স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনীতির মঞ্চে, শিক্ষা- সংস্কৃতির অঙ্গনে সমাজিক স্তরে বহু ক্ষেত্রে দিশারীর ভূমিকা ও কাণ্ডারির দায়িত্ব পালন করেছেন বহু মানুষ। ১৯৪৭ সাল, ভারতীয় ভূখণ্ডের এক গৌরবগাথা ইতিহাস, যা বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে লাখো মানুষের আত্মত্যাগ, হাজারো মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত্ব সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীগন যাঁরা নিজেদের ভূমিকার যথাযত রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছেন ও ইতিহাসের পাতায় সম্মানীয় স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন ও দেশবাসী যাদের নাম নিতে গর্ভবোধ করেন, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। যেমন ক্ষুদিরাম বসু, মীর নিসার আলি (তিতুমির), প্রফুল্লচাকী, ভগত গিং, সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরূ, মাতঙ্গিনী হাজরা আরও অনেকে।
এছাড়া ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাংলার ইসলামী বিদ্বান তথা আলেম সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড রয়েছে।
সেই সমস্ত বীরপুরুষ যারা জাতির জন্য ত্যাগ তিতিক্ষা, নিরলস ও নিখাদ সেবা এমনকি জান উৎসর্গ করেও তাঁরা ইতিহাসের পাতায় এক টুকরো স্থান পেতে ব্যর্থ হয়েছেন যদিও তাদের হৃদয় সিঞ্চিত তাজা রক্ত দেওয়ার কারণে আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করছি। এই ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এক সুদীর্ঘ তালিকা আছে যা অনেক পাঠকের কাছে আজও অজানা। আর স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৭৩ বছর পর সেটিকে অজ্ঞতার গহ্বীন খাদ থেকে মন্থন করে ইতিহাস প্রেমীদের কাছে তুলে ধরা একটা দুঃসাহসের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
যাই হোক, উলামারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছ থেকেই দেশপ্রেমের শিক্ষা পেয়েছেন। বিশেষত তাঁর মাতৃভূমি থেকে হিজরত করার সময় ব্যথাতুর হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে বারংবার মক্কা নগরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন “ও প্রিয় মাতৃভূমি! আমি এ প্রিয় স্থান ছেড়ে কখনোই যেতাম না যদি মক্কার অধিবাসীরা আমাকে এইভাবে বার করে না দিত”। মাতৃভূমির প্রতি এমন গভীর ভালোবাসা উলামাগনকে রণক্ষেত্রে তাজা রক্ত দিতে, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে, জেলের কঠিন অত্যাচার সহ্য করতে অতি সহজ করে দিয়েছিল। তবে দুঃখের বিষয় যাদের পূর্বপুরুষরা তাজা রক্ত দিয়ে ইতিহাস রচনা করে গিয়েছেন তাদেরকেই বাল হয় দেশপ্রেমের প্রমাণ দাও।
স্বাধীনতা আন্দোলনে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর ন্যায় বঙ্গীয় উলামাগনও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন যেমন প্যান-ইসলামী আন্দোলন, খিলাফাত আন্দোলন, কৃষক-প্রজা আন্দোলন। খিলাফত আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনের মত আন্দোলনগুলিতে শুধু অংশগ্রহণই নয় বরং অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছন এবং সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর তুলনায় তাঁরা অধিকতর কারানির্যাতন ভোগ করেছেন। এছাড়া একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য –
ফরায়েযী আন্দোলন:- এই আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তউল্লাহ। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ধর্মীয় সংস্কার থাকলেও পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন বহুমুখী কর্মকাণ্ড চালায় এবং কালক্রমে সমগ্র পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ফরায়েযী আন্দোলন ছিল বাংলা তথা উপমহাদেশের সর্বপ্রথম সক্রিয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা হাজী শরীয়তউল্লাহ এই উপমহাদেশকে ‘দারুল হরব’ তথা যুদ্ধের স্থান মনে করতেন। এই আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকে ১৯৪৭ সালে পর্যন্ত ১৩০ বছর যাবৎ এর নেতৃত্বে ছিলেন উঁচু মানের বিজ্ঞ আলেম ও পীর মাশায়েখগণ।
বাঁশের কেল্লা:- তিতুমীর সাইয়িদ মীর নিসার আলী (১৭৮২-১৮৩১) স্থানীয় জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন কুরআনের হাফেজ, বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ এবং আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী। প্রাথমিক পর্যায়ে এই আন্দোলনের লক্ষ্য মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের আদেশ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা হলেও পরবর্তী কালে এটি স্বাধীনতা আন্দোলন হিসাবেই গড়ে ওঠে।
তিতুমীর এক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন। তাদের লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তিতুমীর নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। অচিরেই তিনি চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিপুল সংখ্যক আলেমগন মুজাহিদ হিসাবে তাঁর বাহিনীতে যোগ দেন।
আঞ্জুমান ওয়াজিন:- হুগলির ফুরফুরার পীর সাহেব মওলানা আবুবকর সিদ্দিক রহ. (১৮৫৯-১৯৩৯), মৌলবি ওয়াহেদ হোসাইন এবং মুন্সী শেখ আব্দুর রহিম কর্তৃক ১৯১১ সালে কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আঞ্জুমান সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চলে বহু সভা ও মিছিল করে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।
আঞ্জুমান উলামা-ই-বাঙ্গালা:- কলকাতায় ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত উলামাদের একটি সংগঠন। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ইসলাম প্রচার, ইসলামি শিক্ষার প্রসার, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম সমাজের সংস্কার সাধন। এই আঞ্জুমানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা মুহম্মদ
আবদুল্লাহিল বাকী ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯২১ সাল পর্যন্ত আঞ্জুমান কর্মকান্ড পরিচালনা করে। আঞ্জুমান খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯২১ সালে জমিয়াতে বাংলার সঙ্গে একীভূত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম যুক্ত হয় ।
খেলাফাত আন্দোলনকে সক্রিয় করে তোলার জন্য যে সমস্ত আলেমগন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী, মাওলানা আব্দুর রশীদ, মাওলানা শামসুদ্দীন আহমাদ, মাওলানা আফসার উদ্দীন আহমাদ, মাওলানা দীন মুহাম্মাদ খান, মাওলানা আব্দুর রয়ুফ দানাপুরী, আল্লামা রাগিব আহসান প্রমুখ।
কৃষক আন্দোলনেও আলেমগনের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, এ. কে. ফজলুল হক, মৌলবী রজীবুদ্দীন তরফদার, মাওলানা ইদ্রীস আলী, আহমাদ আলী আকাবুলী, মাওলানা আকরম খাঁ, মৌলবী শামসুদ্দীন আহমাদ, মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী প্রমুখ এই আন্দোলনে গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের উলামাদের মধ্যে যাঁদের নাম চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে তাঁরা হলেন :-
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আগা মঈদুল ইসলাম, মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকী, মাওলানা মোহাম্মাদ রুহুল আমিন, মাওলানা আব্দুল জাব্বার ওহীদী, মাওলানা হাকীম আব্দুর রউফ দানাপুরী, মাওলানা আজাদ সুবহানী, মাওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ, মাওলানা আল্লামা বাগিব আহসান, মাওলানা আব্দুল হাই সিদ্দিকী, মাওলানা লেয়াকত হোসেন, এ. কে. ফজলুল হক, মৌলবী রজীবুদ্দীন তরফদার, মাওলানা ইদ্রীস আলী, আহমাদ আলী আকাবুলী, মৌলবী শামসুদ্দীন আহমাদ, মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী প্রমুখ।
যাই হোক, এভাবে উপমহাদেশের আলেম সমাজ বহু ত্যাগ ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যান। অতঃপর ১৯৪৭ সালে ভারত দীর্ঘ দু’শো বছরের গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্তি পায়। আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা দেশবাসী যদি ভুলে যায়, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসে এটা হবে এক চরম অকৃতজ্ঞতা।
(লেখক সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct