বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। প্রথম কিস্তি।
ময়মনসিংহের ভূমিপুত্র কেদারনাথ মজুমদার । তাঁর অসামান্য গবেষণাগ্রন্থ ‘রামায়ণী সমাজ’ । সেই বই সম্পাদনা করতে গিয়ে অনেক নতুন দিক উদ্ভাসিত হয় আমার কাছে । রামায়ণকথা যে বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিল, সে কথা ভাসাভাসাভাবে জানতাম । কেদারনাথের বই পড়ে তার বিস্তৃত পরিচয় জানতে পারি । নানা দেশে রামায়ণকথার নানা রূপান্তর হয়েছে । ঐতিহাসিক এ কে রামানুজমের লেখাতেও তার পরিচয় পাওয়া যায় । তিনি বলেছেন : যত রাম তত রামায়ণ ।
কেদারনাথের সূত্র ধরে আমি রামায়ণের নানা দিক নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করি । রামকথাকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলে আমার মনে হয় না । তিন/চার হাজার বছর আগে মানুষের কল্পনাশক্তি এত উর্বর ছিল না । হোমরের ‘ইলিয়াডে’র বস্তুভিত্তি আবিষ্কার করেছিলেন শ্লীম্যান । রামায়ণের বস্তুভিত্তি আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন ছিল যথাযথ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের । খনন হয়েছে, কিন্তু সেখানেও পড়েছে রাজনীতির ছায়া । স্বাধীনতার পরেও এ দেশে মুক্ত জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নি ।
রামকে ইতিহাসের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করলে তাঁর অবতারত্ব অস্বীকার করতে হয় । বাল্মীকির রামায়ণে রাম বিষ্ণুর অবতার নন । তিনি ‘পুরুষোত্তম’ । রামের উপর অবতারত্বের আরোপ করেছেন মধ্যযুগের প্রতিভাবান কবি তুলসীদাস । তাঁর ‘রামচরিতমানসে’ রাম ভগবান বিষ্ণুর অবতার । তুলসীদাস প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘অধ্যাত্ম রামায়ণে’র দ্বারা । তুলসীদাস বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রের চর্চা করেন । তার ফলে কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুকরণে তিনি রামের বাল্যলীলার বর্ণনা করেছেন । ‘রামুকা গোলাম’ তুলসীদাস রামভক্তির একটা নতুন স্রোত প্রবাহিত করেন । বঙ্গদেশে কবি কৃত্তিবাসও সেই ভক্তির রস প্রবাহিত করে গেছেন ।
রামায়ণে অযোধ্যা রামের জন্মভূমি । সেই অযোধ্যা কোথায় ? অযোধ্যা যে ভারতের বাইরে অন্য কোথাও, সেরকম দু-একটি লেখা আমাদের নজরে এসেছে । সেসব বাদ দিয়ে যদি ধরে নিই যে অযোধ্যা ভারতেই অবস্থিত, তাহলেও প্রশ্ন থাকবে অযোধ্যার ঠিক কোথা্য় জন্মগ্রহণ করেন রামচন্দ্র । সম্প্রতি মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিকে ‘রাম জন্মভূমি’ বলে নির্দেশ করেছেন এক সম্প্রদায়ের ‘বিশ্বাস’ অনুযায়ী । যেখানে বিশ্বাসের প্রশ্ন সেখানে আর তর্ক চলে না । বিশ্বাসে মিলায় বস্তু । এরকম বিশ্বাস তো অন্য সম্প্রদায়েরও থাকতে পারে । তাই মহামান্য আদালতের রায় পরবর্তীকালে নতুন বিতর্ক ও অশান্তির উৎস হতে পারে । মার্কসবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আইন-আদালত-পুলিশ কেউ নিরপেক্ষ নন ।
রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে মহামান্য আদালতের এই রায় । রামজন্মভূমি আন্দোলনের ধারক ও বাহকরা তখন দিল্লির মসনদে । রায়টা তাঁদের স্বার্থ পূর্ণ করেছে । কাকতালীয়ভাবে সেটা ঘটেছে কিনা আমাদের জানা নেই ।
সে যাই হোক, এক অশোভন রাজনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে পড়লেন আমাদের দেশের এক প্রাচীন, গৌরবময়, স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্যের সুভদ্র, স্নিগ্ধ, মহিমামণ্ডিত নায়ক । তাঁকে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে । এটা বিষম বেদনার । শুধু তাই ন্য়, সামনে আনা হচ্ছে রামচন্দ্রের যোদ্ধৃরূপ । প্রকারান্তরে বলা হচ্ছে রাম অসুর বধ করেছিলেন, তাঁর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে অ-হিন্দুরূপ অসুরদের বধ বা বিতাড়িত করতে হবে । এসব কথার কোন ইঙ্গিত বাল্মীকি বা তুলসীদাস বা কৃত্তিবাসে নেই ।
(প্রতিবেদনটিতে ব্যবহৃত ছবিটি ১৯০০ সালের প্রথম দিকের বাবরি মসজিদ। সৌজন্যে: দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি বোর্ড)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct