আবু জাফর: হ্যারিকেন গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীকগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। শৈশব জীবনে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের আলোর চাহিদা মিটানো বা অন্ধকার দূর কারার একমাত্র অবলম্বন ছিল হ্যারিকেন বা কুপিবাতির আলো। সেই হ্যারিকেন আজ বিলুপ্তির পথে।
বাঙালির জীবনে রাতের অন্ধকার দূর করতে এক সময় দেশের গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা ছিল হ্যারিকেন, কুপি ও হ্যাজাক বাতি। যার অন্যতম জ্বালানি উপাদান ছিল কেরোসিন। তখনকার সময় এসব জ্বালিয়ে গ্রামাঞ্চলে রাতে বিয়ে-সাদি যাত্রাগান, মঞ্চ নাটক, ওয়াজ মাহফিল প্রভৃতি অনুষ্ঠান করা হতো। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির উঠানে কিংবা ঘরের বারান্দায় ভাই-বোন একসাথে পড়াশোনা করত। হ্যারিকেনের জ্বালানি উপাদান কেরোসিন আনার জন্য কাচের বোতল ছিল। যা রশি দিয়ে বেধে রান্না ঘরের কোন স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সন্ধ্যার আগেই হ্যারিকেনের কাছ মুছে তেল ভরে জ্বালানো হতো।
হ্যারিকেন হল টিনের তৈরি দুটো খুঁটি, কাচের চিমনি বিশিষ্ট প্রদীপ। আনারসের মত দেখতে কাচের চিমনির নীচের অংশ টিনের তৈরি তেলের ট্যাংক থাকত। যেখানে কেরোসিন তেল ঢালা হতো। মাঝখানে থাকতো ফিতে, গ্রাম বাংলায় বলা হতো পলতে বা শৈলতে। যার এক চতুর্থাংশ ট্যাংকের তেলে মধ্যে চুবানো থাকতো। আর বাকি অংশ থাকতো উপরে কাচের মধ্যে। দিয়াশলাই কিংবা আগুন দিয়ে জ্বাললেই জ্বলেই আলো ছড়াত। ট্যাংকারের পাশে থাকা রেগুলেটর দিয়ে আলো বাড়ানো কমানো হতো।
গ্রামের ইতিহাসে অন্ধকার রাতে হ্যারিকেনের মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে পথ চলার স্মৃতি কার না মনে পড়ে। এপাড়া থেকে ওপাড়া যেতে. হাটে বাজারে, পথ চলায় কিংবা তৎকালে প্রাণের স্বামী হাট-বাজার থেকে ফিরতে রাত হলে স্ত্রী হ্যারিকেন হতে পথ পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
চলচ্চিত্রের প্রথম আমলের ছবিগুলোর দিকে এক নজর তাকালে বোঝা যায় যেখানে সিনেমার নায়িকা তার ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজতে অন্ধকার রাতে হ্যারিকেন নিয়ে বের হতো।
দেশ পরিচালনার দায়িত্বে উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন কিংবা আছেন যারা তাদের অনেকেই এই হ্যারিকেন কিংবা কুপির মৃদু আলোর সাহায্যে লেখা পড়া করেছেন। ব্যবসা ও গৃহস্থালির কাজেও হ্যারিকেনের ব্যাপক চাহিদা ছিল। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ‘ডাক হরকরা’ গল্পের নায়ক তার এক হাতে হ্যারিকেন আর অন্য হাতে বল্লভ নিয়ে রাতের আধারে ছুটে চলে তার কর্ম পালনে। একসময় ডাক পিয়নরা চিঠির বোঝা পিঠে করে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছুটে চলতো।
সমাজ পরিবর্তন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী হ্যারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে। বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও সৌর বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে হ্যারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। গ্রামাঞ্চলে এখন হ্যারিকেন যেমন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তেমনি বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রামও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে হ্যারিকেনের জায়গা দখল করে নিয়েছে সৌর বিদ্যুতের আলো বা চার্জার লাইট। গ্রামাঞ্চলে এখনও দু-এক বাড়িতে হ্যারিকেন পাওয়া গেলেও দেখা যায় ব্যবহার না করায় সেগুলোতে ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
ছোটবেলায় আমরা ল্যাম্প কিংবা হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় লেখাপড়া করেছি। বাতাসের ঝাপটায় কখনও কখনও আলো নিভে গেছে। আবার দিয়াশলাই অথবা চুলার আগুনে পাটকাঠি দিয়ে আলো জ্বালিয়েছি।
হ্যারিকেনের আলো মৃদু হলেও সেই সময় শিক্ষার্থী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের চোখের তেমন সমস্যা হতো না। কিন্তু আজ বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে শিশু ও প্রবীণদের চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হ্যারিকেন এখন শুধুই স্মৃতি। নতুন প্রজন্ম হয়তো হ্যারিকেন সম্পর্কে জানবে না, পড়তে হবে ইতিহাস। হয়তো এক সময় হ্যারিকেনেরে দেখা মিলবে বাংলার জাদুঘরে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct