ইসলামিক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহররম। পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত চারটি পবিত্রতম মাসের (মুহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্জ) মধ্যে এটি অন্যতম। 'মুহররম' একটি আরবী শব্দ যার অর্থ 'পবিত্র', 'সম্মানিত', 'তাৎপর্যপূর্ন' বা 'গুরুত্বপূর্ন'। ইসলামিক ইতিহাস অনুযায়ী মুহররম মাসেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ও পবিত্র কাজ হয়েছিল তাই এই মাসের এমন নামকরন। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকেই মুহররম মাস পবিত্র হিসাবে গন্য হয়ে আসছে। ইসলামিক সময়সূচী একটি চন্দ্র পঞ্জি বা লুনার ক্যালেন্ডার দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং এই বর্ষপঞ্জির মাসগুলো শুরু হয় যখন নতুন কাস্তে আকৃতির চাঁদের দৃশ্যমান হয়। যেহেতু ইসলামি চন্দ্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জিটির বছর পূর্ণ হয় সৌর পঞ্জিকা অপেক্ষা ১১- ১২ দিন পূর্বেই, ফলে প্রতি বছর মুহররম মাসের শুরুর দিনটি প্রচলিত সৌরভিত্তিক গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সাথে একই দিনে মেলে না। এবছর মুহররম মাসের শুরু হয় ২০ শে আগষ্ট ও ৩০ শে আগষ্ট হল মুহররম মাসের দশম দিন। মুহররমের এই দশম দিন ইসলামিক মতাদর্শানুযায়ী বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। আরবী 'আশারা' শব্দ থেকে আশুরার উৎপত্তি। 'আশারা' মানে 'দশ', আর আশারাকেই বিশেষ সম্মানসহকারে ‘আশুরা’ বলা হয় বলে ধারণা করা হয়। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু থেকেই ১০ই মুহররম তথা আশুরার একটি বিশেষ ভুমিকা পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। এ মাসে রয়েছে অনেক বিজয় আর গৌরবমাখা ঐতিহ্যের স্মৃতি। ইসলামিক মতাদর্শে সৃষ্টির আদি জীব আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এই ১০ই মুহররম। আবার এই দিনেই আদমকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। আশুরাতেই আদম কে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল। হাওয়া এর সাথে আদম পুনরায় সাক্ষাত হয় এই ১০ই মুহররম। আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে মুহররম মাসেই। চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মাহাসাগর সৃষ্টি করা হয় এই মুহররম মাসেই। আশুরাতেই জন্ম গ্রহণ করেন ইব্রাহীম নবী। কথিত আছে এই দিনেই ইউনূস নবী মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এই দিবসে হযরত মূসা নবী তাঁর অনুসারীদের কে নিয়ে ১২টি অলৌকিক ভাবে তৈরী হওয়া রাস্তা দিয়ে নীল নদ পার হন এবং ফেরাউন তাঁকে তাড়া করতে গিয়ে নদীতে স্ব-দলবলে ডুবে মারা যায়। আশুরাতেই হযরত মূসা নবী এবং আল্লাহর মধ্যে কথোপকথোন হয়েছিল। হযরত মূসা নবী এর উপর চারটি আদি গ্রন্থের মধ্যে তৌরাত কিতাব নাজিল হয়েছিল এই আশুরাতেই। আইয়ুব নবী দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর সুস্থ হয়ে উঠেন এই আশুরাতেই।সোলায়মান নবী বাদশাহী লাভ করেন আশুরাতেই। ইউসুফ নবী তাঁর পিতা ইয়াকুব নবীর সাথে মিলিত হন এই আশুরাতেই। নূহ নবীর জাহাজ চল্লিশ দিন মহা প্লাবনের পর পাহাড়ের কিনারে ভিড়ে আশুরাতেই। এতো কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনার সাক্ষী এই মুহররম মাস। অথচ যুগের তালে, হুজুগের হাওয়ায় সেই সব পবিত্র ঘটনা গুলো ধীরেধীরে ম্লান হয়ে পড়েছে। বিকৃত চিন্তাভাবনা গুলো যেন দৃঢ় ভাবে মননে গেঁথে বসেছে। মুহররম মাস এলেই মস্তিষ্কে কারবালার যুদ্ধের কথা উদ্ভাষিত হয়। মনে পড়ে যায় রাস্তায় রাস্তায় ঘৃন্য অস্ত্র খেলার কথা। ভেষে ওঠে রক্তাক্ত শরীরের দৃশ্য। কানে বাজে 'হায় হাসান,হায় হোসেন' ধ্বনি। কিন্তু এই অপসংস্কৃতি যে ইসলাম তথা আধুনিক মতাদর্শের বহি:র্ভুত তা কিছু অজ্ঞশ্রেনীর মানুষের কর্নকুহরে আজও প্রবেশ করেনি। তবে শুধু অজ্ঞতা নাকি হুজুগে এই ভ্রান্ত ধারনায় তাল মিলিয়ে চলেছে তা এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন তুলে ধরে! অবশ্য অজ্ঞতাই তো হুজুগে ছুটিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। ৬৮০ সালে কারবালার ঘটনার ভ্রান্ত ধারনা পুষে অথবা ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত না হয়ে অনেকে এই অসামাজিক ও অইসলামিক কাজ করে চলেছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের উপকণ্ঠে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক নগর অবস্থিত ছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই কারবালা নামক স্থানে। ৬৮০ সালে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইয়াজিদ মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা বলে নিজেকে দাবি করেন। অথচ ইয়াজিদ প্রকৃত ইসলাম মতাদর্শী ছিলেন না। সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মধ্যপানকে সে বৈধ ঘোষণা করেছিল। এছাড়াও বিভিন্ন অসামাজিক কাজ গুলোকে বৈধ করে ইসলামের অবমাননা করতে শুরু করেছিল। শাসক হিসেবে সে ছিল স্বৈরাচারী, অত্যাচারী। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অধিকাংশ লোকজন বাধ্য হয়ে তাঁর আনুগত্য মেনে নিলেও হজরত হুসাইন ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকার করেন। কারণ তাঁর মধ্যে ইসলামিক চিন্তাধারা প্রখর ছিল এবং এই চিন্তাধারার অবমাননা কোন সুস্থ সভ্য মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। ফলে ইয়াজিদের সঙ্গে হজরত হুসাইনের মত বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। পরে কূফাবাসীর আমন্ত্রন ও মূল গতিপথ থেকে হারিয়ে যাওয়া ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর কিছু সহপাঠী ও পরিবার নিয়ে কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় উমর ইবনে সা’দ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারাবালায় প্রবেশ করে। বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। অবশেষে এই কারবালা প্রান্তে হুসেইন ও তাঁর সহপাঠীদের শহিদ হতে হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনা নিছক গল্প নয়। এই যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, সত্যের প্রতিষ্ঠায় রুখে দাঁড়ানো, তৎকালীন সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানো, স্রোতের বিপরীতে হেঁটে সত্য প্রতিষ্ঠায় রুখে দাঁড়ানোর লড়াই। এটাই ছিল প্রকৃত ইসলামিক জিহাদ। জিহাদ শব্দের অর্থ হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা,খারাপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সুতরাং এই ঘটনার শিক্ষনীয় বিষয় হল সমাজের খারাপ কাজের বিরুদ্ধে,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সকলের কর্তব্য। অথচ বর্তমানে এই কারবালার স্মৃতি রোমন্থন করতে রাস্তায় নেমে শরীরি অত্যাচার করে চলছে কিছু শ্রেণীর মানুষ। এই ঘৃন্য কাজকে কখনই ইসলাম বৈধ্যতা দেয়নি। বরং এগুলো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি ইসলামের চরম পরিপন্থী। এখানেই প্রকৃত ইসলামের সত্যতা ও বৈধ্যতা বিচার্য্য। ইসলাম যেটাকে বৈধতা দেয়নি সেটা সমাজের জন্য যে কখনই সুফল হতে পারেনা তা প্রমান করে বর্তমান ঘটনা গুলো। বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু শ্রেনীর মানুষ উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে যে সাম্প্রদায়ীক মেরুকরনের চেষ্টা করছে তারা এই মুহররমকে হাতিয়ার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে রামনবমীর নামে রাস্তায় অস্ত্র মিছিল অন্যদিকে মুহররমের নামে অস্ত্র খেলা দুটোই দু-ধর্মের পরিপন্থী। আর এই দুটো অসামাজিক কাজকে হাতিয়ার করে এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল তাদের ফায়দা তুলতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। সেই পালে হাওয়া লাগাচ্ছে কিছু অজ্ঞ শ্রেনীর মানুষ যারা ধর্মের মূলনীতি না জেনে হুজুগে তাল মিলিয়ে চলে। সাম্প্রতিক এক মার্কিন রিপোর্ট বলছে-ভারতের সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার নিরাপত্তা সুনিশ্চিতই ছিল। গত কয়েক দশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদই ভারতে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে। আর তা নানা ভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ধর্মের নামে শুরু হয়েছে দমনপীড়ন, হিংসা,ঘৃন্য রাজনীতি। উত্তরোত্তর বাড়ছে গোরক্ষার নামে হিংসা। এই সবই ভারতে ধর্মের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হয়ে উঠছে। এতসব উদাহরন আমাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও ভাবতে হবে নিজেরাই জেনে বুঝে খাল কেটে কুমির আনছিনা তো? নিজেরাই কু-রাজনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছি না তো? বেশ কিছু জায়গায় কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সচেতন মনভাবনায় এই অসামাজিক কাজের পরিবর্তন লক্ষনীয়। অনেক মুহররম কমিটির উদ্যোগে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হচ্ছে এখন। তারা বুঝেছে অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করে রক্ত নষ্ট করার মধ্যে কোন সুফল নেই। সেই রক্ত কোন মুমূর্ষু রোগীর কাজে ব্যবহার করার জন্য তারা রক্তদানের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এই সিদ্ধান্তকে অবশ্যই কুর্নিশ জানাতেই হবে। এমন চিন্তাভাবনা সকলের মননে জেগে উঠুক এমটি কাম্য। ভ্রান্ত ধারণার অবসান হোক। মুহররম হয়ে উঠুক সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দঁড়ানোর মাধ্যম। এই উৎসব হয়ে উঠুক সমাজের কল্যাণে কাজে লাগার মাধ্যম। এই দিনটি হয়ে উঠুক ধর্মান্ধতা, অসিহষ্ণুতা,কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভেদাভেদ, ভ্রান্ত মতাদর্শ ভুলে এই দিনটি হয়ে উঠুক অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দিন। অস্ত্র ফেলে হাতে উঠুক শান্তির বাণী।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct