কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সারা জীবনের কর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে ভুরিভুরি ঈশ্বরচেতনা পাওয়া যায়। তাঁর বাবা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন একেশ্বরবাদী, ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা। তিনি পৌত্তলিকতা বর্জন করেও উপবীত ত্যাগ করতে পারেন নাই। পালন করেছেন অনেক হিন্দু আচার, বেদ উপনিষদ তার জীবনের আদর্শ। ধর্মের বিচারে উদার হয়েও সামাজিক আচারে দেবেন্দ্রনাথ রক্ষণশীল। তিনি ছিলেন রাজা রামমোহনের অনুসারী-ভক্ত। পিতার ঔপনিষদিক শিক্ষা এবং বিপরীত পারিপার্শিক প্রভাব রবীন্দ্রচেতনায় যে গভীর ছাপ রেখেছিল তা তাঁর ভাবনায় ও কর্মে যে বৈপরিত্য সৃষ্টি করে পিতার মৃত্যুর (১৯০৫ খ্রি.) পরও তা থেকে মুক্তি পেতে সময় লেগেছে। এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনাচার বড় বিচিত্র। এ বৈপরীত্য বা স্ববিরোধীতা থেকে রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করেছে তাঁর গভীর মানবিক-চেতনার ভিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়। তিনি আরো বলেছিলেন ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পঙ্তিহারা, আমি তোমাদেরই লোক। তাঁর ঐশ্বরিক ধ্যানধারণা সমাজে প্রচলিত মতবাদগুলির থেকে অনেকাংশে পৃথক। তাঁর ঈশ্বরের অবস্থান স্বর্গলোকে নয়, মানব সংসারে। তাঁর মূর্তি নেই, তিনি নিরাকার, তিনি পানহার মুক্ত, নিদ্রা তাঁর স্পর্শ করে না, সমস্ত প্রকার কষ্ট-ক্লেশ থেকে তিনি মুক্ত, যেমন কবি বলেন-
‘বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।’’
সৃষ্টি ও মানুষের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি “রূপসাগরের অরূপরতন”। কবি তাঁর ঈশ্বরকে নানা নামে অভিহিত করেছেন। কখনো তিনি শুধুই বন্ধু, কখনও প্রাণেশ, কখনো জীবন-বল্লভ, কখনো জীবন-স্বামী, কখনো অন্তর্যামী, কখনো বা প্রভু আবার কখনো বা হে। এমন আরও একাধিক নাম আছে তাঁর ঈশ্বরের।
কবিগুরু তাঁর ঈশ্বরকে আনন্দ বা জাঁকজমকতায় দেখেননি। তিনি তাঁর সন্ধান করেছেন নিখাদ অন্ধকারে, ভয়াল দুর্যোগে। ‘রাজা’ নাটকে রানী সুদর্শনা অন্ধকারে তাঁর রাজাকে অনুভব করেছেন। সেই রাজা আর কেউ নয়, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর। তাঁকে তিনি নিজের থেকে কখনো পৃথক বলে ভাবতে পারেননি। তিনি ঈশ্বর-পূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে এর মধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তাই কবি বলেন–
‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি
জানি নাই তো কখন তুমি দাও যে ফাঁকি’।
জীবনে চলার পথে রবীন্দ্রনাথ বারংবার ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুভব করেছেন। শিশু মনে এই অনুভাবকে গেঁথে দিতে চেয়েছেন তা আবার “সহজ পাঠ” দ্বারা। যেমন কবি বলেন-
‘কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে।
বল দেখি তুই মালী, হয় সে কেমন ক’রে।
এখানে কবিগুরু একটি নিরাকার ও অদৃশ্য শক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যিনি আড়াল থেকেই পৃথিবীর সমস্ত কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং সর্ব প্রকার পরিবর্তনের পিছনে তাঁরই কৃতিত্ব। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন গাছগাছালিতে যে ফলমূল ভরে যায় সেগুলি একটি অদৃশ্য শক্তিরই ইঙ্গিত বহন করে। সেই অদৃশ্য শক্তিই কবিগুরুর ঈশ্বর। উপরিউক্ত চরণে “মালী” বলতে ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সেই মহান শক্তি হতে পারে, আবার কোন গৃহস্তের উদ্যানের রক্ষকও হতে পারে। কিন্তু পরের চরণ অর্থাৎ-
‘ডাক পড়ে বাতাসেতে কী ক’রে সে ওরা শোনে’।
এই চরণটির ইঙ্গিত সেই অদৃশ্য শক্তির দিকে যিনি গাছের ফুল ও ফলের প্রকৃত উৎস। যেমন কবি নিম্নোক্ত চরণে “মাঝি” শব্দ দ্বারা সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা কেই বুঝিয়েছেন। কবি বলেন-
‘ওরে মাঝি, ওরে আমার
মানবজন্ম তরীর মাঝি।‘
কবি সেই সত্ত্বার চরণে মাথা রেখে জীবনের পরমসুখ পেতে চান। জীবনকে সর্ব প্রকারের পাপ মুক্ত করার জন্য কবি সেই মহান ঈশ্বরের কাছে অনুতাপের সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে’।
আরও বিনয়ের সঙ্গে কবি বলেন সেই মহান ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করারও কিছু পদ্ধতি আছে, অনুনয়-বিনয়, কাকুতি মিনতি ও ভক্তিপূর্ণ ভাষা দ্বারা তাঁর কাছে চাইতে হয়। কিন্তু আমি তো চাইতেও জানি না। হে আমার জীবন-স্বামী, হে অন্তর্যামী তুমি সবকিছুই জানো আমাকে ক্ষমা করো। তাইতো কবি বলেন-
‘তোমার দয়া যদি
চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
চরণে নিয়ো টানি’।
কবি আরও বলেন –
‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা ক’র, প্রভু
পথে পিছিয়ে না পড়ি কভু’
জীবন শায়ন্যে এসে কবি সেই ঈশ্বরের গভীর সান্নিধ্য লাভ করতে চাইছেন। আর এই সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়েই কবি পরম সুখ পেতে চান। তাইতো তিনি গেয়েছেন-
‘‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো’।
এই ভাবেই কবিগুরুর কর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে একত্ববাদ ও ঈশ্বরচেতনা ফুটে উঠেছে। একই কারণে তিনি একজন ঋষিকবি।
ড. আবুল কালাম
(সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct