দ্রকুমার পাণ্ডে ও পুলিশ সুপার করমবীর সিংকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। জেলা জজ জেলাশাসককে প্রশ্ন করলেন, ‘মন্দিরে ( বলা উচিত ছিল মসজিদে) তালা লাগানো ছিল ? কে তালা লাগালেন ?’
-‘তৎকালীন জেলাধিকারী।’
-‘কিন্তু আদালত তো তালা লাগাবার নির্দেশ কখনও দেয় নি। তেমন রেকর্ড তো আমি দেখছি না কোথাও।’
-‘ধর্মাবতার, আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে জেলাধিকারী নিজের গরজে তালা লাগিয়েছিলেন।’
-‘ আপনি কি মনে করেন এই একটি তালার উপর জেলার শান্তি-শৃঙ্খলা নির্ভর করছে ?’
-‘ না ধর্মাবতার।’
এরপরে জেলা জজ জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার দুজনকেই প্রশ্ন করলেন, ‘তালা খুলে দিলে আপনারা অবস্থা সামাল দিতে পারবেন তো ?’
তাঁরা সম্মতি জানালেন।
অতঃপর জেলাশাসক নির্দেশ দিলেন : ‘কোন আদালতের নির্দেশে যখন রাম জন্মভূমিতে (!) তালা দেওয়া হয় নি, তালাবিহীন অবস্থায় যখন জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম, এবং তালাবদ্ধ অবস্থা বাদী ও ওই সমাজের মানুষের পক্ষে অএতুক বিরক্তির, তাই এটা পরিষ্কার যে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আর তালা ঝুলিয়ে রাখার দরকার নেই। [‘ is clear that it is not necessary to keep the locks at the gates for the purpose of maintaining law and order or the safety of the idols . This appears to be an unnecessary irritant to the applicant and other members of the community .’ ]
প্রাজ্ঞ বিচারক আরও বলে দিলেন : ‘ যদি তালা খুলে দিয়ে ভেতরের মূর্তিকে তীর্থযাত্রী এবং পূজার্থীদের পূজার অনুমতি দেওয়া হয়, তাতে মুসলিমদের কোন ক্ষতি হবে না। আর এতে তো বিতর্ক নেই যে বর্তমানে জায়গাটা বিচারালয়ের হেফাজতে এবং বিচারালয়ের ১৯৫০ ও ১৯৫১-এর নির্দেশে গত ৩৫ বছর ধরে হিন্দুরা অবাধে গলিপথ দিয়ে প্রবেশ করে পূজাপাঠ করে আসছেন। এখন তালা খুলে দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। জেলাশাসক আজকেও আমাকে জানিয়েছেন যে মুসলিমদের সেখানে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না।’ [ ‘After having heard the parties it is clear that the members of the other community , namely the Muslims, are not going to be affected by any stretch of imagination if the locks of the gates were opened and the idols inside the premises are allowed to be seen and worshiped by pilgrims and devotees.
‘ It is undisputed that the premises are presently at the court’s possession and that for the last 35 years Hindus have had an unrestricted right of worship as a result of the court’s order of 1950 and 1951 . If the Hindus are offering prayers and worshipping the idols, though in a restricted way for the last 35 years, then the heavens are not going to fall if the locks of the gates are removed . The district magistrate has stated before me that the members of the Muslim community are not allowed to offer any prayer at the disputed site. They are not allowed to go there. ‘ ]
উমেশচন্দ্র পাণ্ডের আবেদন ও জেলা জজের নির্দেশ উঃসাহিত করল প্রধানমন্ত্রীকে। এ ব্যাপারে দেখভালের দায়িত্ব তিনি দিলেন অরুণ নেহেরুকে। নীরজা চৌধুরী স্টেটসম্যান পত্রিকায় ১৯৮৬ সালের ২০ এপ্রিল লিখেছিলেন, ‘ Rajib Gandhi had indicated in no uncertain terms that the gates must open to the devotees’ .
১৯৮৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি।
বিচারকের রায় দানের ৩০ মিনিটের মধ্যে এক সিনিয়র পুলিশ অফিসর বাবরি মসজিদের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে দিলেন। সমস্ত ঘটনা সম্প্রচারিত হল দূরদর্শনে। জানানো হল প্রধানমন্ত্রীকে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হিন্দু ভক্তরা। তাঁদের বহুদিনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। আর উমেশচন্দ্র পাণ্ডে ? সীমা নেই তাঁর আনন্দের।
তিনি এক অলৌকিক ঘটনা বিবৃত করলেন। তিনি জানালেন তাঁর আবেদন নিয়ে আদালতে যখন আলোচনা চলছে, তখন আদালতের ছাদে এসে বসেছিল এক হনুমান। হনুমান রামের পরম ভক্ত ও বন্ধু। বিচারকের রায় দানের পরে সেই হনুমান নাকি ছাদে যে ভারতের জাতীয় পতাকা ছিল, তাকে স্পর্শ করে। এর পর থেকে এরকম অলৌকিকতার মুখোমুখি আমাদের প্রায়ই হতে হবে।
তালা ভাঙার দুদিন পরে ৩ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন মুসলমান আইনজীবী লক্ষ্মৌ হাইকোর্টে নিরাপত্তার আবেদন জানান। তাঁদের এই ভয় হয়েছিল যে পরবর্তী পদক্ষেপে হয়তো বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার আয়োজন হবে। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হাঙ্গামা লেগে যাবে। মহম্মদ হাসিমের রিট আবেদনের (No. 3106 of 1986 ) ফলে জাস্টিস ব্রিজেস কুমার আদেশ দিলেন, ‘ পরবর্তী রায় না দেওয়া পর্যন্ত সম্পত্তির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে।’
১৯৮৬ সালের ১২ মে জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ড আফ ওয়াকফ আর একটি রিট আবেদন করেন। মুসলমানদের পক্ষে আসরে নামেন জাফরাব জিলানি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। গড়ে তুললেন বাবরি মসজিদ অ্যাকসন কমিটি। মিছিল ও ধর্মঘটের ডাক দিলেন। ৭ ফেব্রয়ারি তিনি ৮ জুন সহযোগী নিয়ে দেখা করলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিংএর সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নাকি জানিয়েছিলেন উচ্চতর নেতাদের কাছ থেকে তালা ভাঙার নির্দেশ এসেছিল।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct