নিয়ম না মেনে ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি করানোর অভিযোগে যাদবপুরের কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের ৭৬ জন ডাক্তারি পড়ুয়ার ভর্তি বাতিল করে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ওই কলেজের কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-র (এমসিআই) নিয়ম মেনে মেধার ভিত্তিতেই ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডাক্তারিতে ভর্তি করাতে হবে। বিচারপতি বসাকের মন্তব্য, ‘‘ভর্তি প্রক্রিয়ায় দর কষাকষি হয়েছে।’’
এত দিন পর্যন্ত বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি নিজেরাই একটি পরীক্ষা নিয়ে ম্যানেজমেন্ট কোটায় ছাত্রছাত্রী ভর্তি করত। এ বারই প্রথম কেন্দ্রীয় স্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এর মেধা তালিকা মেনে ভর্তির নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কেপিসি মেডিক্যাল কলেজে শুক্রবার মনোনীত ছাত্রছাত্রীদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেটির ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছিল, মেধা তালিকার অনেক নীচে ঠাঁই পাওয়া পড়ুয়াও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। অথচ ভর্তি হতে পারেননি তালিকায় তুলনামূলক ভাবে ওপরের দিকে থাকা পড়ুয়ারা। এর কারণ হিসেবে কেপিসি কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা আগে এলে আগে ভর্তির নিয়ম চালু করেছেন।
কর্তৃপক্ষের ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের দ্বারস্থ হন কয়েক জন অভিভাবক। তার প্রেক্ষিতেই এই নির্দেশ দেয় আদালত।
মামলাকারীদের একজনের আইনজীবী অনিন্দ্য লাহিড়ি আদালতে জানান, তাঁর মক্কেলের মেয়ের চেয়ে মেধাতালিকার অনেক তলায় নাম থাকা এক প্রার্থী ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি হয়েছেন। অথচ ১৯৯৭ সালের এমসিআই-এর নিয়ম অনুযায়ী, এমবিবিএস-এ ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি করতে হলেও মেধাতালিকাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে ৭৬ জনকে ২৭ অগস্ট ওই কলেজে ভর্তি করা হয়েছে, মেডিক্যাল জয়েন্ট পরীক্ষার মেধাতালিকায় তাঁদের স্থান আদালতে পেশের দাবিও জানান অনিন্দ্যবাবু।
কেপিসি কলেজের পক্ষে আইনজীবী প্রবাল মুখোপাধ্যায়ের কাছে বিচারপতি বসাক জানতে চান, ম্যানেজমেন্ট কোটায় কত জন আবেদন করেছেন? প্রবালবাবু জানান, ৯০০ জন। তাঁদের মধ্যে ৭৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
কী ভাবে ওই পড়ুয়াদের ভর্তি করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রবালবাবু জানান, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আগেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন, ‘আগে এলে আগে সুযোগ’-এর ভিত্তিতেই ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি হবে। সেই বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ মামলা দায়ের করেননি বলেও জানান তিনি।
বিচারপতি বসাক জানতে চান, ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তির আবেদনপত্রের কোনও ক্রমিক নম্বর রয়েছে কি না। এও জানতে চান, কোন আবেদনকারী আগে আবেদন করেছেন, কেই বা পরে, তার কোনও নথি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে কি না। বিচারপতির প্রশ্ন, ‘‘যাঁরা ভর্তি হয়েছেন, তাঁরাই যে আগে আসার কারণে আগে সুযোগ পেয়েছেন, তা জানার উপায় কী?’’ প্রবালবাবু জানান, আবেদনপত্রের সঙ্গে তিন হাজার টাকা জমা দেওয়ার পরেই রসিদ দেওয়া হয়েছে।
মামলার আবেদনকারীদের তরফে একজনের আইনজীবী তা শুনে অভিযোগ করেন, পিছনের দরজা দিয়ে ভর্তি করিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ খেয়ালখুশি মতো ভর্তি করিয়েছেন।
কলেজের আইনজীবী জানান, ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ হলফনামা পেশ করতে রাজি আছেন। আদালত সেই সুযোগ দিক।
এমসিআই-এর আইনজীবী সৌগত ভট্টাচার্য আদালতে জানান, কলেজ কর্তপক্ষ ৭৭ জনকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ভর্তি করিয়েছেন। তা শুনে মামলার আবেদনকারীর তরফে এক আইনজীবী বলেন, ‘‘ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি হয়েছেন ৭৬ জন।’’ তখন বিচারপতি বসাক মন্তব্য করেন, ‘‘একটি আসন এখনও ফাঁকা রাখা হয়েছে দর কষাকষির জন্য।’’ সৌগতবাবু আবেদন করেন, আদালত কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিক, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডাক্তারিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য। গোটা দেশেই ওই সময়ের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
সব পক্ষের সওয়াল শুনে বিচারপতি বসাক জানিয়ে দেন, ম্যানেজমেন্ট কোটায় ৭৬ জনের ভর্তি বাতিল করা হচ্ছে। সব আসন পূরণ করতে হবে এমসিআই-এর নিয়ম মেনে। একই সঙ্গে গত পাঁচ বছরে ওই কলেজে যত জনকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে, তাঁদের ভর্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য আদালতে জমা দেওয়ার জন্য কেপিসি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কলেজ কর্তৃপক্ষকে হলফনামা পেশেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মামলার আবেদনকারীদেরও পাল্টা হলফনামা পেশ করতে বলা হয়েছে। তিন সপ্তাহ পরে মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
এ দিন আদালতের ওই নির্দেশের পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মামলাকারী অভিভাবকরা একে তাঁদের ‘নৈতিক জয়’ বলে দাবি করেছেন। অন্য দিকে, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের মধ্যে। কেপিসি কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ দিন আদালতের নির্দেশ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। সিইও জয়দীপ মিত্র জানান, এ ব্যাপারে তাঁদের তরফে অধ্যক্ষের বাইরে আর কেউ কোনও মন্তব্য করবেন না। অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী জানিয়ে দেন, আদালতের নির্দেশের কপি হাতে পেলে তার পর তাঁরা এ বিষয়ে যা জানানোর জানাবেন।
রাজ্যের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিকে কেন্দ্র করে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হল, তা নিয়ে অস্বস্তিতে স্বাস্থ্য দফতরও। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা তো আর পুলিশ নই। তাই পুলিশের মতো নজরদারি করতে পারব না। আদালতের রিপোর্টের কপি আগে পাই। তার পরে আদালতের কাছে আমাদের বক্তব্য পেশ করব।’’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct