ভারতের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও বেকার সমস্যা এক বড় ইস্যু।সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি ছিল ২.১ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিকস’ যে ‘স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট: ২০১৪-১৫’ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অংশিদারিত্বের হার ৫.৭৩ শতাংশ। অথচ, ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার হার ২৭.০১ শতাংশ। সুতরাং, জনসংখ্যার তুলনায় রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার কম হলেও, কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
যদিও ৩৪ বছরের বাম শাসনে রাজ্য সরকারের চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতির হার তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। সাচার রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকুরিতে মুসলিমদের হার নগণ্য। সেসময় অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী ছিলেন ড. আবদুস সাত্তার। তারা সাচার রিপোর্টের বাস্তবতা অস্বীকার করেছিলেন।অভিযোগ করেছিলেন, সাচার রিপোর্ট ঠিকভাবে বাংলার মুসলিমদের সরকারি চাকরির হাল তুলে ধরেননি। উল্টোদিকে সাচার কমিটির অভিযোগ ছিল, সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি নিয়ে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য দেয়নি। তা হলেও সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ২.১ শতাংশ মাত্র বলে উল্লেখ করা হয়।
সাচার রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১,৩৪,৯৭২ জন কর্মীর তথ্য দিয়েছিল।ততেই ২.১ শতাংশ মুসলিমের হার উঠে এসেছে। এই তথ্যে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি মুসলিমের চাকরি করার হার স্বরাষ্ট্র দফতরে, ৭.১ শতাংশ। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য, মহিলা ও শিশু কল্যাণ বিভাগে এক শতাংশ ও অন্যান্য বিভাগে ২.৪ শতাংশ।যদিও সাচার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে শিক্ষা দফতর ও পরিবহণ দফতর কোনও তথ্য সরবরাহ করেনি। উল্লেখ্য, দেশের মুসলিমদের আর্থসামাজিক ও শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বাধীন সাচার কমিটির রিপোর্ট ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর পেশ করা হয়। আর তা লোকসভা ও রাজ্যসভায় পেশ করা হয় ৩০ নভেম্বর, ২০০৬।
সাচার কমিটির পর মূল্যায়ন নিয়ে এক পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠিত হয় জেএনইউ-এর সেন্টার ফর স্টাডি অফ রিজিওনাল যেভেলপমেন্টের অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডুর নেতৃত্বে। ওই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, সিএসও-র ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল, গেটস ফাউন্ডশন (দিল্লি)র ড. আমিরউল্লাহ খান, পুণের পি এনামদার, আইওএসের ড. মনজুর আলম, জেনএনইউয়ের অধ্যাপক পি এম কুলকার্নি, গুজরাতের ইরমার ডিরেক্টর জিমোল উন্নি, পিএমওর জাতীয় পরামর্শ পরিষদের সদস্য ফারাহ নাকভি, অধ্যাপক আবদুল সাবান, কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সম্পাদক আলি আহমেদ।
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার। তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক বামেদের থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে পরিবর্তিত হয়েছে।আর তার ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল জয় এসেছে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আম্বস্ত করেছিলেন রাজ্যে মুসলিমদের উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের চাকরিতেও উন্নতি হবে।
তবে, সাচার রিপোর্টের প্রায় ১৫ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য মুসলিমদের যে পরিবর্তন হয়েছে তার বিশ্লেষণ দরকার। সাচার কমিটির পর কুণ্ডু কমিটির রিপোর্ট বের হলেও তাতে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তেমন তথ্য ছিল না। যদিও আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৪ সালে পাওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ড প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপোর্ট (স্ট্যাটাস অফ মুসলিমস অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, প্রিলিমিনারি পাবলিক রিপোর্ট ২০১৪)।
নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের সংস্থা প্রতীচী ট্রাস্টের সহযোগিতায় এই সমীক্ষা রিপোর্টটির রূপায়ণে ছিল স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ড। ৭৭ পাতার রিপোর্টে মুসলিমদের আর্থ সামাজিক ও শিক্ষার হাল তুলে ধরলেও তাতে রাজ্যের সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি নিয়ে কোনও তথ্য ছিল না।
এখন এখন অবশ্য ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ বর্ষের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি চাকরির সেন্সাস রিপোর্ট সামনে এসেছে। এটা উল্লেখযোগ্য যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার রাজ্যে আসার পর মুসলিমদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি মূলত মুসলিমদের জন্য ওবিসি-এ তালিকাভুক্তদের জন্য সরকারি চাকরিতে ও শিক্ষায় ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় নাজ্যে সাত শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ ছিল।তখন মুসলিমদের মাত্র নটি গোষ্ঠী ওবিসির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন তা বহু অংশে বেড়ে গেছে। বর্তমানে অবশ্য ওবিসি-এ ও ওবিসি-বি এই দুটি ভাগে বিভক্ত। ওবিসি-বি তালিকায় খুবই নগ্যণ মুসলিম থাকলেও ওবিসি-ও তালিকায় সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের। মমতা সরকার ওবিসি-এ দের জন্য ১০ শতাংশ ও ওবিসি-বি দের জন্য ৭ শতাংশ, মোট ১৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ চাকরিতে দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন।
এই কারণে হয়তো তৃণমূল সরকরের পক্ষে দাবি করা হয়ে থাকে মুসলিমদের জন্য উন্নয়নের প্রায় সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সেই দাবির পুরোটা মেলে না। তবে, সাচার রিপোর্টে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ২.১ উল্লেখ করা হলেও তার উন্নতি ঘটছে মমতার আমলে। ২০১৩-১৪ বর্ষের স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী যেখানে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ছিল ৫.৪৭ শতাংশ, তা ২০১৪-১৫ বর্ষে বৃদ্দি পেয়ে হয়েছে ৫.৭৩ শতাংশ। মনে করা হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ ওবিসি-এ সংরক্ষণের ফল এটি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড ১৯৪৮ সাল থেকে ‘সেন্সাস অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ’ রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। তবে, ২০১৩-১৪ সালে যে এমপ্লয়মেন্ট সেন্সাস প্রকাশ করা হয়েছে তা সংগৃহীত হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আর ২০১৪-১৫ সালের রিপোর্টের তথ্য সংগহ করা হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। উভয় রিপোর্টই ৪৫ পাতার। ২০১৪ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ১৮টি জেলার তথ্য। আর ২০১৫ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯টি জেলার তথ্য। এই রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে রাজ্যে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে ২০১৪ সালের তুলনায়। ২০১৪ সালে যেখা রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল ৩,৫৩,৫২৫ সেখানে ২০১৫ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩,৩১,২৪৯। তবে, ২০১৪ সালের তুলনায় মুসলিমদের চাকরি পাওয়ার হার বেড়েছে ২০১৫ সালে।
তবে, সাচার রিপোর্টে হয়েছিল ২০০১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে। সেমসয় রাজ্যে মুসলিমদের হার ছিল ২৫.২ শতাংশ। যদিও ২০১১ সালের জনগণনায় মুসলিমের হার ২৭.০১ শতাংশ। আর সবচেয়ে মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত জেলা হল মুর্শিদাবাদ। ২০১১ সাল অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে মুসলিমের হার ৬৬.২৮ শতাংশ। কিন্তু সরকারি চাকরিতে সেখানে মুসলিমের হার খুবই নগণ্য।এমনকি ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার কমেছে।
২০১৩-১৪ সালের স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার ১৬.৩ শতাংশ, কোচবিহারে ৪.২৮ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে ৯.১১ শতাংশ, মালদায় ১১.৩৩ শতাংশ, কলকাতায় ৫.৩৯ শতাংশ ও হাওড়ায় ৪.৮৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১৪-১৫ বর্ষের স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট বলছে, সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার মুর্শিদাবাদে ১৫.৬১ শতাংশ, কোচবিহারে ৪.০৭ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে ৮.৮৫ শতাংশ, মালদায় ১১.০৯ শতাংশ, কলকাতায় ৫.৩ মতাংশ ও হাওড়ায় ৪.২৪ শতাংশ। যদিও ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী কোচবিহারে মুসলিমের হার ২৫.৫৪ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে ৫০.৯২ শতাংশ, মালদায় ৫১.২৭ শতাংশ, কলকাতায় ২০.৬০ শতাংশ ও হাওড়ায় ২৬.২ শতাংশ।
একইভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মুসলিম জনসংখ্যার হার ৩৫.৫৭ শতাংশ। সরকারি চাকরিতে ওই জেলায় মুসলিমের হার মাত্র ৫.৮২ শতাংশ। বীরভূমে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৩৭.০৬ শতাংশ, কিন্তু সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার ১১.৭১ শতাংশ।তবে, তথ্য বলছে এই জেলায় সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার উল্লেখজনক হারে বেড়েছে। ২০১৩-১৪ বর্ষে বীরভূমে যেখানে সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার ছিল ৩.৯৩ শতাংশ, সেকানে ২০১৪-১৫ বর্ষে তা ৭.৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১১.৭১ শতাংশ।অন্যদিকে যে সমস্ত জেলায় মুসলিম জনসংখ্যার হার তুলনামূলক কম, সেখানে রাজ্য সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার ততটা খারাপ নয়। যেমন, জলপাইগুড়ি জেলায় মুসলিম জনসঙখ্যার হার ১১.৫১ শতাংশ, কিন্তু ২০১৫ বর্ষে সরকারি চাকরিতে মুসলিম হার ৩.৭৫ শতাংশ।
২০১১ জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যে মুসলিমের হার ২৭.০১ শতাংশ হলেও সেই তুলনায় রাজ্য সরকারি চাকরিতে মুসলিমের হার নগণ্য। যদিও, বিশেষ শ্রেণি গোষ্ঠী তাতেই মুসলিমদের রাজ্য সরকার তোষণ করছে বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব কিন্তু বলছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার বাড়লেও জনসংখ্যার হার অনুযায়ী তা এমনই নগণ্য যে, তাকে মুসলিম তোষণ বলাটা হাস্যকর।
https://drive.google.com/file/d/1jW3OKzWo99e9txn9p210QxTFf9FXXlDv/view?usp=drives
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct