বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস।কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।দ্বিতীয় কিস্তি।
বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ ও তার নায়ক রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তার অন্ত্য নেই। গিলগামেশ, ভার্জিলের ‘আইনেইদ’, দান্তের ‘লা দিভিনা কম্মেদিয়া’, বৈয়ার্দোর ‘অর্লান্দো ইন্নামোরাতো’, লুডভিকো আরিওস্তোর ‘অর্লান্দো ফুরিওসো’, তাসসোর ‘জেরুসালেম লিবেরাতা’, এরসিলার ‘লা আরাউকানা’, লুই দ্য কামোয়েসের ‘ওস লুসিয়াডাস’, জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’, ফেরদৌসির ‘শাহনামা’র জনপ্রিয়তার সঙ্গে তুলনা করলে রামায়ণের জনপ্রিয়তার ব্যাপ্তি বোঝা যাবে ।
রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে পরিবার জীবনের কাব্য বলেছেন। সেটা জনপ্রিয়তার একটা কারণ হতে পারে। আর একটা কারণ এ কাব্যে করুণরসের প্রস্রবণ। সেই যে কবি বলেছেন Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts . নায়ক চরিত্রের আকর্ষণও আছে সেই সঙ্গে। রাম সুদর্শন, শান্ত, মার্জিত, এবং বিনীত। কৃষ্ণের মতো চাতুর্য বা শাণিত বুদ্ধির দীপ্তিতে তিনি উদ্ভাসিত নন। যুদ্ধবাজ নন দুর্ষোধন প্রভৃতির মতো। তিনি স্নিগ্ধ, বাধ্য ও অনুগত এবং ত্যাগব্রতী। আমরা নিজেরা লোভের বশীভূত কিন্তু যিনি অকাতরে লোভের হাতছানি পরিহার করতে পারেন, তাঁর প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল ।
বাল্মীকির রামায়ণ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে সন্ধান পাওয়া যায় রামায়ণের। সেজন্য ঐতিহাসিক এ কে রামানুজম বলেছিলেন : যত রাম তত রামায়ণ। মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতিতে উল্লেখ আছে রামায়ণের। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে রামায়ণের ৩৭৫০০ টি টীকাগ্রন্থ রচিত হয়। তার মধ্যে ঈশ্বরদীক্ষিত টীকা, উমা-মহেশ্বর টীকা, গোবিন্দরাজ টীকা প্রভৃতি মাত্র ২৮টি টিকা বেঁচে আছে কালের প্রহার সহ্য করে ।
পৃথিবীর নানা দেশে যেসব রামায়ণের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হুবহু বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ নয়। বাল্মীকি যখন রামায়ণ রচনা করেন, তখন লিপিবিদ্যা প্রচলিত হয় নি। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই কাব্য। বেঁচেছিল লোকশ্রুতিতে। এক বা একাধিক সংগ্রহকারক সেইসব শ্লোক সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেন। তখন পাদপুরণ করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজেদের রচনাও সন্নিবিষ্ট করে দেন। গ্রহণ-বর্জনের ফলে রামায়ণ নতুন নতুন রূপ লাভ করতে থাকে। আবার প্রাদেশিক ভাষায় যখন রামকথা রচিত হতে লাগল, তখন সেকালের রুচি ও প্রবণতা অনুযায়ী বদলে গেল তার রূপ। এরকম রূপান্তর স্বদেশ ও বিদেশ সর্বত্র ঘটেছে। যেমন থাইল্যাণ্ডের রামায়ণে সীতা রাবণের কন্যা, মালেশিয়ার রামায়ণে দশরথ আদমের প্রপৌত্র, মঙ্গোলিয়ার রামায়ণে রামের পিতা জীবক।
এই রূপান্তর, এই জনপ্রিয়তা রাম ও রামায়ণের সৌভাগ্য। সেই সঙ্গে আছে দুর্ভাগ্য। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কৌতুক করে বলেছেন, ‘ধরণীর নাম মর্ত্যভূমি। এখানে ভগবানও দুর্দৈবের হাত থেকে রাহাই পান না’। দুর্দৈবের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বললেন, ‘মনুষ্যলীলায় লীলায়িত রামচন্দ্র সারা জীবনভর বহু অবিচার, বহু যন্ত্রণা, ভোগ করে শেষ পর্যন্ত অতি আধুনিক এবং প্রগতিশীল কৃপামৃত্যু বরণ করলেন সরযূ নদীতে দেহপাত করে। কিন্তু তবু তাঁর জীবনের গল্প শেষ হল না। ত্রেতা যুগের পর দ্বাপর যুগ পেরিয়ে এসে এই কলিকালের ভক্তদের পাল্লায় পড়ে তিনি শেষ পর্যন্ত এক জাতিবোধক মামলায় জড়িয়ে পড়লেন। এ এমন এক মামলা, যেখানে সরযূ নদীতে দেহশান্তির পরেও তাঁকে বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থায় এক তথাকথিত বাল্যবন্ধুর ঘাড়ে চেপে মামলার পার্টি হয়ে যেতে হয়েছে ।’
রামচন্দ্রের দুর্ভাগ্য বা দুর্দৈব শুরু হয়েছে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার দুবছর পর থেকে। আমরা সেসব লোমহর্ষক কাহিনি বিস্তারিতভাবে বলব। এখন সংক্ষেপে সে কাহিনির চুম্বক মেলে ধরছি ।
১৯৪৯ সালের ২২ নভেম্বর। সেদিন গভীর রাতে আটটি ধাতুতে তৈরি রামলালার ৭ ইঞ্চি মূর্তি স্থাপন করা হল বাবরি মসজিদের ভেতরে। কে এই রামলালা? ইনি শিশু রাম। বাল্মীকি রামায়ণে শিশু রামকে আমরা দেখতে পাই না। এটি তুলসীদাসের আরোপ।বৈষ্ণবীয় ধ্যান-ধারনা ও অধ্যাত্ম রামায়ণের প্রভাবে মহাকবি তুলসীদাস শিশু রামের মূর্তি অঙ্কন করেছেন পরম মমতায়। শিশু রামই রামলালা। একালের নকল রামভক্তরা তুলসীদাসের রামলালাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, কিন্তু তুলসীদাসের ঐকান্তিক ভক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তখনকার কালের কাশীর গোঁড়া পণ্ডিতেরা যে তুলসীদাসের উপর অত্যাচার করেছেন ( ‘কাশীকা পণ্ডিতোঁ নে উনহে বড়া তঙ্গ কিয়া থা- গালি গলৌজ, ডাঁট-ফাটকার’—হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদী), আকবরের মন্ত্রী-সেনাপতি আবদুর রহিম খান-ই-খানখানা যে তুলসীদাসের পরম সুহৃদ ছিলেন, তুলসীদাস যে জাতপাত মানতেন না, তুলসীদাস যে ভিখ মেগে খেতেন এবং মসজিদে শুয়ে থাকতেন ( ‘মাঁগি কৈ খৈব, মসীতকো সৌইব’) সেসব কথা একালের উগ্র ভক্তরা হয় জানেন না, নাহয় জেনে না জানার ভান করেন।
বাবরি মসজিদের ভেতরে স্থাপন করা হল রামলালার মূর্তি আর ছড়িয়ে দেওয়া হল এই কথা যে এটাই রামের ‘জনমভূমি’। প্রধানমন্ত্রীর যে দৃঢ়তা প্রত্যাশিত ছিল, তা ধর্মনিরপেক্ষ জওহরলাল দেখাতে পারেন নি। হিন্দু-মুসলমানের আইনি যুদ্ধ শুরু হল। রামচন্দ্র প্রবেশ করলেন আদালতের অঙ্গনে। তারপরে রাজীব গান্ধী নতুন মাত্রা যোগ করলেন। প্রধান ফটকের তালা খুলে দেওয়া হল। রামভক্তরা প্রবেশ ও পুজোর অধিকার পেলেন। রাজীবের আগ্রহে দূরদর্শনে শুরু হল রামায়ণ সিরিয়াল। অনুঘটকের কাজ করল সেই সিরিয়াল। এরই সূত্র ধরে সারা ভারতে প্রসারিত হল রামভক্তিবাদ, শুধু তাই নয়, রাম হয়ে উঠলেন ‘হিন্দু’র নেতা ও নায়ক। সেই সূত্র ধরে রামজন্মভূমির দাবি জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। তারপরে ১৯৯০ সালে আদবানিজির রথযাত্রা, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর করসেবকরা ধ্বংস করল বাবরি মসজিদ ।
রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটল বিজেপির। আরও কয়েক বছর পরে নরেন্দ্র মোদি শপথ নিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। রামজন্মভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সেই প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। বিতর্কের কেন্দ্র ছিল যে ২.৭৭ একর জমি, সেটির অধিকার পেলেন রামচন্দ্র, যিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য রাজ্যসুখ ত্যাগ করে বনগমন করেছিলেন। এ বছর, ২০২০ সালের ৫ আগস্ট সেই জমিতে শিলান্যাস হল। রাম হলেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মুখ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)