আজ ২১ আগস্ট তাঁর ১৪তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণে লালকেল্লায় যাঁর বাজানো সানাইয়ের সাথে সাথে শুরু হয়েছিল স্বাধীন ভারতের পথচলা, ১৯৫০ সালে প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসেও যিনি লালকেল্লাতে বসে ফুঁ দিয়েছিলেন ধুতুরা ফুলের মতো দেখতে বাদ্যযন্ত্রটিতে; তিনি সানাই সম্রাট ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালে, পূর্বপুরুষের বাস বিহার হলেও ১৯৩৬ সালে উত্তরপ্রদেশের বারানসীতে একটি বাড়ি কিনে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন পিতা আলী বকস বিলায়ত। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে বিসমিল্লাহ খান সানাই’য়ের মতো একটি সাধারণ লোকবাদ্যযন্ত্রকে ভারতীয় সঙ্গীতের মূলমঞ্চে নিয়ে আসেন এবং বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন। আজীবন শুধু সানাইয়ে সুর তোলার কায়দাতেই তিনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, ইরান সহ পৃথিবীর প্রায় সবদেশেরই রাজধানী শহরে হৃদস্পন্দন জাগিয়েছিলেন। পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি দর্শক তাঁর এক ফুঁ-তেই হয়েছে ভক্ত; কখনো ‘মায়েস্ত্রো চয়েস’ দিয়ে শ্রোতার প্রাণে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছেন আবার কখনো লন্ডনের ‘কুইন এলিজাবেথ হল’ –এ বুকভরা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। আর সঙ্গীত জগতে তাঁর অবদানকে সেলাম জানিয়ে একেএকে দেশের সর্বোচ্চ চার বেসামরিক পুরস্কার-ই (পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, ও ভারতরত্ন) প্রদান করেছে ভারত সরকার। সঙ্গীতের সূত্র ধরে তিনি শিল্পের মঞ্চ ভাগ করেছেন পণ্ডিত রবিশংকর থেকে ওস্তাদ জাকির হোসেন এমনকি অস্কার বিজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও।
rn
আজও কোটি কোটি প্রাণে বেঁচে থাকা এই মানুষটি বাস্তবে ছিলেন নম্র স্বভাবের এবং মিতব্যয়ী। আলোর রোশনাইয়ে ভরা পৃথিবীতে তাঁর নাম উজ্জ্বল হলেও তিনি ভালোবাসতেন একেবারে সাধারণ গোছের জীবনযাপন করতে। তিনি রিকশায় চড়তে ভালোবাসতেন, এবং প্রতিদিন পায়ে হেঁটে গঙ্গার ধারে বসে সানাই রেওয়াজ ছিল তাঁর অভ্যেস। একবার আমেরিকা তাঁকে নাগরিকত্বের প্রস্তাব দিলে তিনি একবাক্যে নাকচ করে দেন এবং বলেন- “আমেরিকা কি তাঁকে একটা গঙ্গা উপহার দিতে পারবে সেখানে?” গঙ্গা-পাড়ের সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চাতেই তিনি জীবনের সার্থকতা অনুভব করতেন।
rn
দুঃখের বিষয় হল গোটা পৃথিবী জুড়ে যাঁর এত সুনাম, আজীবন যিনি এতকিছু অর্জন করেছেন, আজও যাঁর নাম শুনলে বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের মাথানত হয়ে আসে; সেই মানুষটি কখনো নিজের পরিবার থেকেই যোগ্য কদর পান নি। ২০১৭ সালে তাঁর নাতি নাজরে হাসান মাত্র ১৭০০০ টাকার বিনিময়ে তাঁর রেখে যাওয়া সানাই বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এমনকি আজীবন তিনি হাদহা সরাইয়ের ভিক্ষমশাহ লেনের যে প্রিয় বাড়িতে বসে রেওয়াজ করতেন, তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ভক্তদের অনুরোধ সত্ত্বেও সেটিকে মিউজিয়াম হিসাবে সংরক্ষিত না করে পরিবারের মদতে গত ১২ আগস্ট বাড়িটিকে ‘কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সে’ রূপান্তরের জন্য বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারও এমন মর্মান্তিক বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, যা সত্যিই আশ্চর্যের।
rn
স্বয়ং নিজের পরিবার এই মানুষটির উচ্চতা না-বুঝতে পারলেও বুঝেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ভক্ত, বুঝেছিল সমগ্র ভারতবাসীও; তাই ২০০৬ সালের ২১শে আগস্ট তাঁর মৃত্যুতে ভারত সরকার একদিনব্যাপী জাতীয় শোক পালন করে। দৈহিক মৃত্যু হলেও তিনি আজও সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন আগামী দিনেও…
rn
(লেখক গবেষক, বাংলা শাখা, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়)
rn
rn
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct