বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস।কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।তৃতীয় কিস্তি।
এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কখন আসবে মাহেন্দ্রক্ষণ! ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাস। অযোধ্যায় সূচনা হল হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের। রামভক্ত সাধুরা মসজিদের বাইরে প্রজ্বলিত করলেন অগ্নিকুণ্ড। শুরু হল রামায়ণপাঠ। রামের নতুন আবির্ভাব সম্বন্ধে আবেগময় ভাষণ দিয়ে হিন্দু জনতাকে উত্তেজিত করা হল। ফলে উত্তেজিত হল মুসলমানরা। গুরুদত্ত আর নায়ার ভাবলেন রামজন্মভূমিকে মুক্ত করার সঠিক সময় এসে গেছে। ইংরেজদের হাত থেকে যেমন মুক্ত হয়েছে ভারতভূমি, তেমনি মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত হবে রামজন্মভূমি।
১৯৪৯ সালের ২২ নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। হিন্দু প্রহরীকে হাত করে অভিরাম দাস ও কয়েকজন সাধু ঢুকে গেছেন মসজিদের ভেতরে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন রামলালার ৭ ইঞ্চি মূর্তি। সন্ধেবেলা হিন্দু প্রহরী মুসলমান প্রহরীর হাতে মসজিদের চাবি দিয়ে চলে গেলেন। মুসলমান প্রহরী জানলেন না যে মসজিদের ভেতরে রামলালার মূর্তি নিয়ে সাধুরা লুকিয়ে আছেন। রাত তিনটে। হিন্দুশাস্ত্র মতে ব্রাহ্ম মুহূর্ত। হঠাৎ মসজিদের ভেতর থেকে শোনা গেল ঘন্টাধ্বনি। দেখা গেল ভেতরের মঞ্চ আলোকিত হয়েছে। সেখানে যেন মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূত হয়েছেন রামলালা। ঠিক যেন শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ ।
এ কথা, এই মাটি ফুঁড়ে রামলালার আবির্ভাবের কথা মুসলমান প্রহরী জানিয়েছিলেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। এরকমই তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি ভীত হয়ে বলেছিলেন, না প্রলোভিত হয়ে বলেছিলেন, তা অবশ্য জানা যায় নি। বিন্ধ্যেশ্বরীপ্রসাদ নামে এক সাধু জানিয়েছিলেন যে সেদিন তাঁরা মসজিদের বাইরে শুয়েছিলেন। রামলালার স্বপ্নও দেখেছিলেন। তারপর শেষরাতে শুনতে পেলেন ঘন্টাধ্বনি। সেই ধ্বনি শুনে তাঁরা ছুটে গেলেন ভেতরে। আলোকিত মঞ্চে রামলালাকে দেখে বুঝলেন তাঁদের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে ।
ঘন্টাধ্বনি ও কোলাহল শুনে ছুটে এলেন কনস্টেবলরা। শূন্যে গুলি ছুঁড়লেন। যেন শান্তিরক্ষকেরা তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন। এসব পরিকল্পনার খসড়া করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা পরিকল্পনামাফিক ঘটনাস্থলে ছিলেন না। গুরুদত্ত ছিলেন লোরপুর হাউসে। বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে খবর আদান-প্রদান হচ্ছিল ।
শাস্ত্রে বলে দেবতারা ত্রিকালদর্শী। ত্রিকালদর্শী রামলালা কি এরকম চক্রান্তকে মেনে নিতে পেরেছেন?
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মসজিদের ভেতরে আবির্ভূত হয়েছেন শ্রীরাম। খবর শুনে দলে দলে মানুষ ছুটে এল বাবরি মসজিদের দিকে। রামভক্তি লাভ করল নতুন উন্মাদনা। তবে অযোধ্যার সব সাধু যে এই উন্মাদনায় মাতাল হয়েছিলেন তা নয়। যেমন অক্ষয় ব্রহ্মচারী। ৩৫ বছর বয়স্ক এই সাধু মনে করতেন হিন্দুর মতো মুসলমানরাও ভারতের নাগরিক। সংগঠিতভাবে যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, তার বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। সতর্ক করে দিয়েছিলেন নায়ার ও গুরুদত্তকে। তাঁরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct