বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। সপ্তম কিস্তি।
রাজীব গাঁধি বাস্তবিকই ‘ইতিহাসের অচেতন হাতিয়ার’। তিনি অচেতনভাবে বিজেপির উত্থানে সাহায্য করেছেন। শুধু বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া নয়, তিনি দূরদর্শনে রামায়ণ সিরিয়ালের অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সিরিয়ালের প্রভাব দিগন্তবিস্তারী। আমরা পৃথক অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোচনা করব। তার আগে রাজীবের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন দেখে নেওয়া যাক।
সঞ্জয় গাঁধির মৃত্যুর পরে রাজীবকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন ইন্দিরা। রাজনীতিতে তাঁর শিক্ষানবিশীর নজির নেই। তাঁকে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি চারদিনের রাজনৈতিক সফরে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে এখানেই ৩১ অগস্ট তিনি ইন্দিরা গাঁধির মৃত্যুর খবর পান। বিশেষ বিমানে তিনি চলে যান দিল্লি। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রপতি জৈল সিং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করান। কেন এরকম অনভিজ্ঞকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হচ্ছে, কংগ্রেসে সেরকম প্রশ্ন কেউ তুলেছিলেন কি না আমরা জানি না।
সপ্তম লোকসভার মেয়াদ শেষ হবার কথা ১৯৮৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ইন্দিরার মৃত্যুর (৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪) কারণে লোকসভার নির্বাচন এগিয়ে আনা হয়। ঠিক হয় নির্বাচন হবে ১৯৮৪ সালের ২৪ থেকে ২৮ ডিসেম্বর। লোকসভার নির্বাচন এগিয়ে আনার পেছনে কংগ্রেসের একটা অভীপ্সা ছিল। ইন্দিরার মৃত্যুর ফলে সহানুভূতির ঢেউকে তাঁরা কাজে লাগাতে চাইছিলেন। ইন্দিরার মৃতদেহ দূরদর্শনে লাগাতার দেখিয়ে যাওয়া হয়, দেখানো হয় মৃতদেহের পাশে রাজীবের দণ্ডায়মান ছবি, শোকযাত্রার ছবি, শেষকৃত্যের ছবি।
অষ্টম লোকসভা নির্বাচনে লোকসভার ৫৪২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে ৪১৫টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৮.১ শতাংশ ভোট। স্বাধীনতার পরে, এমন কি নেহেরু বা ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস এত আসন ও এত ভোট পায়নি।
এই নির্বাচনে জনতা দল ২১৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১০টি আসনে, বিজেপি ২২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২টি আসনে, লোকদল ১৭৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৩টি আসনে জিতেছিল। সিপিএম পেয়েছিল ২২টি আসন, সিপিআই ৬টি আসন, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি আসন ও আর এস পি ৩টি আসনে জিতেছিল। বিজেপি ৭.৪ শতাংশ, লোকদল ৬.৭ শতাংশ, জনতা দল ৫.৬ শতাংশ ও সিপিএম ৫.৭ শতাংশ ভোট পায়।
নির্বাচনী প্রচারেও অচেতন ভুল করেছিলেন রাজীব। তিনি অযোধ্যার ফৈজাবাদ থেকে শুরু করেন তাঁর নির্বাচনী প্রচার। অযোধ্যা কেন? সেই হিন্দু ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দেওয়া। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কংগ্রেসও করে এসেছে। শশী থারুর বক্তব্য তার প্রমাণ। তিনি লিখেছেন : ‘ Hindutva has become a credible political movement precisely because of the nature of the strategy pursued by the Indian states since Independence in relation to its religious communities .’ অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে ভারত সরকার ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি সম্বন্ধে যে নীতি অনুসরণ করে এসেছে, তার মধ্যেই হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল। শশী থারুর লিখছেন, ‘ Nehru’s ostensibly secular Indian state granted major concessions to its minority religions, organised not just as religions but as social communities.’ নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারতরাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু পূজা, বিবাহ, উত্তরাধিকার, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে পারসোনাল ল-এর প্রয়োগের ব্যাপার ধর্মীয় নেতাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, অথচ হিন্দু কোড বিল ছিল তার বৈপরীত্যে। -‘ Personal Law, on matters concerning worship, marriage, inheritance and divorce was left to the religious leaders to each community to maintain and interpret ; the state passed no law to alter or abridge Muslim personal law , even though Parliament, through the Hindu Code Bill,
Radically transformed Hindu society in these areas as early as 1956 .’ [ Nehru’s The Invention of India]
রাজীবের পুত্র রাহুল গাঁধীও নরম হিন্দুত্বের পথ অনুসরণ করেছেন। গুজরাটের নির্বাচনী প্রচারে তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে জোর গলায় কিছু বলতে পারেন নি। বরং নিজেকে শিবভক্ত ও পৈতেধারী ব্রাহ্মণ প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আসলে কংগ্রেস দল বামদলগুলির মতো অবিমিশ্র ধর্মনিরপেক্ষতায় কখনও বিশ্বাস করেন নি। বিজেপির মতো উগ্র হিন্দুত্বের পথে তাঁরা হাঁটেন নি, কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরে হিন্দুত্বের একটা চোরা স্রোত প্রবহমান ছিল। গণপরিষদের বিশিষ্ট সদস্য অধ্যাপক কে টি শাহকে বহু লড়াই করতে হয়েছে সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। গণপরিষদের অনেকেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার পক্ষপাতী ছিলেন।
গণপরিষদের সদস্য ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্টনি গভীর বেদনার সঙ্গে সভায় বলেছিলেন :
‘ অধ্যক্ষ মহোদয়, আমি কারোকে কোনভাবে আঘাত করতে চাই না। কিন্তু তাও আমাকে বলতে হচ্ছে যে এই মহান পার্টির সদস্যরা, যাঁরা বিধিমতে কংগ্রেসের সদস্য, তাঁরাও অনেকেই তাঁদের বোধ-বিশ্বাসের দিক থেকে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার সদস্য। আমার দুর্ভাগ্য যে প্রতিদিন আমার কংগ্রেস পার্টির প্রভাবশালী ও মান্যবর নেতাদের সেইসব বক্তৃতা পড়তে হয় যাতে তাঁরা বলেছেন যে ভারতের স্বাধীনতা মানেই হিন্দুরাজ্যের প্রতিষ্ঠা, ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে কেবল হিন্দু সংস্কৃতিই বুঝতে হবে। ’ [ ভোটের প্রচারে রাহুলের রামমন্দির যাত্রা কংগ্রেসের ইতিহাসের সঙ্গে মানানসই/ অলোক ভট্টাচার্য/ আজকাল, ০১. ০৩ ২০১৮]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct