প্রয়োজনের তাগিদেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে যুগ, বছর, মাস, পক্ষ, সপ্তাহ ইত্যাদি গণনার প্রথা প্রচলিত হয়। সেকারণেই দেশে দেশে বিভিন্ন সাল বা অব্দের প্রচলন লক্ষ করা যায়। আজ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে, বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় যত সন ব্যবহার করছে সবগুলোই ১২ মাসের। বাংলা সন-মাসও এর বাইরে নয়। তবে আরবি নববর্ষ শুরু হয়ে গেছে। ১ মুহাররম শুরু আরবি বর্ষ হিজরির ১৪৪২।
দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন অনুসরণ করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে চান্দ্র হিজরি বর্ষপঞ্জি এবং সৌর বর্ষপঞ্জিকে সমন্বিত করে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন। আকবরের দেয়া আজ্ঞা পালন করে সিরাজীর চিন্তা-চেতনায় যে বর্ষপঞ্জি তৈরি হয় তা শুরুতে ফসলি সন হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে তা বাংলা সন হিসেবে পরিগণিত হয়। সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি ৯৯২ হিজরি বা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ ঈসায়ি সনের ১১ এপ্রিল (হিজরি ৯৬৩) মসনদে বসেন। সিরাজী ৯৬৩ হিজরি=৯৬৩ বাংলা সন সমন্বয় করে গণনা শুরু করেন। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণকে স্মরণীয় রাখার জন্য তিনি হিজরি ৯৬৩-কে ভিত্তি করে বাংলা ৯৬৩ সন চালু করেন। এসব দিক বিবেচনায় বলা যায়, বাংলা সনের শুরু হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হিজরতের সন ৬২২ খ্রিস্টাব্দ, আর তার নবযাত্রা ৯৬৩ হিজরিতে। আমির ফতেহ উল্লাহ বাংলা সন প্রবর্তনের সময় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরটি ঠিক রাখেন। কিন্তু বছর শুরু করেন ওই সময়ে হিজরি সনের বছর শুরুর দিন দিয়ে। ওই বছর আরবি মহররম মাস ছিল গ্রীষ্মকালে। সেই বিবেচনায় ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বৈশাখকেই প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরা একইভাবে দেখতে পাই, খলিফা উমর (রা.) ৬৩৮ ঈসায়ি সনে হিজরি পঞ্জিকা গণনার আদেশ দেন, হিজরতের প্রকৃত বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এমনকি হিজরতের প্রকৃত দিন অনুযায়ী বছর গণনার শুরু না করে চলতি আরবি মাসের প্রথম দিন ১ মহরম থেকে ওই হিজরি সনের প্রারম্ভ ধরা হয়েছিল। যারা বলেন, সিরাজী কর্তৃক আকবরের রাজ্যাভিষেক ১৪ ফেব্রুয়ারিকে কেন বর্ষ শুরুর দিন বিবেচনায় আনা হলো না, তাদেরকে ইতিহাসের এ সত্যটি মেনে নিতে হবে। বঙ্গাব্দ শব্দটি সেকুলাররা ইদানীং ব্যবহার শুরু করেছে। অতীতে এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। বাংলা সন বা বাংলা সালই সুপ্রসিদ্ধ। আর সন আরবি, সাল ফারসি শব্দ। তাই বাংলা সনও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিতে বঙ্গাব্দকে যবনে নৃপতে শকাব্দ বলা হয়েছে, রাম গোপাল দাসের রসকল্প বল্লীর পুঁথিতেও বঙ্গাব্দকে ‘যাবনী বৎসর’ বলা হয়েছে। এ তথ্য থেকে উপর্যুক্ত বিশ্বাসটি আরও মজবুত হয়। হিজরি বা আরবি ক্যালেন্ডার থেকেই বাংলা সনের উদ্ভব। শামসুজ্জামান খান বলেন, একে বাংলা সন বা সাল বলা হয়। এই সন ও সাল হলো যথাক্রমে আরবি ও ফারসি শব্দ। এটা নির্দেশ করছে এগুলো মুসলিম রাজা বা সুলতান কর্তৃক বাংলায় পরিচিত করানো হয়। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য বাংলা সাল-তারিখ সম্বন্ধে একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর মতে, সুলতান হোসেন শাহের সময় বাংলা সন প্রচলিত হয়। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণার দাবি রাখে।
তবে বিশিষ্ট লেখক সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বঙ্গাব্দের উৎস’ শীর্ষক কিতাবে নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, শশাঙ্কই আসলে বাংলা সনের প্রবর্তক এবং রাজত্বকালের ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল সোমবার বৈশাখ বঙ্গাব্দের আরম্ভ। ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায়ও একই মত পোষণ করেন। এই মত সম্পর্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে, শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, অন্তত ওই সময়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন, এর কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই যদিও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে তার রাজত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে আছে।’ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব ৫২৫ হতে ৬০০ অব্দের মধ্যে বাংলায় রাজত্ব করেন। আরেকটি তথ্যে জানা যায়, দাক্ষিণাত্যের চাণক্যরাজ কীর্তিবর্মণ ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষপাদে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধ জয় করেন। তাই দেখা যায়, সপ্তম শতকের পূর্বে শশাঙ্কের শাসনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাজত্বের প্রমাণ না থাকলে তিনি কীভাবে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করতে পারেন?
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, বঙ্গরাজ্য শশাঙ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কি না নিশ্চিত বলা যায় না। খুব সম্ভবত মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি গৌড়, মগধ, দন্ডভুক্তি, উৎকর্ণ ও কোঙ্গোদের অধিপতি ছিলেন।
ইলিয়াস শাহ ও পরবর্তী মুসলিম শাসকরা খণ্ড-বিখণ্ড ও পরস্পর কলহ- কোন্দলপূর্ণ একটি বিরাট এলাকা এবং তার মধ্যে বসবাসকারী দল উপদলে, ধর্মীয় বেড়াজালে বিভক্ত লোকদের একটি জনসমষ্টিকে এক দেশ, এক শাসন, এক পঞ্জিকা, এক জাতি তথা বাঙালি পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম আমলের ‘বঙ্গ’ পরিচয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বঙ্গ এ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যদিও দেশ, ভাষা বা জাতি কোনো অর্থেই বাঙালা ও বাঙালি নামের স্বীকৃতি দিতে চায়নি হিন্দুরা। ১৮ শতক অবধি তারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গকে গৌড় দেশ বা গৌড় বলে এসেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, হিন্দু লেখক-বুদ্ধিজীবীরা মৌর্য যুগ থেকে শুরু করে ১৮ শতক অবধি পশ্চিম বাংলাকে গৌড়দেশ বা গৌড় বলে এসেছে, নিজেদের গৌড়িয়া, গৌড়জন, গৌড়ের লোক, গৌড়াই প্রভৃতি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে এবং এ দেশের বাঙলা বা বঙ্গাল নাম কখনও মুখে আনেনি বা কাগজে লেখেনি। ওই গৌড়ের অধিবাসীদেরও তারা কখনও বাঙালি বলেননি। গৌড়েশ্বর, গৌড়দেশবাসী, গৌড় প্রভৃতির বদলে বাংলাদেশবাসী, বাঙালি, বাঙালেশ্বর, বাঙালা, বাঙালিশ্বর তাদের কলমে, মননে, স্মরণে, জবানে, লেখনে অনুপস্থিত। কৃত্তিবাসের তরজমাকৃত রামায়ণে গৌড়েশ্বর বা গৌড় নাম হাজির কিন্তু বাংলা, বাঙালা, বাঙ্গালা গরহাজির। কবি বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতে গৌড় শব্দ হাজির, কিন্তু বাঙলা নেই।
সামন্ত পুরোহিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রেণি মুসলমানি পঞ্জিকা বা বাঙ্গালা সনও গ্রহণ করেনি। তার বদলে ব্যবহার করেছে শক, সন বা শকাব্দ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct