দিনকয়েক আগে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করোনাকে পাশবালিশ করে নেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন । আমাদের বিছানায় পাশবালিশ যেমন নিত্যসঙ্গী, করোনাও তেমনি আমাদের নিত্যসঙ্গী হবে । মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা আপাতদৃষ্টিতে স্থূল রসিকতা বলে মনে হতে পারে। এইরকম সন্ত্রাসকবলিত সময়ে এ কথা কারও কারও কাছে অশালীনও মনে হতে পারে । মমতা একথা বলে ফেলেছিলেন কেন্দ্রের প্রতি বিরূপ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে । পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে কেন্দ্রের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না । ব্যাপারটা রাজ্যগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল । কেরল ও মহারাষ্ট্র মমতার কথায় সহমত পোষণ করেন । ইতিপূর্বে মমতা বলেছিলেন লকডাউনের পর্বে শ্রমিকরা যেখানে আছেন, সেখানে থাকুন । তাঁদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হোক । কেন্দ্র সে পরামর্শে কর্ণপাত করেন নি । ফল যা হবার তাই হয়েছে । পরিযা্য়ী শ্রমিকরা যৎপরোনাস্তি নাকাল হয়েছেন । যে রাজ্যে তাঁরা ফিরেছেন, সে রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে ।
সে কথা যাক । আমরা ‘পাশবালিশ’ শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করব । মমতা অসচেতনভাবে এক বৈজ্ঞানিক সত্য উচ্চারণ করে ফেলেছেন । সম্পূর্ণ নতুন ও রহস্যময় এই ভাইরাসকে নিয়ে কম নাজেহাল হচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা । প্রাণপণ চেষ্টা চলছে প্রতিষেধক আবিষ্কারের । চিন, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, আমেরিকা, ভারত সকলেরই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে । এক একবার সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায় ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’ । তারপরেই ফক্কা । শুধু বোঝা যায়, ব্যাপারটা দু-এক মাসে হবে না । নিন্দুকেরা বলে কোনদিনই প্রতিষেধক বেরুবে না । নজির হিসেবে তারা সার্স-এর কথা টেনে আনে ।
কেন্দ্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে হোক, বা অন্য কোন কারণে হোক, মমতা ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন । তখন একটা ‘গেল গেল’ রব উঠল । দিনের পর দিন দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে । এবার প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে । সাধারণ মানুযের মনে একটা আতঙ্ক হবেই । লকডাউন শিথিল করলে আক্রান্তের সংখ্যা যদি আরও বেড়ে যায় ?
কিন্তু লকডাউন দীর্ঘদিন থাকলে কি হবে রুটি-রুজির ? কৃষি-শিল্প সবই তো স্তব্ধ হয়ে যাবে । তখন পেটের টানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বেন মানুষ। বেরোবেনই । ‘এমনি তো না খেয়ে মরব, না হয় করোনায় মরি’- এই যদি বিদ্রোহীদের মনোভাব হয় ? কোন সরকার তাকে সামাল দেবে ! ঘোলাজলে মাছ ধরতে নামা নির্বাচনশিকারী রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনবেন মানুষ ?
তাছাড়া, লকডাউনে কি আটকাবে সংক্রমণ ? ওই যে আ্যসিম্পটোম্যাটিক অর্থাৎ লক্ষণবিহীন বাহকদের কথা বলা হচ্ছে, কে আটকাবেন তাদের ? কিভাবে আটকানো যাবে ? পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীদের তাঁরা সংক্রমিত করে দেবেন নিজের অজান্তেই ।
সুইডেন বা দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলের কথা বলা হচ্ছে । কিন্তু এক দেশের মডেল হবহু অন্য দেশে কার্যকর করা যায় না । পরিবেশগত পাথর্ক্য আছে বলেই তা করা যায় না ।বামপন্থী বন্ধুরা এ রাজ্যে কেরল মডেল প্রয়োগের কথা বলছিলেন । করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কেরল সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয় । কিন্তু কেরলের লোকসংখ্যা ৩ কোটি, পশ্চিমবঙ্গের সেটা ৯ কোটি ; কেরলে দারিদ্য সীমারেখার নিচে আছেন মাত্র ১% মানুষ, এ রাজ্যে সেটা ১৩% ; সাক্ষরতার হারেও অনেক পার্থক্য । কলকাতায় ও হাওড়ায় সংক্রমণ বেশি, কারণ তাদের লোকসংখ্যা, বস্তিবাসী; এ সমস্যা তিরুবন্তপুরমের নেই ।তাই কেরল সরকার যা করতে পেরেছেন, তা সদিচ্ছা থাকলেও এ রাজ্য পারেন না । তাছাড়া এ রাজ্যে করোনা যুদ্ধটা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক যুদ্ধে, কারণ ২০২১ সালের নির্বাচন । সে সমস্যা কেরলে নেই । কারণ কেরলের সচেতন মানুষ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তন করেন । তাই আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি । যতটা সম্ভব নিজেদের সুরক্ষিত রেখে রুটি-রুজির কাজ আমাদের করে যেতে হবে । বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষদের যতটা সম্ভব ঘরবন্দি করে রাখতে হবে, কারণ তাঁদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা বেশি । আর একটা কথা । করোনাবিরোধী আন্দোলনটা যেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত না হয় ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct