ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যারা দেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট দিয়ে থাকে, তারা বলেছে, সৈয়দ আলী শাহ গিলানির আবেদন ‘এ অবস্থায় অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে না’। কাশ্মীরের স্বাধিকারবাদী নেতা গিলানি জেদ্দায় তার অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যেতে অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। গিলানিকে পাসপোর্ট না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে— আবেদনপত্রে তিনি জাতীয়তার ঘর খালি রেখেছেন, তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিক, যেটা এক ‘বিতর্কিত ভূখণ্ড’। বিজেপি ও তার জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জোট মিত্র পিডিপি এ ব্যাপারে একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। পিডিপির প্রধান মেহবুবা মুফতির যুক্তি হচ্ছে— ‘মানবিক’ কারণে গিলানিকে পাসপোর্ট দেওয়া উচিত। আর বিজেপি বলছে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ‘ক্ষমা’ না চাওয়া পর্যন্ত তাকে পাসপোর্ট দেওয়া যাবে না।
বিজেপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, ‘গিলানি যদি স্বীকার করে নেন যে তিনি একজন ভারতীয় এবং ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন না, তাহলেই শুধু ভারত সরকার তার অনুরোধ ভেবে দেখতে পারে।’ বস্তুত বিজেপির জম্মু ও কাশ্মীরের মুখপাত্র খালিদ জাহাঙ্গীরও তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘কাশ্মীর উপত্যকায় ঝামেলা তৈরির জন্য গিলানি দায়ী, তার কাশ্মীর-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি সবার জানা। ফলে আমি মনে করি, তাকে পাসপোর্ট দেওয়ার মধ্যে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। গিলানি গত মে মাসে ট্র্যাভেল ডকুমেন্টের জন্য আবেদন করেছিলেন, এখন সরকার তাকে নয় মাসের জন্য পাসপোর্ট দিয়েছে। ওদিকে সুষমা স্বরাজ ললিত মোদিকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভ্রমণের নথি জোগাড় করতে সহায়তা করেছেন। এ দুটি ঘটনা এখন তুলনায় আনা যাক। সুষমা স্বরাজ ব্যক্তিগতভাবে এক ব্রিটিশ মন্ত্রীকে ফোন করে তার দেশের আইন অনুসারে ললিত মোদিকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিলেন।
পরবর্তীকালে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুষমা বলেছেন, তিনি ললিত মোদিকে ‘মানবিক’ কারণে সহায়তা করেছেন। খুব বেশি হলে এ কথা বলা যায়, সুষমা কাজটা অসতর্কভাবে করে ফেলেছেন, তাকে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে বলা উচিত ছিল। এর বদলে কংগ্রেস তার পদত্যাগ দাবি করেছে। শুধু তা-ই নয়, কংগ্রেস সংসদে এ নিয়ে শোরগোল তুলেছে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যখন লোকসভায় দাঁড়িয়ে বললেন, সুষমা স্বরাজ এ বিষয়ে বিবৃতি দেবেন, তারপর সে বিষয়ে বিতর্ক করবেন, ব্যাপারটা তখনই শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে তার পদত্যাগ দাবি করে বলল, তিনি পদত্যাগ করার পর আলোচনা হবে। দৃশ্যত, কংগ্রেসের হাতে ইস্যু নেই। সুষমা স্বরাজ ললিত মোদির কাছ থেকে অর্থ বা অন্য আনুকূল্য নিয়ে তাকে ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছেন, সেটা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কংগ্রেস সুষমার পদত্যাগ দাবি করতে পারে না। এটা সত্য, সুষমার স্বামী ললিত মোদির আইনজীবী। এ কাজে তিনি নতুন নন, অনেক দিন ধরেই তিনি ললিতের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে জোর গলায় বলা যাবে, সুষমা স্বরাজ ললিত মোদিকে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়ার আগে তার স্বামী ললিতের কাছ থেকে আনুকূল্য পেয়েছেন। কংগ্রেস প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করতে পারে না। তারপরও সুষমার উচিত হবে না তার ক্ষমতা এমনভাবে কাজে লাগানো, যাতে মানুষের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। তিনি বিজেপির একজন শ্রদ্ধেয় নেতা। হয়তো সমাজতান্ত্রিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি উদার, কাজে-কর্মেও তিনি তা-ই। ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সংসদকে তামাশার জায়গা বানিয়ে ফেলেছে। তারা ছোট ছোট বিষয় বাছাই করে সেগুলোকে সংসদে বিতর্কের পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেগুলো হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণেরও যোগ্য নয় বললেই চলে। এটা সত্য যে তারা এর মাধ্যমে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তারা সর্বোচ্চ নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষকে নৈরাশ্যবাদী করে তুলছে। এই ঘটনাটিই খেয়াল করুন না।
সৈয়দ আলী শাহ গিলানি জম্মু ও কাশ্মীরের একজন কট্টরপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা, আর ললিত মোদি আইপিএলের ম্যাচ গড়াপেটা থেকে শুরু করে জুয়ার একাধিক ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ভারতে অভিযুক্ত। দু’জনের ব্যাপারই কমবেশি একই রকমের। গিলানি জেদ্দায় তার অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, আর ললিত মোদি পর্তুগালে তার ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সুষমার ব্যাপারে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু বিজেপির নেতৃত্ব বোঝেন, সুষমার উদার ভাবমূর্তির কারণে দোদুল্যমান ভোটারদের ভোট পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এই মানুষদের ভোটের কারণেই বিজেপি ক্ষমতায় যেতে পেরেছে। আর স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেখা গেল, কেন্দ্রে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুসলিম ভোট গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে দেশ একদিকে মুসলিম লীগের ধর্মীয় নসিহত এবং অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার হিন্দুত্ববাদী উসকানিকে উপেক্ষা করে বহুত্ববাদী ধারায় পরিচালিত হয়ে গর্ববোধ করেছে, তার জন্য এটা খুবই দুঃখজনক এক শিক্ষা। সেখানে বামদের করুণ দশা দেখলে বোঝা যায়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। সমাধানের আংশিক উপায় এ রকম—যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, তাদের মাঠে ফিরে যেতে হবে, জনগণের মন জয় করতে হবে। এটা অত সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু এর অন্যথা হওয়ার জো নেই।
ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগ যা-ই করুক, সে সময় কংগ্রেস কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। কিন্তু গত ছয় দশকে কংগ্রেসের সরকার যা যা করেছে, তাতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর আমরা তার ফল ভোগ করছি। সংসদীয় কার্যক্রম ব্যাহত করার কংগ্রেসী কৌশলের ব্যাপারে ফেরত আসি। এটা দুর্ভাগ্যজনক, কংগ্রেসের নেতা কপিল সিবাল সংসদের কার্যক্রমকে ব্যাহত করার ঘটনার সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা সংসদীয় কৌশলের অংশ, আর বিজেপিও অতীতে তেমন নজির স্থাপন করেছে।
সর্বদলীয় বৈঠকে রাজ্যসভার বিরোধী নেতা গোলাম নবী আজাদ বলেছেন, তাদের পদত্যাগের দাবি মানা না হলে তারা সংসদকে কার্যকর হতে দেবেন না। এই ঔদ্ধত্য সত্ত্বেও কংগ্রেসের একটি অংশ বোঝে, এই কৌশল হালে তেমন পানি পাবে না, আর এতে তারা সংসদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারেন। এসব ঘটনাপ্রবাহের যে নেতিবাচক ফলাফল সৃষ্টি হবে, তা খুব একটা স্বাস্থ্যকর হবে না। আমার ভয় হচ্ছে, পুরো বর্ষাকালটাই নষ্ট হবে। এতে শুধু ভারতের শক্তি ক্ষয় হবে, উন্নয়ন ব্যাহত হবে। মহাত্মা গান্ধী এ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, তা এখনো প্রণিধানযোগ্য—পথ খারাপ হলে লক্ষ্যও খারাপ হতে বাধ্য। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো নয়।