২০১৬ সালের শেষ সপ্তাহে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের হাত থেকে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী আলেপ্পো উদ্ধার করেছে। এর মাধ্যমে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আলেপ্পোর যুদ্ধের ফলাফলটা যুদ্ধরত উভয় পক্ষের জন্য একটি টার্নিংপয়েন্ট। আলেপ্পোর যুদ্ধে বিজয় আসাদের ক্ষমতাকে যেমন আরো সংহত করেছে, ঠিক তেমনি বিদ্রোহী শিবিরকে বিপর্যস্ত করেছে। সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব, ইসরাইল, তুরস্ক ও তাদের মিত্রদের সিরিয়া নীতির পরাজয় ঘটতে চলেছে।
অপরদিকে রাশিয়া, চীন, ইরান এবং হিজবুল্লাহর সিরিয়া নীতির বিজয় ঘটতে চলেছে। তবে এর মাধ্যমে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করব, সিরিয়ার যুদ্ধটা এবার বন্ধ হবে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা অর্থহীন এই গৃহযুদ্ধে ধ্বংস ছাড়া সিরিয়ার মানুষেরা আর কিছুই অর্জন করেনি। এই যুদ্ধে দেশটি কেবল ধ্বংসই হয়েছে। সুতরাং অনেক হয়েছে, এবার যুদ্ধটা বন্ধ করে সিরিয়ার মানুষদেরকে একটু বাঁচতে দিন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করেছে। বিদ্রোহীদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব, সাথে ছিল তুরস্ক, সৌদি আরব এবং কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশ। পেছন থেকে ইসরাইল কলকাঠি নাড়ছে। অপরদিকে আসাদের পক্ষে আছে ইরান, রাশিয়া, চীন ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। এ যুদ্ধে ইতোমধ্যেই পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং চল্লিশ লাখ মানুষ উদ্ধাস্তু হয়েছে। এর মধ্যে ত্রিশ লাখ তুরস্কের উদ্ধাস্তু শিবিরে বসবাস করছে। যাদের এক সময় অর্থ, বিত্ত, আভিজাত্য সবই ছিল, তারা এখন সব হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিদিনই অসহায় মানুষেরা বাঁচার তাগিদে বিদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ইরাক এবং লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব জাতিসংঘে একাধিকবার প্রস্তাব তুলেছে। কিন্তু রাশিয়া এবং চীন প্রতিবারই তাতে ভেটো দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট আসাদকে উৎখাতে সামরিক অভিযান চালাতে পারেনি। বিদ্রোহীদের অফিস, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সবই তুরস্কের মাটিতে। তুরস্কের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ সীমান্তের সুযোগে বিরোধীরা অবাধেই তুরস্ক হয়ে অস্ত্র পেয়েছে। আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সৌদি আরব এবং কাতার অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে পশ্চিমাদের সকল তৎপরতা এবং বিদ্রোহীদের সকল যুদ্ধকে মোকাবেলা করে আসাদ এখনো শক্ত হাতে ক্ষমতাকে ধরে রেখেছেন। প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহীরা যুদ্ধে সফলতা দেখালেও পরবর্তীতে আস্তে আস্তে পিছু হটেছে। দখলকৃত এলাকাগুলো সরকারি বাহিনী পুনরুদ্ধার করছে।
পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মুসলিম ভূখ-ে ১৯৪৭ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। এই ইস্যুতে ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে, যাতে ইসরাইল বিজয়ী হয়েছে। এই যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান মালভূমি, মিসরের সিনাই উপত্যকা এবং ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখ- ইসরাইল দখল করে নিয়েছে। সিরিয়া হচ্ছে একমাত্র মুসলিম দেশ যে কখনো ইসরাইলের সাথে আপস করেনি। যা এখনো বিদ্যমান। সিরিয়া ছিল বরাবরই সাবেক সোভিয়েত ব্লকের সাথে সংশ্লিষ্ট। বছরের পর বছর ধরেই সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং পশ্চিমা বিশ্বের বৈরিতা চলে এসেছে সেকারণেই। ইসরাইলের শত্রু হামাস এবং হিজবুল্লাহকে সাহায্য-সহযোগিতা করার কারণে সিরিয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের শত্রু। ১৯৭৯ সালে মিসরের সাথে ইসরাইলের শান্তি চুক্তির পর থেকে মিসর হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এবং ইসরাইলের স্বার্থরক্ষাকারী। অপরদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়।
এ অবস্থায় ইরানের সাথে সিরিয়ার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা এখনো অটুট আছে। ইরান এবং সিরিয়া ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে। ইরান, সিরিয়া, হামাস এবং হিজবুল্লাহর সমন্বয়ে একটি জোট গড়ে ওঠে, যারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের স্বার্থের বিরোধিতা করে। ২০১১ সালে জনতার আন্দোলন তিউনিসিয়া এবং মিসরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বন্ধু সরকারের পতন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ দুটিতে ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায় আরোহণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের জন্য বিরাট বিপর্যয়। মিসর এবং তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায় আরোহণে বিশ্বজুড়ে ইসলামপন্থিরা অনুপ্রাণিত এবং চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ইরানের সাথে মিসরের ৩০ বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও মোবারক-পরবর্তী ব্রাদার হুডের সময়ে ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় ইরানের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলবিরোধী জোট শক্তিশালী হতে শুরু করে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে পেয়ে বসে সাম্রাজ্য হারানোর ভয় আর ইসরাইলকে পেয়ে বসে অস্তিত্ব হারানোর ভয়। এই সংকট উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরাইল দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের পরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন তাদের অনুগত শাসকদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা।
তাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনা, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশে ক্ষমতাসীন তাদের বিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এ জন্য পশ্চিমারা এসব দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করছে। প্রয়োজনে গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে সেখানে সামরিক আগ্রাসন চালাবে এবং তাদের বিরোধীদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। এরই অংশ হিসেবে প্রথমেই তারা দীর্ঘদিনের শত্রু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা লিবিয়ায় হামলার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস করে এবং পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ায় সামরিক হামলা শুরু করে। লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফী তার বাহিনী নিয়ে পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি তার তিন সন্তানসহ জীবন দেন। এভাবে পশ্চিমারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নির্মমভাবে হত্যা করেন। আর দেশটিকে ধ্বংস করেন। গাদ্দাফী-পরবর্তী লিবিয়া আজ এক ধ্বংসের জনপদ। লিবিয়ার জনগণ আজ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কিছুই পায়নি।
লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল মিসরের ক্ষমতা থেকে ইসলামপন্থি প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমারা পাশ্চাত্যবিরোধী ড. মুরসিকে কৌশলে আরেক পাশ্চাত্যবিরোধী আসাদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেন। এক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের পক্ষে প্রধান ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এরদোগান। তিনি আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আসাদবিরোধী পদক্ষেপ নিতে মুরসিকে উদ্বুদ্ধ করেন, যা ছিল মূলত পশ্চিমাদেরই পরিকল্পনা। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলবিরোধী মিসরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের আরেক শত্রু আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন। এটা ছিল মুরসির ঐতিহাসিক ভুল। পশ্চিমা বিশ্ব এটাই চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের দুই প্রতিপক্ষ ড. মুরসি এবং আসাদ যখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে যায় তখনই পশ্চিমারা ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি সম্পন্ন করে। পশ্চিমারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজ তাড়াতাড়িই শুরু করে এবং আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের দুই মাসের মধ্যেই ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। গণতন্ত্র হত্যাকারী মিসরের সেনাবাহিনীকে নীরবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। মিসরের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত কয়েক হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নেয়। লিবিয়ার গাদ্দাফী এবং মিসরের ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল তাদের আরেক শত্রু সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কাজ করছে। এখানেও পশ্চিমাদের প্রধান সহযোগী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে পশ্চিমা বিশ্ব কখনই সফল হতো না। একইভাবে তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে সিরিয়ার আসাদবিরোধী যুদ্ধ কখনই এতটুকু অগ্রসর হতো না।
একইভাবে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় মুরসি যদি আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিতেন তাহলে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পশ্চিমা পরিকল্পনা কখনই বাস্তবায়িত হতো না। এরদোগানের ভুল পররাষ্ট্রনীতি মুসলিম বিশ্বের হাজারো সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দিয়েছে এবং মুসলিম বিশ্বকে শত বছরের জন্য পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এরদোগানের ভুল নীতি আরব বসন্তের সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে। অবশ্য এরদোগান এখন তার ভুল বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ। এরদোগান এ জন্য প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুতির নীতি থেকে সরে এসেছেন, আগের অবস্থান বদল করে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের মিত্র রাশিয়া এবং ইরানের সাথে হাত মিলিয়েছেন। এর মাধ্যমে এরদোগানের আসাদবিরোধী নীতি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখান দিয়ে এরদোগানকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে। মনে রাখতে হবে, আবেগ আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। আবেগ দিয়ে পুরো পৃথিবীকে জয় করার স্বপ্ন দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবতায় সামান্য একটি ভূখ-ও জয় করা কঠিন। মুসলিম বিশ^কে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমাদের যে মহাপরিকল্পনা, তার অংশ হিসেবে পশ্চিমারা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুতি এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। তারা ইরাককে ধ্বংস করেছে। একইভাবে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে তালেবানদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং কয়েক লাখ আফগান মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর তারা সিরিয়াকে ধ্বংস করার উৎসবে মেতে ওঠে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা মোটেই তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। কেননা, ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামপন্থিরা বিজয়ী হলেও পশ্চিমারা তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ইসলামপন্থি হামাস বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলেও তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। আর মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছিল তারই ধারাবাহিকতা।
রাজনীতির সম্পর্কের বেসিক নীতি হচ্ছে শত্রুর শত্রু বন্ধু, শত্রুর বন্ধু শত্রু। একইভাবে বন্ধুর বন্ধু বন্ধু আর বন্ধুর শত্রু শত্রু। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই সিরিয়ার সাথে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের ভালো সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের শত্রু বলেই হামাস এবং হিজবুল্লাহর সাথে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ভালো সম্পর্ক। এই সমীকরণ রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে এবং এই সমীকরণ উপলব্ধিতে ভুল করলে বিপর্যয় অনিবার্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছে তাদের শত্রু আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অপরদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান তাদের মিত্র আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে চায়। আর আসাদের পতন হলে হামাস-হিজবুল্লাহ-ইরান সবাই দুর্বল হবে। দুর্বল হবে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া এবং চীনের শক্তি, বাড়বে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের শক্তি। তবে আসাদ যেহেতু বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের কট্টর বিরোধী একজন মানুষ সেজন্য আন্দোলনের মাধ্যমে এবং বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি। কারণ মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের মধ্যে যারা পশ্চিমাবিরোধী তারা স্বৈরশাসক হলেও তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ কারণে লিবিয়ার গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পশ্চিমা বিশ্বকে ছয় মাস ধরে সামরিক আগ্রাসন চালাতে হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বেলায়ও ব্যাপারটা শতভাগ সত্য। এ জন্যই আসাদ এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন। আর সিরিয়ায় আগ্রাসন চালাতে গেলে জাতিসংঘের অনুমোদন লাগবে যেটা রাশিয়া এবং চীনের ভেটো প্রদানের ফলে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া পশ্চিমাদের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের স্লোগানের প্রতি মানুষের তেমন আস্থা নেই। ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়ার পরিণতি মানুষ তো দেখতে পাচ্ছে। বিদ্রোহীরা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য লড়াই করলেও তাদের প্রতি জনগণের তেমন সমর্থন নেই। তারা বহুদা বিভক্ত এবং লক্ষ্যহীন। যুদ্ধের ময়দানে ইসলামপ্রিয় কিছু মানুষ যুদ্ধ করলেও তাদের নেতারা সেক্যুলার এবং পশ্চিমাপন্থি, যার নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হাতে। এ জন্য তাদের তেমন জনপ্রিয়তা নেই এবং তাদের সফল হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এ জন্যই বিদ্রোহীরা তাদের দখলকৃত এলাকাসমূহ হারাতে শুরু করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব, তুরস্ক এবং তাদের আরব মিত্রদের সাহায্য-সহযোগিতার কারণেই তারা এতদিন টিকে ছিল। কিন্তু তুরস্ক এখন অবস্থান বদল করে আসাদের মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সাথে যোগ দেয়ায় বিদ্রোহীদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
এ অবস্থায় সিরিয়ার অর্থহীন যুদ্ধটা বন্ধ করাটাই হচ্ছে প্রধান কাজ। তার জন্য প্রথমেই স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট আসাদের উচিত হবে বিদ্রোহীদেরকে ক্ষমা করে দেয়া এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে দেশটিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আর বিদ্রোহীদের উচিত হবে অস্ত্র পরিত্যাগ করে অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার পুনর্গঠনে অংশ নেওয়া। বিদ্রোহীদেরকে বুঝতে হবে, আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনো সম্ভাবনা এখন আর নেই। একইভাবে আসাদবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও তাদের সামনে নেই। সুতরাং রাজনৈতিক উপায়েই সিরিয়া সংকটের সমাধান এখন সময়ের দাবি। তাই সিরিয়ার সকল পক্ষের প্রতি আবেদন, আপনারা আলোচনায় বসুন এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে সমঝোতায় এসে সিরিয়ার ঐক্য, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুন। বিদেশে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসরত সিরিয়ার সকল নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনুন এবং তাদেরকে নিজ বসতভিটায় নির্ভয়ে বসবাসের সুযোগ দিন। দীর্ঘ ছয় বছরের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সিরিয়ায় নতুন বছরটা শান্তি বয়ে আনুক, এটাই প্রার্থনা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct