সাম্প্রতিককালের পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ যে সংকট, তা হল মানুষের নিজেদের ভিতর ভেদাভেদ। মানুষ তো মানুষই। এরচেয়ে বড় আর কোনো পরিচয় মানুষের ন্েই। যেমন কবি নজরুল বলেন:
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদধর্মজাতি
মানুষকে মানুষ বলে মনে না করাই একরকম অমার্জনীয় অপরাধ ও চরম অসভ্রমতা৷ প্রেম ও ভালবাসাকে যিনি সর্বজীবের মধ্যে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমানভাবে বণ্টন করতে পারেন তিনিই হলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। যেমনটি করেছিলেন কাজী নজরুল।মানব প্রেমই হল ঈশ্বর প্রেম, মানব প্রেম ছাড়া ঈশ্বর প্রেম হতে পারে না। মানুষের মনে ব্যথা দেওয়া কারা শরীফ ও মন্দির ভাঙ্গার থেকেও বড় অপরাধ। তাই কবি বলেনঃ
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
নিত্যানন্দ প্রহৃত হয়েছেন, কলসির কানায় রক্ত ঝরেছে তার অঙ্গ থেকে, তবুও তিনি দুর্বৃত্ত জগাই মাধাইকে প্রেম বিতরন করা থেকে পিছিয়ে পড়েন নি। সিদ্ধার্থের সামনে একজন মুসলিম বালককে হিন্দুধর্মের কুয়ো থেকে জল তুলে পানকরার জন্য বেদম প্রহার করা হচ্ছিল সিদ্ধার্থ দেখতে পেয়ে বললেন আরে আপনারা থামুন সবার থেকে বড় পরিচয় হল সে যে একজন মানুষ!
“ সবার উপর মানুষ সত্য, তার উপরে কেও নাই”
এক আদম ও হাওয়া থেকে মানবজাতির সূচনা। জাতি ধর্মের বৈচিত্র একটা ফুলের বাগানের বৈচিত্রময় ফুলের ন্যায় যেখানে এক রকম ফুল সোভা পায় না। যেমন ইংরাজিতে বলা হয় It takes all sorts to make a worldঅর্থাৎ পৃথিবীর বুকে সর্ব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ থাকা দরকার। তাই কবিR. W. Emersonতাঁর বিখ্যাত কবিতাThe Mountain And The Squirrelমধ্যে বলেছেনঃ
But all sorts of things and weather
Must be taken in together
To make up a year.
অর্থাৎ এক বছরে যেমন একাধিক ঋতুর বৈচিত্র থাকে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, বসন্ত ও হেমন্তকাল ঠিক তেমনি এই ত্রিভুবনে জাতি ধর্মের বৈচিত্র থাকবে। প্রকৃত মানুষ তিনিই যিনি জাতি ধর্মের ভেদাভেদর ঊর্ধ্বে উঠে সকলের জন্য কাজ করতে পারবেন। যেমনটি করে ও গেয়ে গিয়েছন কাজী নজরুলঃ
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান ।
মুসলিম তার নয়ন-মনি, হিন্দু তাহার প্রাণ ।
কবি আরও বলেন:
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
ধর্ম ও সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে ‘মানুষ’ পরিচয়কেই মুখ্য করতে গিয়ে নজরুল সবাইকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। হিন্দু বা মুসলিম অথবা অন্য কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ই যে আমাদের কাছে প্রধান হওয়া উচিত, নজরুল তা বলেছেন। তিনি যে সময় কবিতা লিখেছেন, সে সময় ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভেদ-রাজনীতি প্রকট হতে থাকে। প্রধান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশদের বিভেদনীতির কারণে। এসব দেখে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করলেন‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবি বলেনঃ
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”
জাতি ধর্ম নিয়ে যারা ভেদাভেদ করেন তাদের জন্য কবি বলেন:
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,
(তোর) পৈতে টিকি-টুপি টোপর সব সেথা ভাই এক্কাকার।
কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় মানুষ তার অভীষ্ট সাধনার কথা ভুলে গিয়ে আত্মহননে লিপ্ত। সাদা মানুষ লড়ায় করছে কালো মানুষের বিরুদ্ধে, এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে হত্যা করে পৈশাচিক পাশবিক বৃত্তি চরিতার্থ করছে এই ভাবে মানুষের সংকট দিনদিন বড়েই চলেছে।
জাতিগত বিদ্বেষ বা বর্ণবাদ তথা বর্ণবৈষম্য এমন এক বিষাক্ত মতবাদ যা যুগে যুগে মানব-সভ্যতা এবং মানব-ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আধুনিক সভ্যযুগও এই কলঙ্কজনক মতবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। লজ্জাজনক হলেও এটা এক জ্বলন্ত বাস্তবতা।
আজকের পৃথিবীতে যে চেতনার বড়ই সংকট তার নাম মানবতা। আজকের বিশ্বে মানবতা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর অনেক উন্নতি করেছে, আমরা অনেক সভ্য হয়েছি, বেশ ভূষায়, বিল্ডিং বালাখানায় যতটা উন্নতি করেছি মানবতা ততটাই তলিয়ে গিয়েছে।
সারা পৃথিবীতে যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত, পরমতসহিষ্ণুতা হিংসার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, সেখানে নজরুল ইসলামের গাহি সাম্যের গান আমাদের আদর্শ হওয়া দরকার। জীবনে সমস্ত কিছু নস্যাৎ হওয়ার পরেও আশার আলো ধুকধুক করে হলেও জ্বলতেই থাকে সেই দিকে আশাবাদী হয়ে বলতে চাই আমার লেখনীর শেষ কথা হোক “ সবার উপর মানুষ সত্য, তার উপরে কেও নাই”।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct