তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়ার কোনিয়া। মরমি কবি রুমির স্মৃতিধন্য এই নগরী। ইসলামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এখানে বিপুলভাবে জনপ্রিয়। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ছবি সেখানকার প্রতিটি স্থানে শোভা পাচ্ছে।
একটি ব্যানারে তার ছবির নিচে ক্যাপশন দেয়া আছে : ‘আমরা আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে ঐক্যবদ্ধ’। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে তুরস্কে এই এরদোগান প্রবল প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মপ্রচারক ফেতুল্লাহ গুলেনের সাথে সম্পৃক্ত সামরিক বাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানচেষ্টা চালায়। তারা এতে সফল হয়নি। আর এতে এরদোগানের জনপ্রিয়তা বরং আরো বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ১০ লাখ জন-অধ্যুষিত কোনিয়ায় তিনি এখন আরো বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
তুরস্কের ১৫ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান বানচাল হয়ে গিয়েছিল জনগণের প্রতিরোধে। অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে জনসাধারণকে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন রজব তাইয়্যেব এরদোগান। জনগণ নেমে আসে। ফলে অভ্যুত্থানচেষ্টাকারীরা বড় ধরনের বাধা পায়। তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।
তুরস্কের রাজনীতিতে অভ্যুত্থানের সময় আরেকটি পরিবর্তন দেখা যায়। সেটা হলো বিরোধী দলগুলোর গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন প্রকাশ। এসব দলের কোনোটিই এরদোগানের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে রাজি হয়নি। কিন্তু অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সবাই ছিল একমত। তারা গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর।
কিন্তু জনগণ কেন একটা আহ্বানেই সাড়া দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমে এলো। ট্যাংকের সামনে দাঁড়াল, শুয়ে পড়ল। এর কারণ তিনি অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়।
তিনি কেন এত জনপ্রিয়? মূল কারণ অর্থনীতি। এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কজুড়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই সবার কাছে তাকে প্রিয় করে তুলেছে। সবাই তাকে মনেপ্রাণে সর্বাধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে। কোনিয়া একটি উদাহরণ বিবেচিত হতে পারে।
২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখানকার তিন-চতুর্থাংশ ভোট পেয়েছিলেন এরদোগান। তারপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন একেপি একই ধরনের সাফল্য পেয়েছিল।
এরদোগান উন্নয়নমুখর যে ইসলামি মতাদর্শ তুলে ধরেছেন, ধর্মীয় নগরী কোনিয়া সেটার দুর্গে পরিণত হয়। তার শাসনকালে এটা বিপুলভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করে। যে অঞ্চলগুলো শিল্প প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির কারণে ‘আনাতোলিয়া টাইগার্স’ হিসেবে খ্যাত হয়, কোনিয়া হয় সেগুলোর অন্যতম। এই কয়েক বছরেই কোনিয়ায় প্রায় ৩০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এরদোগানের শাসনামলে তুরস্ক কত উন্নতি করেছে, এটা তারই একটা ছোট্ট উদাহরণ।
তবে কেবল শিল্পপ্রতিষ্ঠানই নয়, গত দশকে নগরীটির অবকাঠামো খাতেও ব্যাপক রূপান্তর ঘটে যায়। নতুন ট্রামওয়ে, রাজধানী আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের সাথে উচ্চগতির রেলযোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪০ হাজার আসন-সংবলিত বিশ্বমানের একটি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়, নাম তুর্কো এরেনা।
‘এরদোগানকে আরো বিশ্বাস করো’
এমন প্রেক্ষাপটে কোনিয়ার অধিবাসী মুরাত তুনসারতিন বলেন, ‘একেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনিয়ার ভাগ্য বদলেছে। গত ১৫ বছরে এখানকার অর্থনীতি, রাস্তা, পর্যটন খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর আমরা তাকে আরো বেশি বিশ্বাস করি। তিনি জনগণকে ভালোবাসেন, জনগণ তাকে ভালোবাসে। তিনি জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা এরদোগান এবং তাদের সহ-নাগরিকদের জন্য রাস্তায় নেমেছিল।’
কোনিয়া ও তুরস্কের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এরদোগানকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। ২০০০-২০০১ সালে তুরস্কের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়েছিল। কয়েক বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনার দরকার হয়েছিল। এরদোগান সহায়তা নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ)। এই অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরিণতিতে সমৃদ্ধি নিয়ে আসে তুরস্কের জন্য। তুরস্কের অর্থনীতি যে স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পন্ন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৩ সালে আইএমএফের ওই ঋণের শেষ কিস্তিও পরিশোধের ঘটনায়।
মধ্য কোনিয়ার সবুজে সবুজে ভরপুর একটি পার্কে বসে সুকরাত কানুকু বলেন, ‘আমরা একসময় ছিলাম দেনায় জর্জরিত। কিন্তু এরদোগান ওই অবস্থা থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।’
কাছাকাছি থাকা স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা আহমদ উনেয় অভ্যুত্থানচেষ্টা-পরবর্তী অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন তুরস্কে সবকিছু আরো ভালোভাবে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বদলে গেছে, রাস্তাগুলো আগের চেয়ে ভালো, আমরা নিজেদের অস্ত্র তৈরি করছি, বেশির ভাগ নগরীতে রয়েছে বিমানবন্দর।’
তিনি জানান, তার নতুন আবাসিক এলাকাটি ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৪ সালে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়ার পর এখন প্রতি মাসে সেখানে ৭০০-৮০০ লোক চলে আসছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা মেহমেত অ্যারিকারও এর সাথে একমত। তিনি জানান, ‘অভ্যুত্থানের রাতে আমি জানতাম লোকজন এর বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসবে। একেপি গত ১০ বছরে যা করেছে, তা আগের ৫০ বছরেও হয়নি। লোকজন আগের চেয়ে সম্পদশালী হয়েছে। জীবন আগের চেয়ে সুন্দর।’
অবশ্য কোনো কোনো বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারের প্রবৃদ্ধি ৪.৭ ভাগ দ্বিতীয় কোয়ার্টারে নেমে ৩.১ হয়েছে। এর ফলে লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে।
অবশ্য এরদোগান এবং তার সহকর্মীরা নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করছেন। ফলে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাবে তুরস্ক। সর্বাধিনায়কের প্রতি তুর্কি জনগণের আস্থাও বাড়বে। অভ্যুত্থানের পর যেসব জনমত জরিপ চালানো হয়েছে, তার সবগুলোতেই দেখা গেছে, তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। অনেকে মনে করেছিল, ব্যাপক ছাঁটাই, গ্রেফতারে তার জনপ্রিয়তা কমে যাবে, জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে।
(মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে)