ঘর ভেতর ঘর । চুপচাপ বসে আছি । চারপাশে নাচছে আতঙ্কের ছায়া । স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ । রাস্তা-ঘাটে লোক কম । বড়বাজারের মতো গমগমে জায়গাও শুনশান । ট্রামে-বাসে লোক নেই । বন্ধ সভা-সমিতি । সকলের মুখে আতঙ্কের ছায়া । কখন যে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়বে চোর ! যারা খুব সতর্ক, তারা মুখে পরে নিচ্ছে মাস্ক । মাস্কও রেহাই দেবে না সে কথা জেনেও ।
আজ আমাদের একটা সাহিত্যসভা ছিল । সন্ধ্যেবেলায় । সকাল থেকে এক এক করে ফোন আসতে লাগল । সবার প্রশ্ন, এ অবস্থায় যাই কি করে ! ঠিক কথা । চাচা আপন প্রাণ বাঁচা । জান বাঁচলে তবে তো সাহিত্য । তবু আমার ঘরে দুতিন জন বন্ধু এল । সন্ধেবেলায় । কাহাঁতক আর বন্দি হয়ে বসে থাকা যায় ঘরের কোণে !এল নস্করবাবু, করণবাবু আর বনি । মুখে মাস্ক এঁটে এসেছিল করণবাবু, ঘরে ঢুকে খুলে ফেলল । তার ছেলে-মেয়ে সতর্ক করে দিয়েছে । আমার মেয়েও বাসে-ট্রেনে চড়তে বারণ করেছে, সব সময় গলা ভিজিয়ে রাখতে বলেছে । আমার ঘরে ঢুকে বন্ধুরা এক মিটার দূরত্ব রেখে বসল । এরকম নির্দেশ । আমার অতিথিপরায়ণা স্ত্রী মুড়ি-তেলেভাজা নিয়ে আসতে সকলে হাত ধুয়ে এল । এ তাগিদ আগে দেখিনি । আতঙ্ক ।
নস্করবাবু বলল, আমাদের রাজ্যটায় আতঙ্ক তৈরি করে দিল অক্সফোর্ডের পড়ুয়া সরকারি আমলার ছোকরাটা। করোনা ভাইরাসের প্রথম দৃষ্টান্ত ।
এমন সময়ে আমাদের পাশের বাড়ির অনুপ এল । বলল, দাদা দু বস্তা চাল, এক বস্তা আলু কিনে আনব । সেই সঙ্গে পোস্ত আর ডাল । কদিনবাদে আকাল আসবে । মাল আনার লরি-টরি আসছে না ।
অনুপের কথা বাস্তবসম্মত । সমর্থন করল বন্ধুরা । কিন্তু কতদিন চলবে এভাবে ! এ তো বান-বন্যা নয়, নয় ভূমিকম্প । এ যে চলছে চলবে । কেউ জানে না কতদিন । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একে যুদ্ধ পরিস্থিতি বলছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ ঘরে কপাট এঁটে বসে আছে । প্রহর গুনছে আতঙ্কে । সিঁধ কেটে কখন যে ঘরে ঢুকে পড়বে সিঁধেল চোর । জানতেই পারব না । ধরব কি করে ! ধরতে হলে অস্ত্র চাই । সে অস্ত্র তৈরিই হয় নি এখনও । আমেরিকা নাকি চেষ্টায় আছে ।
আমি ভাবছিলাম করোনার কথা । করোনা একটা ভাইরাস । অণুজীব । দেখা যায় না চোখে । এত ক্ষুদ্র। কিন্তু ক্ষুদ্র হলে কি হবে আল্লা বা ভগবানের মতো দারুণ শক্তি তার । পশু থেকে মানুষে, মানুষ থেকে মানুষে তার যাতায়াত । দারুণ ছলনাময় । শরীরে ঢুকে বদলে ফেলে রূপ । চেনা জিনিস হয়ে যায় অচেনা। কপালে ঘাম ছুটিয়ে বিজ্ঞানীরা বসে থাকেন গবেষণাগারে । ধরতে পারেন না তাকে । ‘এই আছে এই নেই আছে এই দূরে কাছে ঘুরে নাচে ।’ আতঙ্ক না থাকলে এরকম বর্ণচোরাকে নিয়ে কৌতুকনাট্য লেখা যেত । কিন্তু আতঙ্কে যে শরীর শিথিল । চুপ, (আদালত নয়) করোনা চলছে ।
গতমাসের শেষ দিকে বেড়াতে যাবার সময় শুনে গিয়েছিলাম চিনের উহানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ । চিনে হয়েছে তো আমাদের কি ! জিকা, ইবোলা, সার্স ভাইরাসও তো অতীতে আবির্ভূত হয়েছিল ধরাধামে । ও আস্তে আস্তে থেমে যাবে । এ মাসের প্রথম সপ্তাহেও তেমন সরগোল ছিল না । কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা বুঝিয়ে দিতে লাগল সে যে-সে চিজ নয় । তার পাখায় বিমানগতি । ইতালি, ইরান, স্পেন, দঃ কোরিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ইস্রায়েলে ত্রাহি ত্রাহি রব । প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা । এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সংযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । আতঙ্ক । মানুষের গা ঘেঁষে চলতে ভয় পাচ্ছে মানুষ । আতঙ্ক । দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি হবার উপায় নেই । আতঙ্ক । সবার অবস্থা সমান । আশ্চর্য সাম্যবাদ । পৃথিবী এখন সত্যিকারের গ্লোবাল ভিলেজ । আতঙ্কে মিলেছে সবাই ।
আতঙ্ক আর হতাশায় ডুবে যাচ্ছি । কি হবে, এরপর কি হবে । করোনা ভাইরাস কি শেয করে দেবে সাধের পৃধিবীকে । নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হবে কি ! হতাশায় ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেলাম । বাঁচিয়ে দিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত । তিনি লিখেছিলেন : ‘মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি / বাঁচিয়া গিয়াছি বিধির আশিসে অমৃতের টিকা পরি’ । একালে বিধি হল বিজ্ঞান । সে আমাদের পরিয়ে দেবে অমৃতের টিকা । ভাবলাম বিজ্ঞান আছে, বিজ্ঞানীরা আছেন । ডুবন্ত পৃথিবীকে টেনে তুলবেন তাঁরা ।
এই আশা নিয়ে রাত্রিবেলা ঘুমুতে যাচ্ছিলাম । ফোন এল । আমেরিকা থেকে । আমার এক বন্ধুর ছেলে ফোন করেছে । তাকে শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার বই পাঠাতে হবে । সে ছোকরা বিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু সাহিত্যে অনুরাগ । এতকাল বিদেশে থেকেও বাংলায় চিঠি লেখে, পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে । সে বিদেশে বাঙালিদের নিয়ে সংগঠন করেছে । সেখানে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক হয় । বাংলায় । অথচ আমাদের এদেশে বাঙালি ছেলেরা ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়ে, পারতপক্ষে বাংলায় কথা বলে না । তাত নাকি স্টেটাস থাকে না ।
বন্ধুর ছেলের কাছে জানতে চাইলাম আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের টিকা-ফিকা কিছু বেরুল কিনা । আমার প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল । তারপরে বেশ রাগী গলায় বলল, চেষ্টা হচ্ছে । হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বেরুবে কিছু । গরু মেরে জুতো দান আর কি !
একি কথা !
গরু মেরে জুতো দান ! তার মানে দাঁড়াল বিজ্ঞানীরা মানুষ মেরে তারপরে বাঁচাবার চেষ্টা করেন। কেন সে একথা বলল জানতে চাইলাম । সে বলল, কামান-বন্দুক-গুলি-গোলা এসব তো বিজ্ঞানীদের হাতের কাজ, এরাই তো আ্যটম বোমা তৈরি করেছে । এসব অস্ত্র দিয়ে আজ পর্যন্ত কত প্রাণী, কত মানুষ মারা হয়েছে তার হিসেব করতে পারবেন কাকু !
সে বলে গেল, বিজ্ঞানীদের মারণাস্ত্রে কত মানুষ মরেছে তা শুনলে শিউরে উঠবেন কাকু । দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি মানুষ মরেছে, হিটলার আর স্টালিনের আমলে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে কোতল করা হয়। আ্যটম বোমায় হিরোসিমা আর নাগাসাকিতে ২লক্ষেরও বেশি মানুষ মরেছে । দেশে দেশে যে সব গৃহযুদ্ধ হব তাতেও বহু মানুষ মরেছে ।
তার কথা শুনে ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে গেলাম । কিন্তু তার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কি সম্পর্ক ! সে তখন বলল, কাকু, বিজ্ঞানীরা খারাপ খারাপ রোগের ভাইরাস তৈরি করে তাদের গবেষণাগারে । রাজনীতিবিদরা সেই সব ভাইরাস শত্রুদেশের উপর ছড়িয়ে দেয় । এভাবে ব্যাপক প্রাণহানি আর শস্যহানি হয় । এর নাম বায়োলজিকাল ওয়্যার বা জীবাণু যুদ্ধ । এসব নিয়ে একটু পড়ুন । নেটেই পেয়ে যাবেন । এ যুগের সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধ হল জীবাণু যুদ্ধ । তর্জন-গর্জন নেই, হৈ-হল্লা নেই, চুপিসারে কেল্লা ফতে । হাতে মারা-ভাতে মারা দুই । রামায়ণের মেঘনাদ যেমন মেঘের আড়ালে যুদ্ধ করত, এ কালের নেতারাও তেমনি । বাইরে শান্তির অবতার, ভেতরে টগবগ ফুটছে অশান্তির আগুন । আ্যনথ্রাক্স, ইয়েলো ফিভারের ভাইরাস তো বিজ্ঞানীরাই সৃষ্টি করেছিল ।
আমি জানতে চাইলাম করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে তার কিছু সন্দেহ হয় কিনা ! সে বলল, চিনের উহানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পরে আমেরিকা অভিযোগ করল চিন গোপনে এই ভাইরাস তৈরির চেষ্টায় ছিল, আবার চিন পাল্টা অভিযোগ করল আমেরিকার সেনাবাহিনী এই ভাইরাস ছড়িয়েছে । এসব চাপান-উতোর থেকে মানুষের মনে সন্দেহ তো দানা বাঁধবেই । আসলে কি জানেন, এখন বিজ্ঞানীরা রাজনীতিবিদদের ‘উপাধিধরা ভৃত্যে’ পরিণত হয়েছেন । ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে । কিন্তু পাল্লাভারি এদিকে । বড় দুঃখে রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল : ধরার বক্ষ চিরিয়া চলুক বিজ্ঞনী হাড়গিলা........।
ছোকরার গভীর-গম্ভীর কথা শুনে সে রাতে চটকে গেল আমার ঘুম । নৃত্যময় করোনা ভাইরাসের বিভীযিকা দেখতে লাগলাম চারদিকে । পরম উল্লাসে সে নেচে চলেছে তাতা থই থই তাতা থই থই । তার সঙ্গে নেচে চলেছেন আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা । এঁরা হলেন বিভিন্ন দেশের মাথা । গণতন্ত্রের পূজায় নিজের নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন । কিন্তু গণতন্ত্রের ভেতরে আছে স্বৈরতন্ত্রের কালনাগিনী । দরকার মতো ফোঁস করে ওঠে । এঁরা দক্ষ বাজীগর । হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের এঁরা নাচান, নাচিয়ে চলেন । করোনার মতো এঁরা ছলনাময় । করোনার মতো এঁরা নীরব ঘাতক ।
[ লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক]
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct