মানব ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে যারা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়ে সংস্কারমূলক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিতায় ভারতে জন্ম নিয়েছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। যাঁর মূলধন ছিল অহিংসা ও সত্য।
অহিংসা একটি নৈতিকতত্ত্ব। অহিংসার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতে। জৈনধর্মের সঙ্গে এর বিশেষ সংযুক্তি হলেও বৌদ্ধধর্মে এর অনুশীলন বেশি। সকল জীবের প্রতি অহিংসা প্রদর্শনের ধারণাটি জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে। জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতায় সকল জীবের প্রতি করুণা ও ক্ষতি না করার বিষয়টি অনন্য এবং পশুবলির প্রাচীন বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতার উৎপত্তি। এক কথায় অহিংসার অর্থ হলঃ সকল প্রাণী সুখী হোক। আধুনিককালে মহাত্মা গান্ধী অহিংসার রূপকার হিসেবে সর্বজনবিদিত। মহাত্মা গান্ধী অহিংসার ধারণার মধ্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংসাকে একটি সক্ষম ফলপ্রসূ রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে যেখানে সাধারণত সহিংসতা এবং প্রচুর অস্ত্র ব্যবহূত হতো, সেখানে মহাত্মা গান্ধী অহিংসাকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশ শাসকদের শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় করার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল আবিষ্কার করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। (বাংলা পিডিয়া)
গান্ধীজীর অহিংসা তত্ত্বটি আসলে কী? এর মৌলিক উপকরণ হল ধৈর্য। তার সঙ্গে আছে আধ্যাত্মিক চেতনা, বিশ্বাস, মানবিক মূল্যবোধ, সাহস, কৌশল, লক্ষ্য ও পরিকল্পনার সমম্বয়। গান্ধীজী কঠোর সাধনায় ব্যক্তিজীবনে এসবই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পেরেছিলেন। একটি ঘটনা উপস্থাপনা করলে তাঁকে চেনা সহজ হবে। ইংল্যান্ডের ডাক্তার সাবারকরের সঙ্গে গান্ধীজীর একবার হিংসা- অহিংসা নিয়ে কথা উঠে। গান্ধীজী তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ড গিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারেরে সঙ্গে আলোচনা করতে। ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে তর্কের এক পর্যায়ে ডাক্তার সাবারকর গান্ধীজীকে প্রশ্ন করেন, মনে করুন একটি বিষাধর সাপ আপানর দিকে তেড়ে আসছে, আপনার কাছে আছে একগাছা লাঠি। আপনি কি করবেন? মারবেন, নাকি মারবেন না? গান্ধীজীর উত্তর ছিল, ‘লাঠিখানা আমি ছুড়ে ফেলে দেব। পাছে আমার মারবার প্রলোভন জাগে’।
তখন পশ্চিমি প্রভুরা বুঝে গিয়েছিলেন, ভারতবাসীর সব অস্ত্র ধ্বংস করা গেলেও গান্ধীজীর আধ্যত্মিক ও মানবিক অস্ত্র ধ্বংস করা যাবে না। অন্নদা সংকরের ভাষায়, ‘এবার তারা জানলেন যে, সব হাতিয়ার বাজেয়াপ্ত করলেও একটি হাতিয়ার থেকে যায়, সেটির নাম নিরস্ত্র। তা থেকে কোন মানুষকে বঞ্চিত করা যায় না। গান্ধীজী ভারতবাসীর হাতে একটিমাত্র অস্ত্র তুলে দেন। তার নাম নিরস্ত্রতা।
গান্ধীজী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখে তখন সেখানকার বর্ণসচেতন ইংরেজ শাসকেরা কালো মানুষদের উপর নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়ন ও অত্যাচার চালাচ্ছে। সেখানে ভারতীয়দেরও সেই বৈষম্যমূলক নির্যাতন সহ্য করতে হত। এই সময় গান্ধীজী নেমে পড়লেন আইনি লড়াইয়ে। সাথে সাথে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে শুরু করলেন আন্দোলন।
প্রবাসী ভারতীয়দের ওপর কর আরোপের প্রতিবাদে ধর্মঘট এবং মিছিল করার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও অবশেষে ব্রিটিশরা ওই ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল এবং গান্ধীজীকে মুক্তি দিয়েছিল। তাঁর এই বিজয় অর্জনের খবর সমগ্র ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং গান্ধী একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরেন। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে উঠেন। দেশে ফেরার পাঁচ বছর আগে ‘হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ‘হিন্দ স্বরাজ’ই ছিল তাঁর সত্যাগ্রহ, অহিংসা বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র। বইটি পড়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রুশ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘ একদিন শুধু খ্রিষ্টান দেশগুলো নয়, পৃথিবীর সব জাতিই আপনার চিন্তাধারা গ্রহণ করবে।'
গান্ধীজী পরিচালিত এই অহিংসা আন্দোলনকে যতই নিরীহ বলে ভাবা হোক না কেন, ব্রিটিশ সরকার এর ভয়ংকর শক্তি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গেল এবং গান্ধীজীর উপর শুরু হল নির্যাতনের পর নির্যাতন আর কারাবাসের পর কারাবাস। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বল পড়েনি গান্ধীজীর অহিংসার অস্ত্র। বরং আন্দোলনের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।
গান্ধী তার জীবনীতে অহিংসা সম্পর্কে বলেন: “যখন আমি হতাশ হই, আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালোবাসার জয় হয়েছে। দুঃশাসক-হত্যাকারীদের কখনও কখনও অপরাজেয় মনে হলেও শেষমেশ তাদের পতন ঘটে। মনে রাখবেন সর্বদাই।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের মধ্যরাত্রে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর অবিস্মরণীয় 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি' Tryst with Destiny ভাষণে গান্ধীজীর কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ‘Not only we but succeeding generations will remember this message and bear the imprint in their hearts of this great son of India, magnificent in his faith and strength and courage and humility. অর্থ ‘কেবলমাত্র আমরাই নই, বরং আগামী প্রজন্মও তাঁর আদর্শকে মনে রাখবে এবং ভারতের এই মহান আত্মার মন্ত্রকে তারা মনে প্রানে গেঁথে রাখবে’ যার বিশ্বাস, মনোবল এবং মানবতা পাহাড় সমতুল্য।
২০১১ সালে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারতের সংসদে তার বক্তব্য রাখতে গিয়েও বলেন যে, ‘I am mindful that I might not be standing before you today, as President of the United States, had it not been for Gandhi and the message he shared with America and the world.’ অর্থাৎ ‘আমার বিশ্বাস যদি এই পৃথিবীতে গান্ধীজির মতো মানুষের আগমন না ঘটত এবং তাঁর মন্ত্র ও মতাদর্শ আমেরিকায় এবং বিশ্বে ছড়িয়ে না পড়ত, তাহলে আমার মতো মানুষের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার খোয়াব চিরকাল স্বপ্নই থেকে যেত’। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার বলেছেন, ‘মানবজাতির প্রগতির জন্য গান্ধী অপরিহার্য’।
গান্ধীজীর অহিংসা নীতি এবং শান্তিপ্রিয় হওয়ার জন্য পাঁচবার মনোনীত হলেও গান্ধীজী নোবেল পুরস্কার পাননি। কিন্তু তার ভাবশিষ্যদের অনেকে, যেমন- মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, দালাইলামা, বারাক ওবামা, কৈলাস সত্যার্থী, দেসমন্ড টুটু এবং আর্জেন্টিনার এ্যাডল্ফ পেরেজ এসকুইভেল নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। গান্ধীর নোবেল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে নিহিত আছে। শুধু তাই নয় আমার মনে হয় মহাত্মা গান্ধী নোবেল পুরস্কারের উর্ধে তাই তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পুরস্কার দিলে তিনি দালাইলামা, বারাক ওবামার সারীতেই থেকে যেতেন। না পেয়ে তিনি এদের উর্ধে।
অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিশ্ব ইতিহাসকে অনেক পাল্টে দিয়েছে। যেমন ১৯১৩ সালে ওয়াশিংটনের নারী ভোটাধিকার আন্দোলন, ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ১৯৬৩ সালের দ্য ওয়াশিংটন সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, এই আন্দোলনের কারণে আফ্রিকান আমেরিকানরা ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার এবং ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার অর্জন করে। ১৯৮৯ সালের জার্মানি আন্দোলন তথা দ্য মানডে ডেমনস্ট্রেশন, এক দিনে ৩০০,০০০ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী জড়ো হয়। এবং বার্লিন দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে অবশেষে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানিতে পুনরায় মিলিত হয়। আমেরিকায় ১৯৯৩ সালের সমকামী অধিকার আদায় আন্দোলন। আরব বসন্ত, ২০১০-২০১৩। ২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় শুরু এই আন্দোলন। ধীরে ধীরে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যে। পালটে যায় ইতিহাস। ২০১৯ সালের শাহিনবাগের আন্দোলন। এই আন্দোলন সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল। বিলকিসের মতো এক সাধারণ পরিবারের বৃদ্ধা মহিলাকে বিশ্বের প্রচারের আলোয় এনে দিয়েছে। 'শাহিনবাগের দাদি' এখন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিশ্বজুড়ে হিংসা-হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহের অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গান্ধীর অহিংস নীতি আজও অনুসরণীয়। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বর্তমান বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমের আদর্শে তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে হলে মহাত্মা গান্ধীর জীবন থেকে সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। কারণ যে বুলেট ভারতের এই জাতির জনককে রক্তাক্তভাবে বিদায় দিয়েছিল, সেই বুলেটের চেয়েও বহুগুণে আজ গান্ধীর আদর্শ শক্তিশালী।
(সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct