ভীত, ত্রস্ত এই সময় ; বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এই সময় । কি হবে, কি হতে পারে ? কেউ জানে না । ফিরে ফিরে আসতে পারে করোনার ঢেউ । থাকতে পারে দু-চার বছর। কেউ জানে না সঠিক । এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রকম্পিত বিশ্বের দুশো পনেরোটি দেশ । ধুলোয় মিশেছে উন্নয়নের অ্হমিকা । মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বিশ্বায়ন । মুখে মাস্ক এঁটে বসে আছি রুদ্ধঘরে । বন্দি নয়, অথচ বন্দি । মানব সম্পর্কের মাঝে শুয়ে আছে এক অদৃশ্য অণুজীব । সে নীরবে জাগাচ্ছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস । আমি তোমাকে সন্দেহ করছি, তুমি আমাকে । এভাবে বাঁচা যায় ? এই ভয় আর সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে বাঁচা যায় ?
মনে হল, সাহিত্য আর শিল্পকলার দিন বুঝি শেষ । নিয়ত কম্পিত জীবনে অস্তিত্ব রক্ষার দায়টা প্রধান । কে পড়বে সাহিত্য ? কি দেবে সাহিত্য ? তাহলে কি ফেলে দেব বইপত্র ? ফেলে দিতে হবে তোমাকে, রবীন্দ্রনাথ ? এ বারের পঁচিশে বৈশাখেই শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন ?
গুনগুন করে ভেসে আসে গানের কলি : আমি ভয় করব না ভয় করব না / দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না । মনের ভেতরে ঢুকে যায় সেই বাণী । চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাস । কত মহামারী এসেছে পৃথিবীতে, কত বিপর্যয়, কত ভূমিকম্প, কত বন্যা.. । তবু শেষ হয়ে যায় নি মানব জীবনধারা । জানি, অনেক ভুল মানুষের, অনেক অপরাধ । সে পরিবেশের ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে । খোদার উপর খোদকারি করতে চেয়েছে । প্রকৃতি তাই নিয়েছে প্রতিশোধ । চরম মূল্য দিতে হয়েছে মানুষকে । তারপরে মানুষ সে ভুল সংশোধন করে নেবার চেষ্টা করেছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্লেদাক্ত পটভূমিকায়, জীবনের অন্তিম লগ্নে তুমি বলেছিলে রবীন্দ্রনাথ : মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো মহাপাপ । সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব, আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের নতুন সূর্যোদয় হবেই ।
তোমার নটরাজ তো মানুষই । তারই পায়ের তালে তালে নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু । সে ধ্বংস করে, আবার সেই তো সৃষ্টি করে । এই যে আজকে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা দিনরাত বসে আছেন গবেষণাগারে, সে তো নতুন সৃষ্টির জন্যই, যে সৃষ্টি টিকার রূপে আসবে পৃথিবীতে, বাঁচাবে আর্ত মানুষকে ।
হয়তো করোনাকবলিত হবার পরে চোখ খুলে যাবে মানুষের । যে ধনতন্ত্র অন্ত্যহীন চাহিদায় মাতাল করে তুলেছে মানুষকে, অবসান হবে তার । সেই নতুন মানুষ তোমার গান গাইবে : আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা / এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও । নতুন মানুষ উপলব্ধি করবে দেশ জয় করার মতো প্রকৃতিকে জয় করার দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ করতে হবে । পৃথিবীটা শুধু মানুষের জন্য নয়, উদ্ভিদ আর মানবেতর প্রাণী, সকলের জন্য । প্রকৃতি সম্পর্কে একটা সর্বাত্মক দৃষ্টি লাভ করবে নতুন মানুষ ।
[ লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক]
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct