সেদিন জাতির উদ্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনছিলাম। তিনি বললেন আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের গৃহবন্দি থাকতে হবে। না হলে করুণাকে ঠেকানো যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণে মনে হল তিনি ‘করোনা’কে ‘করুণা’ বলছেন।
কিন্তু তারপরে আমার মনে হল করনাতো আমাদের করুণাই করে। দেখুন, সব মহাপুরুষই বলে গিয়েছেন যে সব জিনিসের ভালো-মন্দ দুটো দিক আছে। আপাতভাবে করোনা আমাদের প্র্ভূত ক্ষতি করছে ও করবে। বহু মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সে আমাদের সমাজকে, সামাজিক সম্পর্ককে, অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। কারোর নাক দিয়ে সর্দি গড়ালে, কেউ একটু হাঁচলে বা কেশে ফেললে আমরা সন্ত্রস্থ হয়ে উঠছি। তাকে এবং তার পরিবারের লোকজনকে একঘরে করে দিচ্ছি। সারা পৃথিবীতে মৃত্যুমিছিল চলছে। এসব করোনার কালো দিক। এসব তার অভিশাপ।
কিন্তু তার আলোর দিক কি কিছু নেই? আছে তো। মহাপুরুষরা মিথ্যে বলেন না। সংকটের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা করে ভাবলে আমরা করোনার আলোর দিকটা দেখতে পাব।
কত বছর ধরে পরিবেশবিদরা গলা ফাটিয়েছেন পরিবেশদূষণ নিয়ে। কথা শোনেনি মানুষ। না রাষ্ট্র, না সমাজ, না ব্যক্তিমানুষ। দেদার গাড়ি ছুটিয়েছে, বোমা ফাটিয়েছে, বাঁশি বাজিয়েছে, মিছিলে চিল্লেছে, ধোঁয়া উড়িয়েছে। আজ দেখুন বেইজিংএ, লণ্ডনে, প্যারিসে, ভেনিসে, মাদ্রিদে, নিউইয়র্কে, কলকাতায়, ঢাকাতে টুঁ শব্দ নেই। আপনি নিন্দুক হলে বলবেন এ হল মৃত্যুভয়জনিত নীরবতা। তা হোক, তবু নীরবতা তো। মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। এমন নীল-নির্মল আকাশ কতদিন আগে দেখেছেন? চাঁদের হাসির বাঁধভাঙা এমন উচ্ছ্বাস আগে দেখেছেন কি! করোনা দু-চার মাসের জন্য হলেও পরিবেশদূষণকে রোধ করে দিয়েছে। এটা তার আশীর্বাদ নয়?
আরও আছে। পরিবেশদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সামাজিক দূষণ। খবরের কা্জ খুললেই দেখা যেত খুন-জখম-ধর্ষণ-রাহাজানি। এই কদিনে সেসব খবর কি আপনার চোখে পড়েছে? খুনি বা ধর্ষকরা মৃত্যুভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছে। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিচের ব্যবধান করোনা মুছে দিয়েছে নিপুণ হাতে। আসলে বোধ হয় করোনা সাম্যবাদের পূজারি। সে মাস কয়েক সাম্যবাদের প্রবাহ বইয়ে দিতে পেরেছে বিশ্বময়।
তবে কিনা করোনার এই করুণা বড় ক্ষণজীবী। কারণ আমরা জানি করোনা ভাইরাসের পরে আর একটা প্রাণঘাতী ভাইরাস গুটি গুটি এসে পড়ে। জীব বিজ্ঞানীরা সে ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে পারেন নি। সে ভাইরাসও নিজের রূপ পরিবর্তন করে, তারও মিউটেশন হয়। শুধু অর্থনীতিবিদরা সে ভাইরাসের কথা জানেন। তার নাম ক্ষুধা ভাইরাস। ক্ষুধা মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়। মানুষকে পশুতে পরিণত করে। এইজন্য একজন বাঙালি কবি লিখেছিলেন : ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃধিবী গদ্যময়’।
করোনার পরে ক্ষুধা ভাইরাস আসতে বাধ্য। কর্তারা লক ডাউনের বিধান দিয়েছেন। না দিয়ে উপায় নেই। অদৃশ্য করোনা সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষের নাকে-মুখে। তাই মানুষের কাছ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন না করে উপায় নেই। তাই লক ডাউন। কিন্তু এতে খাদ্যের উৎপাদন ও জোগানও যে প্রকারান্তরে লক ডাইন হয়ে গেল। মানুষ যখন খাদ্য পাবে না, তখন সে ঘর ভেঙে বেরিয়ে আসবেই। করোনায় মরার আগে ক্ষিধের জ্বলায় মরবে বলে সে বেরিয়ে আসবে। তার নাম বিদ্রোহ। তখন ?
তারপরে পরিবেশদূষণের কথা। জানেন তো, কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা। তথাকথিত সভ্য মানুষের মনটাও তেমনি। করোনা বিদায় নেবার কিছুদিন পরে আবার দেখবেন কলকাতা-প্যারিস=লণ্ডন-ঢাকা-নিউইয়র্ক তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে আবার শব্দ, শব্দের মিছিল। আবার ধোঁয়া, ধোঁয়ার কুণ্ডলি। দেখবেন মৃত্যুভয়ে যেসব অপরাধীরা সিঁটিয়ে ছিল আবার তারা তেড়ে-ফুঁড়ে উঠেছে।আবার সাম্যবাদ কথার কথায় পর্যবসিত। আবার সেই ভেদ-বিভেদ, আবার সেই সর্পিল কূটনীতির প্যাঁচ।
তাই বলছিলাম করোনার করুণা আখেরে তা বেশি না।
৭২. পর্ণশ্রী কলকাতা=৭০০ ০৬০ + ৯৯০৩৮৮৪৪১০