অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, দাবদাহ ও জলসংকটের জন্য দশ লক্ষ উটকে গুলি করে মারা হল। মারা হবে ক্যাঙ্গারুকেও। নিজের বাঁচার জন্য মানুষ অনায়াসে অন্য প্রাণীকে হত্যা করতে পারে। সে রকম অলিখিত অধিকার সে করায়ত্ত করে নিয়েছে। কিন্তু শুধু ভিন্ন প্রাণী নয়, এক জাতির মানুষ অন্য জাতির মানুষকে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে খুন করে। এ মহূর্তে করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে সারা বিশ্ব কম্পমান, চিনের উহান থেকে তা ছযিয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ইজরায়েলের সেনা গোয়েন্দা দপ্তর আর ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছেন যে শত্রুদেশকে জব্দ করার জন্য চিনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি বি এস এল৪ গবেষণাগারে গোপনে চিন অনেকদিন ধরে এই মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শুধু চিনকে দোষ দিয়ে লাভ কি? জৈব-রাসায়নিক অস্ত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বহু দেশই তাদের তাদের মতো করে এ অস্ত্র ব্যবহার করে এসেছে। ১৯৭২ সালে জৈব ও টক্সিনজাতীয় অস্ত্র নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে পৃথিবীর ১০০ টি দেশ সরব হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও তার পরীক্ষা বন্ধ হয়নি। এখানেই শেষ নয়। স্বামী স্ত্রীকে, সন্তান পিতামাতাকে, ভাই ভাইকে খুন করে। এসব খুনের প্ররোচনা স্বার্থের। এই সংকীর্ণ স্বার্থবোধ মানুষকে ভয়ংকর করে তুলেছে। অস্ট্রেলিয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নেট নাগরিকদের অনেকেই টুইটারে সেখানকার সরকারের সমালোচনা করেছেন। কেউ লিখেছেন, ‘আমাদের এই পৃথিবীতে থাকার অধিকার নেই’। আবার কেউ লিখেছেন, ‘মানুষই এখন সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হয়ে উঠেছে’।
আফ্রিকার জাম্বিয়ার রাজধানী লিসাকার দক্ষিণে সাত মাইল দূরে আছে একটি চমৎকার চিড়িয়াখানা। তার নাম মুণ্ডা ওয়াঙ্গা। যার অর্থ ‘আমার বাগান’। এই চিড়িয়াখানায় ৪৫ প্রজাতির প্রাণী আর ১০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। নানা খাঁচায় নানা প্রাণী দেখতে দেখতে দর্শক শেষ খাঁচার কাছে উপস্থিত হয়ে দেখে সে খাঁচাটি শূন্য। কোন প্রাণী নেই সেখানে। সেখানে আছে একটি বিরাট আয়না, আর একটি নোটিশ বোর্ড। নোটিশে লেখা : ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী’। আয়নায় দর্শক নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে, দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকৃতি জয়ের উন্মাদনায়, অন্ত্যহীন চাহিদার তাগিদে মানুষ সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলায় মেতেছে।
এই ধ্বংসলীলার তালিকায় প্রথমেই আমরা দেখি গাছ ও বনের ধ্বংসসাধন। রবীন্দ্রনাধ গাছকে ‘আদিপ্রাণ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। মানুষের আগেই গাছ এসেছিল পৃথিবীতে। যেদিন থেকে কুড়ুল আবিষ্কার করেছে মানুষ, সেদিন থেকে শুরু হয়েছে গাছ কাটা। বৈজ্ঞানিকরা হিসেব করে দেখেছেন মানুষের আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে ৩ ট্রিলিয়ন গাছ ছিল, আজ আছে তার ৪৫ ভাগ মাত্র। এখন বছরে ১৫ বিলিয়ন গাছ কেটে ফেলা হয়। গাছ ও বন কাটার ব্যাপকতা বেড়েছে শিল্পবিপ্লবের পরে। বন কেটে বসত গড়ার তাগিদ। বিংশ শতাব্দী থেকে এ পর্যন্ত ১০০ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার বন ধ্বংস করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতে ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১০ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার বন কেটে ফেলা হয়েছে। গার্ডিয়ানের মতে প্রতি সেকেন্ডে একটা ফুটবল খেলার মাঠের মতো আয়তনের বন ধ্বংস করা হয়। নেচার ইকোলজি আ্যন্ড এভলিউশন পত্রিকা বেলেছে ১৯০০ থেকে বছরে তিন প্রজাতির উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বন ও গাছের পরে আসে প্রাণীহত্যালীলা। নিজেকে শ্রেষ্ঠ জীব বলে মনে করে মানুষ। নিজের অধিকারের ব্যাপারে সে তীব্রমাত্রায় সচেতন। তাই তার কাছে অন্য প্রাণীর জীবনের কোন মূল্য নেই। পৃথিবীটা যে শুধু মানুষের জন্য নয়, সে কথা বেমালুম বিস্মৃত থাকে মানুষ। জার্নাল সায়েন্স পত্রিকার একটি নিবন্ধে রাচেল ফেল্টম্যান মানুষকে সবচেয়ে বড় শিকারি প্রাণী বলেছেন। ফেল্টম্যানের মতে অন্যান্য বড় মাংসাশী প্রাণী যে শিকার করে তার তিন গুণ বেশি করে মানুষ। লণ্ডনের জুলজিকাল সোসাইটির বিজ্ঞানীদের মতে গত ৪০ বছরে জল ও স্থলের অর্ধেক প্রাণীকে হত্যা করেছে মানুষ। মানুষের খাদ্য তালিকায় মাংস থাকে নিয়মিত। খাদ্যের জন্য প্রতিদিন ২০০০ লক্ষ প্রাণীকে হত্যা করা হয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য বছরে হত্যা করা হয় ১০০০ লক্ষ ইঁদুর, বেড়াল, মাছ, বাঁদর ও পাখি। এছাড়া আছে বিশুদ্ধ মজা ও অবসর বিনোদন। যার নাম শিকার। আগেকার দিনের রাজা-মহারাজা ও অভিজাতদের শখ ছিল শিকার। একালে ট্রফি জেতার জন্য আয়োজন করা হয় শিকারের। উৎকট এই শখ মেটানোর জন্য বছরে ৭০ হাজার প্রাণীকে আত্মদান করতে হয়। আমেরিকায় যখন প্রথম রেলগাড়ি চালু হয়, তখন রেল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিতেন: ‘আসুন, চলে আসুন, চাপুন রেলগাড়ি, দুপাশের ফাঁকা মাঠে ঘুরে বেড়ানো বাইসন শিকার করুন’। হিংস্র বন্য প্রাণীরা প্রয়োজনের বেশি অথবা শুধু শখ মেটানোর জন্য প্রাণী হত্যা করে না। মানুষ যে সবচেয়ে বড় শিকারি প্রাণী, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
শুধু অন্য প্রাণী নয়, মানুষ শিকার করে মানুষকেও। সভ্যতার শুরু থেকে যুদ্ধ করে আসছে মানুষ। এই সব যুদ্ধে কত মানুষ নিহত হয়েছে, তার সঠিক তালিকা নির্ণয় অসম্ভব। বিংশ শতাব্দী থেকে সে তালিকা পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৮,৫২৮,৮৩১ ; আহতের সংখ্যা ২১, ১৮৯, ১৫৪। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ও আহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। নিহতের সংখ্যা ৭-৮ কোটি, আহতের সংখ্যা ৮-১০ কোটি। আ্যটম বোমা ফেলায় হিরোসিমায় ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার ও নাগাসাকিতে ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। ১৯৪১-৪৫ সালের মধ্যে হিটলার ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেন; রাশিয়ায় স্টালিনের আমলেও নিহত হন ৬০ লক্ষ মানুষ। এছাড়াও আ্ছে দেশে দেশে যুদ্ধ ও বিপ্লবে হতাহতের সংখ্যা। গ্রিসের গৃহযুদ্ধে ১ লক্ষ ৫০ হাজার, হাঙ্গেরির বিপ্লবে ৩ হাজার, কোরি্যার যুদ্ধে ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ, চিনের গৃহযুদ্ধে ২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৬ লক্ষ, গুয়াতেমালার গৃহযুদ্ধে ২ লক্ষ, কিউবার বিপ্লবে ৫ হাজার, কঙ্গোর বিদ্রোহে ১ লক্ষ, ভিয়েতনামের যুদ্ধে ৯ লক্ষ ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যায় ৪ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। ধর্মের জন্যও যুদ্ধ করেছে মানুষ। ম্যাথিউ হোয়া্ইটের মতে ক্রুশেড বা ধর্মযুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
মানুষের সভ্যতা, মানুষের অগ্রগতির পাশাপাশি বিরাজ করছে ‘এক অদ্ভুত আঁধার’। স্বার্থবোধ, লোভ আর হিংসা নিরন্তর তৈরি করছে সেই অন্ধকার। এই অন্ধকার যাতে মানুষের অস্তিত্বকে গ্রাস না করে তার উপায় মানুষকেই খুঁজে বের করতে হবে।