এই সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত। তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলির কথা বলিতে পারিতেন। নিত্য নতুন রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের কথা বড় মনে পড়ে। আফসোস হয়। সামাজিক রঙ্গ অপেক্ষা রাজনৈতিক রঙ্গ এখন প্রধান স্থান দখল করিয়াছে। রাজনৈতিক নেতাদিগকে অভিনয়বিদ্যায় কে দীক্ষা দিয়াছিল, জানি না; তাঁহারা ক্ষণে ক্ষণে হাসিয়া-কাঁদিয়া, নানাবিধ ছলাকলার দ্বারা বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমাইয়া তুলিয়াছেন। বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান ধারা লইয়া বিশ্লেষণ করিয়াছেন দিলীপ মজুমদার। আজ প্রথম কিস্তি।
এই সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত। তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলির কথা বলিতে পারিতেন। নিত্য নতুন রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের কথা বড় মনে পড়ে। আফসোস হয়। সামাজিক রঙ্গ অপেক্ষা রাজনৈতিক রঙ্গ এখন প্রধান স্থান দখল করিয়াছে। রাজনৈতিক নেতাদিগকে অভিনয়বিদ্যায় কে দীক্ষা দিয়াছিল, জানি না; তাঁহারা ক্ষণে ক্ষণে হাসিয়া- কাঁদিয়া, নানাবিধ ছলাকলার দ্বারা বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমাইয়া তুলিয়াছেন। উত্তমকুমার, দিলীপকুমার, সুচিত্রা সেন, অমিতাভ বচ্চন প্রভৃতিরা রাজনৈতিক কুশীলবের সহিত পাল্লা দিতে ব্যর্থ হইয়াছেন।
বঙ্গদেশে বিধানসভার নির্বাচনের পূর্ব হইতে শুরু হইয়াছে রঙ্গ। তখন করোনাসুর প্রবলভাবে অবস্থান করিতেছিলেন। নানা রঙ্গ দেখাইতে ছিলেন তিনি। পরীক্ষা লইয়া, চিকিৎসা পরিষেবা লইয়া, মৃত্যু লইয়া বিরোধীরা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করিয়াছিলেন। শাসকদল আত্মপক্ষ সমর্থনে অবিচল থাকিয়া কেন্দ্রকে দোষ দিতেছিলেন। কিন্তু এ দেশের শাসকরা বড় গণতন্ত্রপ্রিয়। অতএব করোনার প্রবল আবহেও নির্বাচনের ঘণ্টা বাজাইয়া দিলেন তাঁহারা। কেন্দ্রের শাসকদলের পাখির চোখ ছিল বঙ্গদেশ। তাঁহারা বঙ্গে মাসাধিক কালের ভোটের নির্ঘন্ট নির্মাণ করিলেন। আটটি ফেজে ভোট হইবে। প্রতিবাদ করিলেন বঙ্গের শাসকরা।
গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনীতিকরা করোনাসুরকে বুড়া আঙুল দেখাইয়া সভা-সমিতি-মিছিল- মিটিংএর আয়োজন শুরু করিলেন। দিল্লিসহ নানা প্রদেশ হইতে নেতা-ফিতারা ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো আসিতে লাগিলেন বঙ্গে। এখানকার হোটেল, রিসর্টগুলি তাঁহাদের কৃপায় কিছু পুষ্ট হইল। বঙ্গের শাসকদল সেই সব নেতাদের ‘বহিরাগত’ বলিয়া দাগাইয়া দিতে তর্ক উঠিল। টিভি চ্যানেলগুলিতে বসিয়া পড়িলেন স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা। যুক্তি-তর্ক অচিরে চিৎকারে পর্যবসিত হইল। গলার জোরে, খেউড়ের তরঙ্গে রমরম করিতে লাগিল চারিদিক।
ভবানীপুর ছাড়িয়া শাসকদলের নেত্রী দাঁড়াইয়াছিলেন নন্দীগ্রামে। প্রতিপক্ষ ছিলেন দলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীবাবু। নেত্রী নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়া পায়ে আঘাত পাইলেন। বিরোধীরা বলিলেন নাটক। পূর্ব পূর্ব নাটুকেপনার নজির তুলিয়া ধরিলেন তাঁহারা। দিন কতক হাসপাতালে থাকিয়া নেত্রী হুইলচেয়ারে বসিয়া ঘুরিতে লাগিলেন দেশময়। একটা ফুটবল লইয়া তাহাতে একটা লাথি ঝাড়িলেন। তখন চারিদিক প্রকম্পিত করিয়া স্লোগান উঠিল ‘খেলা হবে খেলা হবে’। কালক্রমে এই ‘খেলা হবে’ তাঁহাদের রণসংগীতে পরিণত হইল। প্রধানমন্ত্রীও ব্যঙ্গ করিয়া বলিলেন ‘খেলা হোবে’। বঙ্গ বিজেপির সভাপতি মহাশয় অকপট মানুষ। তাঁহার মুখের কোন লাগাম নাই। তিনি শাসকদলের নেত্রীকে বারমুডা পরিবার বিধান দিলেন। তাহা লইয়াও তর্ক উঠিল। সংস্কৃতির পীঠস্থান বঙ্গদেশে এ কি অসংস্কৃত ভাষা!
ফল ঘোষণার দিন নাটকের পর নাটক। অমিত শা্হজি দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাইয়া গিয়াছিলেন যে তাঁহারা জিতিতেছেন। ২০০-এর উপরে তাঁহারা আসন লাভ করিবেন। তাঁহার দলের লোকেরা বিজয় মিছিলের প্রস্তুতি করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু বেলা বাড়িতেই তাঁহাদের মুখ চুপসাইয়া গেল। শেষ পর্যন্ত সাতের ঘরে আটকাইয়া রহিলেন তাঁহারা। ‘বিজেমূল’এর বিরোধী বাম ও কংগ্রেস খাতা খুলিতে পারিল না, বহু কেন্দ্রে তাহাদের জামানাপ্ত অর্থাৎ জামানত বাজেয়াপ্ত হইল। ইহার মধ্যেও রঙ্গ আছে। যে আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সহিত জোট করিয়াছিল বাম ও কংগ্রেস, যাহা লইয়া সেই দুই দলের অভ্যন্তরে কথা উঠিয়াছিল, সেই আব্বাসবাবুদের দল পাইল একটি আসন।
তৃণমূল ২০০ পার করিল। কিন্তু নন্দীগ্রামে রঙ্গ হইল। টিভিতে দেখা গেল মমতা ব্যনার্জী শুভেন্দুবাবুকে ১২০০ ভোটে হারাইয়া দিয়াছেন। সংবাদ দিয়াছেন এ এন আই। তাহার পর অখন্ড নীরবতা। তাহার কয়েক ঘন্টা পরে ঘোষিত হইল শুভেন্দুবাবু জিতিয়া গিয়াছেন। শাসক দল বলিলেন গন্ধটা বড় সন্দেহজনক। আদালতে যাইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেন তাঁহারা। জায়েন্ট কিলার হিসাবে অধিকারীবাবুর মান ও প্রতিপত্তি বাড়িল। তাঁহার হাঁটাচলার ভঙ্গি বদলাইয়া গেল। তাঁহার দলের দিল্লির নেতৃত্ব তাঁহাকে কদর করিতে লাগিলেন। বঙ্গ বিজেপির দোর্দন্ডপ্রতাপ সভাপতির ভাবমূর্তি ম্লান হইতে লাগিল। (ক্রমশ)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct