বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। একাদশ কিস্তি।
১৯৮৯ সালে নবম লোকসভা নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পায় ১৯৫টি আসন। ইন্দিরা গাঁধী নিহত হবার পর মানুষের যে বিপুল ভাবাবেগ কংগ্রেসকে বিপুলভাবে জয়ী করেছিল, সে ভাবাবেগ আর ছিল না। অপরিণত রাজীব গাঁধীর কার্যকলাপ, বোফর্স কেলেঙ্কারি ইত্যাদির ফলে তাঁর ও কংগ্রেসের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়। নবম লোকসভা নির্বাচনে রাজীবের কংগ্রেস লাভ করে মাত্র ১৯৫টি আসন। সরকার গড়ার চেষ্টা না করে রাজীব বিরোধী আসনে বসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনে জনতা দল লাভ করে ১৪২টি আসন। শক্তিবৃদ্ধি করে বিজেপি দল। তাঁদের আসন সংখ্যা হয় ৮৯টি। বামদলগুলির আসন সংখ্যা এইরকম : সিপিএম-৩৪, সিপিআই-১২, ফরওয়ার্ড ব্লক-৩, আরএসপি-৪। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংএর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্রন্টকে বাইরের থেকে সমর্থন করেন বিজেপি ও বামেরা।
বিশ্বনাথপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেবীলালের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু কলঙ্কিত কংগ্রেসের বিপরীতে স্বচ্ছভাবমূর্তির প্রতীক হিসেবে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংকেই প্রধানমন্ত্রী করা হয়।১৯৮৯ সালের ২ নভেম্বর তিনি শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর সরকার অনেকগুলি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল :
১] সংবিধানে বর্ণিত আন্তঃরাজ্য পরিষদের পুনরুজ্জীবন,
২] কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উন্নতি,
৩] ৫৯-তম সংবিধান সংশোধনী আইন বাতিল করা,
৪] দেশব্যাপী পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ,
৫] গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলির পুনরুজ্জীবন,
৬] পঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর প্রভৃতির সমস্যা বিষয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে অগ্রসর হবার চেষ্টা।
আর একটি ‘নীরব বিপ্লব’ বিশ্বনাথপ্রতাপ করেছিলেন। তা হল মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে কার্যকর করা। কিন্তু এর পেছনে রাজনৈতিক ভাবনা ছিল। নিউজিল্যাণ্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটনের ইতিহাসের শিক্ষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘ মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনেকদিন টেবিলে পড়েছিল। ভিপি রাজনৈতিক কারণে এটা খুঁজে বের করলেন এবং গ্রহণ করলেন বিজেপির অগ্রগতিকে রোধ করার জন্য ; যাতে হিন্দু সমাজের বিভাজনকে উস্কে দেওয়া যায়। কিন্তু এর সপক্ষে কোন জনমত তৈরি করা হল না। শুধু রাজনীতি করার জন্য একে বলবৎ করা হল।’
মণ্ডল কমিশনের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি ছিল বিজেপির। তাই এই কমিশন বিজেপির প্রতিবিপ্লবের সুযোগ করে দিল, ‘This silent revolution brought on a counter-revolution, a revenge of the elite whose vanguard has been the BJP . The BJP’s Hindu nationalism had the advantage of transcending caste identities in the name of Hindu unity and its fight against the threat from Islam .’ ( Mondal Moment, 30 years on / Christophe Jaffrlot )
কংগ্রেসের বিরোধিতায়, বিজেপির কলকাঠিতে, চন্দ্রশেখরের বিশ্বাসঘাতকতায় ভিপি সরকারে পতন ঘটল। ১৯৯০ সালের ৭ নভেম্বর বিশ্বনাথপ্রতাপ ইস্তফা দিলেন। চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে দলছুট সাংসদদের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করলেন এক সংখ্যালঘু সরকার। ১০ নভেম্বর চন্দ্রশেখর হলেন প্রধানমন্ত্রী। এই বিশ্বাসঘাতকও শাস্তি পেলেন হাতে হাতে। মাত্র চার মাস পরে রাজীব গাঁধী তাঁর বাড়িতে গোয়েন্দগিরির অভিযোগ তুলে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেন। ১৯৯১ সালের ৬ মার্চ ইস্তফা দিতে হল চন্দ্রশেখরকে। এরপরে রাজীবের নেতৃত্বে কংগ্রেস কিছু সাংসদ কেনা-বেচা করে সরকার গড়ার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি।
১৯৯১ সালের মে মাসে হল দশম লোকসভা নির্বাচন। তিন দফায়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেস, বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় মোর্চা এবং বামদল। এই নির্বাচনকে অনেকে ‘মণ্ডল-মন্দির নির্বাচন’ বলে মনে করেন। প্রথম দফা নির্বাচনের পরেই ২১ মে ঘটে গেল এক বিপর্যয়।
রাজীব গাঁধী চেন্নাই শহর থেকে ৩০ মাইল দূরবর্তী শ্রীপেরামবুদুরে গিয়েছিলেন সেই লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী শ্রীমতী মারাগতাম চন্দ্রশেখরের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে। এখানেই এল টি টি ই জঙ্গী তেনমোঝি রাজারত্নমের আত্মঘাতী বোমার হামলায় রাজীব ও ১৪ জন নিহত হন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা নির্বাচনে রাজীব হত্যার ফলে সহানুভূতির ঢেউ কংগ্রেসের দিকে যায়, তথাপি কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি।
নির্বাচনের ফলাফল এরকম : কংগ্রেস-২৫২, বিজেপি-১২১, জনতা দল-৬৩, সিপিএম-৩৬, সিপিআই-১৪, এআইডিএমকে- ১২, জেএমএম-৭, টিডিপি-৭, টিডিপি(ভি)-৬, আরএসপি-৫, জনতা পার্টি-৪, শিবসেনা-৪, বিএনপি-৩, এমএম-৩, ফরওয়ার্ড ব্লক-৩, আইইউএমএল-২, এআইএফবি-১।
নির্বাচনে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি বিশেষ লক্ষ্যণীয়। কংগ্রেস পায় ৩৬.২৬%, জনতা দল পায় ১১.৮৪% ও বিজেপি পায় ২০.১১% ভোট। দেখা যায় ভারতের ১২টি রাজ্যে বিজেপির বিস্তার ঘটেছে। এইসব রাজ্যে বিজেপির আসন তালিকা এরকম : অন্ধ্রপ্রদেশ-১, অসম-২, দমন-দিউ-১, বিহার-৫, গুজরাট-২০, হিমাচল প্রদেশ-২, কর্নাটক-৪, মধ্যপ্রদেশ-১২, মহারাষ্ট্র-৫, দিল্লি-৫, রাজস্থান-১২, উত্তরপ্রদেশ-৫১।
নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পেলেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের বাধা ছিল না। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন পি ভি নরসিমা রাও। ১৯৯১ সালের ২১ জুন। নরসিমা রাজনীতি থেকে প্রায় অবসর নিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীও ছিলেন না। ঘটনাচক্রে তিনি যেমন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তেমনি ঘটনাচক্রে হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
নরসিমা রাও সরকারের নীতি ব্যাখ্যা করে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ পি ভি নরসিমা রাওএর নতুন সরকার তার অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংএর হাত দিয়ে যে নয়া অর্থনীতি হাজির করলেন, তা বলা যেতে পারে নতুন সরকারের প্রথম জনবিরোধী সিদ্ধান্ত। রাজীব গাঁধীর আমলের উদারনীতিবাদ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির গোড়ায় আঘাত করেছিল। এখন অর্থনীতির বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে আস্তে আস্তে তুলে দেওয়া, বিদেশি পুঁজির নাম করে দেশের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য এবং আমাদের একচেটিয়া পুঁজি যাতে বাড়ে তার জন্য সমস্ত বাধা-নিষেধ তুলে দেবার জন্য চাপ আসছিল। নয়া অর্থনীতি সেই চাপেরই ফসল। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে আরও ঋণ পাবার জন্য তাদের শর্ত মানতে গিয়ে আমাদের দেশ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে এবং দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে নরসিমা রাও সরকারের গৃহীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলি দেশের বুকে এক নয়া সর্বনাশ হাজির করল। অথচ এর বিকল্প ব্যবস্থা ছিল।
‘আমাদের পার্টি এবং অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির পক্ষ থেকে একটা সুসংবদ্ধ বিকল্প নীতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলাম। অনেক আলোচনার পরই এই বিকল্প নীতি তৈরি হয়। শেষ আলোচনা হয় ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে। বামপন্থী দলগুলির ডাকে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবিতে কনভেনশন হয়। ওই মাসেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে বিকল্প নীতি নিয়ে আমরা একটা দলিল প্রকাশ করি। বিকল্প প্রস্তাবে আমরা বলেছিলাম যে, কালো টাকাকে ধরুন, যেসব বড় বড় পুঁজিপতি গোষ্ঠীর বিশাল সম্পদ আছে তাকে সম্পদ করের মধ্যে ধরুন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো আর অপ্রয়োজনীয় খরচ কমালেই রাজস্ব ও আর্থিক ঘাটতি কমবে। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পরোক্ষ কর এবং যখন-তখন ফতোয়া দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে রাজস্ব সংগ্রহের চাহিদাও কমবে।
‘আমরা বলেছিলাম, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তুলে দিলে চলবে না, ওসব বড়লোকেদের জিনিস কেনার জন্য বিদেশ থেকে যথেচ্ছ আমদানি বন্ধ করতে হবে। ১৪টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসকে সরকারি বণ্টনব্যবস্থার মাধ্যমে এমনভাবে বণ্টন করতে হবে যাতে
সাধারণ মানুষ উপকৃত হন। এ দেশের বিশাল অংশ গরিব, তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে না পারলে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। কিন্তু ওঁরা এসব শুনলেন না, আমাদের বিকল্প নীতিতে কান দিলেন না। ওঁদের লক্ষ্য যে জনসাধারণের উন্নতি নয়, বরং মুষ্টিমেয় বড়লোক ও বুর্জোয়া শিল্পপতিদের তোষণ করা, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হল। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে বিপদ হাজির হল সেটা হচ্ছে, আই এম এফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া।’ (যতদূর মনে পড়ে, পৃঃ ৩৯০-৯১)
১৯৯১ সালের ১৮ জুলাই জাতীয় সংহতি পরিষদের দ্বিতীয় সভায় অযোধ্যার রাম মন্দির নিয়ে বিজেপির একরোখা ইচ্ছা প্রকাশ পায়। সেটা অস্বাভাবিক ছিল না। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি শক্তি লাভ করেছে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে লাভ করেছে ক্ষমতা। পুঁজিপতি, ধনী, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, প্রতিরক্ষা বিভাগের অফিসারদের সমর্থন তাদের দিকে। এইসব কিছুকে প্রতিহত করার জন্য যে দৃঢ়তা প্রয়োজন ছিল, তা নরসিমা সরকারের ছিল না। ১৯৯১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সংসদে জয়নাল আবেদিন একটি বিল আনেন। সেটি অনুমোদিত হয়ে আইনে পরিণত হয়। ‘ধর্মস্থানে স্থিতাবস্থা বিলের’ উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের নামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চক্রান্তকে প্রতিহত করা। কিন্তু সরকার সে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারলেন না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct