মার্কিন নাগরিক আকরাম শিবলি ও তার বান্ধবী কেলি ম্যাককরমিক। ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডার রাজধানী টরন্টো যাচ্ছিলেন তারা। বিমানবন্দরে আটকানো হয় তাদের। পুলিশ তাদের মোবাইলের পাসওয়ার্ড চেয়ে বসে। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড কেন পুলিশকে দেব; এমন প্রশ্ন মাথায় আসলেও শিবলি আর কেলি পুলিশের কথা মেনে শেষপর্যন্ত নিজেরে ফোনের পাসওয়ার্ড দিয়ে দেন।
তিনদিন পর টরন্টো থেকে ফেরার পথে আবারও বিমানবন্দরে একই বাস্তবতার মুখোমুখি হন তারা। আবারও চাওয়া হয় তাদের মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড। এবার আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার (প্রাইভেসি) প্রশ্নে আপোস করতে চান না শিবলি ও কেলি। শিবলি পুলিশকে নিজ ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে অস্বীকৃতি জানান। ‘এর আগে একবার আমার সঙ্গে এমন হয়েছে। আর না।’ বলতেই পুলিশ ঘিরে ফেলে তাদের। একজন পুলিশ তার পা চেপে ধরেন এবং একজন গলা। এরপর মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় তার। বান্ধবী কেলিও তার ফোন এগিয়ে দেন পুলিশের দিকে।
কেবল শিবলি-কেলির ওই ঘটনা নয়, অনুসন্ধানে এমন ২৫টি ঘটনা তুলে এনেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ যেখানে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড চেয়ে নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশির ওপরও। এছাড়া ২০১৪ সালের এক রায়েও ওয়ারেন্টবিহীন তল্লাশিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তা সত্ত্বেও বেআইনিভাবে এই ধরনের তল্লাশি চলছে। ক্ষুণ্ন হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সাংবিধানিক মানবাধিকার।
প্রকৃতপক্ষে মুসলিম-প্রধান আট দেশের বিমানে ল্যাপটপ, ট্যাব বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য পরিবহনে ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে এমন ভোগান্তি বেড়েছে বিমানযাত্রীদের। নিরাপত্তার কারণে অতিরিক্তি তল্লাশি তো আছেই। পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপরে বেআইনি আঘাত বাড়ারও অভিযোগ উঠেছে। এর বিরোধিতা করায় কয়েকজনকে শারীরিক হেনস্তারও শিকার হতে হয়েছে বলেও জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো।
সীমান্তে বা প্রবেশমুখে এমন ওয়ারেন্টবিহীন তল্লাশি অনেকদিন ধরেই বিতর্কিত। মার্কিন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীকে উপজীব্য করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই এই প্রক্রিয়ার বিপক্ষে অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছে। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ মার্কিন সংবিধান অনুসরণ করছে না বলে দাবি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।
ইতোমধ্যে এ নিয়ে মামলা করেছে কিছু সংগঠন। তাদের দাবি মুসলিমদের উপরই এই হয়রানি বেশি করা হচ্ছে।
বিমানবন্দরে যাত্রীদের ল্যাপটপ ও মোবাইলফোন তল্লাশির ‘আক্রমণকর’ উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক পাবলিক ইন্টারেস্ট সংগঠন নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিটিউট। তাদের দাবি, মার্কিন সীমান্তে শুল্ক ও সীমান্ত কর্মকর্তারা ‘অবৈধভাবে’ সবার তল্লাশি চালাচ্ছেন। মামলার নথিতে বলা হয়, গত দুইবছরে এই তল্লাশির হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০১৫ সালে ৫ হাজার মানুষকে এভাবে তল্লাশি করা হয়। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজারে। তবে চলতি নিষেধাজ্ঞার পর
কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই এই ধরনের তল্লাশি হয়েছে ৫ হাজার। এই মামলার মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকারের কাছে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি। কতজন মার্কিন নাগরিক এমন তল্লাশির শিকার হয়েছেন, প্রবেশের সময় কোন দেশের নাগরিকরা বেশি হয়রানির শিকার সবকিছুই জানানোর দাবি করেছেন তারা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলা অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের ওয়ারেন্টবিহীন তল্লাশি নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের উপর আঘাতের সামিল। স্পষ্টত একে মানবাধিকারের লঙ্ঘন মনে করেন তারা। মোবাইল ফোনে ব্যক্তিগত আলাপ, ছবি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তাই এসব জিনিস তল্লাশি একটি ব্যাগ তল্লাশির চেয়ে অনেক বেশি ‘অনধিকার চর্চা’।
তা সত্ত্বেও মার্কিন সীমান্ত পুলিশ তাদেরকে ফোন আনলক করতে বাধ্য করছে, কখনও শারীরিক হেনস্তারও শিকার হতে হয়েছে তাদের।
জানা যায়, কখনও কখনও সাংবাদিকরাও এমন তল্লাশির শিকার হয়েছেন। তাদের ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া সূত্রের পরিচয়ও থাকে। গত বছর কানাডিয়ান এক সাংবাদিককে মোবাইল ফোন আনলক না করায় ৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিলো। এছাড়া সীমান্ত পুলিশরা সবসময় মুসলিমদেরই বেশি লক্ষ্য করে ও হয়রানি করে। কখনও মার্কিন মুসলিমদের, কখনও মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের ।
‘কাউন্সিল অফ আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন’ এর করা একটি অভিযোগ থেকে জানা যায়, বিমানবন্দরে মুসলিমদের বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কি মুসলিম, জিহাদ বিষয়ে আপনার ধারণা কী। তারা মসজিদে যান কিনা এমন প্রশ্নও বাদ যায় না।
অভিযোগ করা হয়, সীমান্তে তল্লাশির সময় অনেকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যও জানতে চাওয়া হয়। গত ডিসেম্বরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, খুব শিগগিরই বিদেশি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের সময় সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য জানতে চাওয়া হবে। পলেটিকো জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আবেদনকারী বিদেশিদের সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য সরবরাহের একটি ঐচ্ছিক অপশন দেওয়া শুরু হয়। তবে অনুসন্ধানভিত্তিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্ট-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে মার্কিন নাগরিকসহ অনেকেরই ফেসবুক, টুইটার সহ সামাজিক মাধ্যমের তথ্য জানতে চাইছে বর্ডার পুলিশ।
এই ফেব্রুয়ারিতে সিনেটর রন ওয়াইডে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রধান জন কেলিকে একটি চিঠি লিখেছেন। যেখানে লেখা ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের মুখে নাগরিকদের ব্যক্তিগত মোবাইলের পাওয়ার্ড চাওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদেনে আমি উদ্বিগ্ন।’ এমন তল্লাশির আগে ওয়ারেন্ট ব্যবহার করার অপরিহার্যতার কথাও বলা হয় চিঠিতে।
এরকম তল্লাশি সাম্প্রতিক সময়ে এত বেড়ে গেছে যে আইনী প্রক্রিয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিটিউট এক বিবৃতিতে জানায়, ভবিষ্যতে এমন তল্লাশি যেন না হয় তার নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা করবে তারা। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জামিল জাফর বলেন, ‘এই তল্লাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের পরিপন্থী। সরকারের কোনও কারণ ছাড়া এমন কিছু করা উচিত নয়। সীমান্ত পুলিশের এমন ক্ষমতা নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করে।’
২০১৪ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এক রায় দিয়েছিল যে ওয়ারেন্ট ছাড়া কারও মোবাইল তল্লাশি করা যাবে না। এমনকি গ্রেফতারকৃত নাগরিকের মোবাইল ফোনের তথ্য তল্লাশি করার জন্যও ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হবে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ক অধ্যাপক অরিন কের সে সময় বলেছিলেন, ‘এটা আধুনিক যুগ। আপনি প্রাচীন তল্লাশি ব্যবস্থা এই সময়ে এসে প্রয়োগ করতে পারেন না।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct