তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান সে দেশে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চলার পর প্রথম সাক্ষাৎকারটি দেন আমেরিকান স্যাটেলাইট টেলিভিশন সিএনএন-কে। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার পর থেকে কিভাবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন, অভ্যুত্থানের সাথে জড়িতদের কী ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা হতে পারে, গণমাধ্যমের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি কী, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত ফেতুল্লাহ গুলেনের প্রত্যর্পণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলাপ আলোচনা কোন পর্যায়ে রয়েছে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন। সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল’স ‘কানেক্ট দি ওয়ার্ল্ড’-এর উপস্থাপক বেকি অ্যান্ডারসন সাক্ষাৎকারটি নেন। সাক্ষাৎকারটিআপনজন পাঠকদের জন্য নিম্নে তুলে ধরা হলো-
বেকি: মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদেরকে প্রথম সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিণতি নিয়ে কথা বলার আগে ওই রাতে কী ঘটেছিল, সেই আলোচনায় ফিরে যেতে চাই। আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি কী করছিলেন? আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন অভ্যুত্থানের বিষয়টি?
এরদোগান: আপনাকে অত্যন্ত ধন্যবাদ। ১৫ তারিখে আমি পরিবারের সাথে ছিলাম। আমরা পাঁচ দিনের ছুটিতে মারমারিসে ছিলাম। ওই দিন রাত ১০টার দিকে কিছু খবর পাই। আমাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়। ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা এবং আরো কয়েকটি জায়গায় কিছু কিছু মুভমেন্ট চলছে। আমরা তখনই মারমারিস থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমার সাথে স্ত্রী, আমার মেয়ের জামাই, আমার নাতি-নাতনীরা ছিল। ফলে বিষয়টা আরো গুরুতর ছিল বলে মনে করতে পারেন। তবে সেখান থেকে চলে যাওয়ার আগে আমি স্রেফ ক্যামেরা আর মিডিয়াকে ডাকতে চাইলাম। আমি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে পুরো তুর্কি জনগণের কাছে পৌঁছাতে চাইলাম।
কিন্তু জাতীয় সম্প্রচার-ব্যবস্থা সবার টিভি, বাড়িতে পৌঁছেনি। এ কারণে মিডিয়া ও সম্প্রচারের জন্য আমাকে ‘প্লান বি’-এর সাহায্য নিতে হলো। আমাদের কাছে ছিল সেলফোন, স্মার্টফোন। আমরা কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে স্মার্টফোনের সাহায্যে লাইভ টিভির পথ বেছে নিলাম। এসব সম্প্রচারের মাধ্যমে আমি জনগণকে রাজপথের দখল নিতে, নগরীর চত্বরগুলোতে জমায়েত হতে বললাম। এই আহ্বান জানানোর সাথে সাথে প্রথম যে সাড়া পেলাম, তাতে আমাকে জানানো হলো, জনগণ সত্যিই ব্যাপক হারে রাস্তায় নেমে এসেছে। এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূণ। কারণ ক্ষমতা দখলে ইচ্ছুক, অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীদের মোকাবেলার এই একটা পথই ছিল, জনগণের মাধ্যমে পাল্টা অভ্যুত্থান করা। আমাদের জনগণ সেটাই করেছে।
বেকি: আপনি ফেসটাইম ব্যবহার করে আমাদের সহযোগী চ্যানেল সিএনএন টার্কের এয়ারওয়েভ বেছে নিয়েছিলেন। আপনি আপনার সমর্থকদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এই প্রথম আপনাকে কেউ দেখতে পেলেন। আপনি কি একমত হবেন, বেসরকারি মালিকানাধীন, নিরপেক্ষ একটি চ্যানেলের মাধ্যমে আপনার আহ্বান এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হবে? আপনার অভিজ্ঞতায়, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রশংসা একটা মাত্রা পর্যন্ত আপনাকে করতেই হবে।
এরদোগান: অবশ্যই। আমরা সবসময়ই স্বাধীন গণমাধ্যম, বেসরকারি মালিকানাধীন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের প্রসারের পক্ষে রয়েছি। আমাদের সরকারের ১৪ বছরের শাসনামলে আমরা সবসময় এসবের ব্যবস্থা করেছি। আমরা অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর করেছি, আমরা এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সমর্থন করেছি। আর সিএনএন ওই রাতে আমাদের বক্তব্য সম্প্রচার করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমরা রাজি হলাম। বক্তব্য প্রচার করা প্রথম চারটি চ্যানেল ছিল সিএনএন, হ্যাবেশ, এনটিভি এবং এনটিজিআরটি।
বেকি: ওই রাতে মত প্রকাশে আপনার নিজের স্বাধীনতা লাভের সুযোগটি বিবেচনা করে আপনি কি এখানে থেকে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে স্বাধীন মিডিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন? আমরা পরবর্তী বিষয়ে যাওয়ার আগে স্রেফ এটা জানতে চাইছি।
এরদোগান: বেকি, শুনুন। মুক্ত সংবাদমাধ্যমের সাথে আমার কোনোকালেই সমস্যা ছিল না। কেউ যদি বলে, তুরস্কে এখনো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, তবে যা বলব তা হলো : তুরস্কে অভ্যুত্থানচেষ্টা হয়েছে। অনেকে অভ্যুত্থানকারীদের সাথে ছিল। আবার অভ্যুত্থান চেষ্টার বিরুদ্ধেও অনেক মিডিয়া অবস্থান নিয়েছিল। তাই আমার প্রশ্ন হলো, অভ্যুত্থান সমর্থকারী মিডিয়ার বিরুদ্ধে কি তুর্কি বিচারব্যবস্থা কোনো পদক্ষেপ নেবে না? অবশ্যই নেবে। কেন? কারণ অভ্যুত্থান চেষ্টাকে দমন করতে চাইলে যারা এর সাথে রয়েছে, তাদেরও তাদের উপযুক্ত জায়গায় রাখতে হবে, তা-ই না? তাদের সাথে উপযুক্ত আচরণ করতে হবে, তা না হলে নাগরিকেরা, জনগণ ভুল তথ্যে প্রতারিত হবে। অন্য দিকে, আমরা এমন এক পরিস্থিতির কথা বলছি, যেখানে ২৮০ জন তাদের জীবন হারিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ১,৫০০ লোক আহত হয়েছে। ১৫০ জনের অবস্থা গুরুতর। জনগণই আমাকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আমি যদি কিছু না করি, তারা সময় এলে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। সেটা ঠিকই হবে। আর মারমারিসেও আমার বিরুদ্ধে অভিযান চলেছে। আমার দুই ঘনিষ্ঠ দেহরক্ষী শহীদ হয়েছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমি সেখানে আর ১০ থেকে ১৫ মিনিট থাকলে আমি নিহত হতাম বা আমাকে আটক করা হতো। অবশ্য নিজেদের মধ্যে, আমাদের বন্ধুদের সাথে আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি। তারপর আমরা স্থান পরিবর্তনের আয়োজন করি। এতেই আমাদের আটক করার ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এখন আমাদের সব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং যারা আহত, তাদের আরোগ্য লাভের জন্য কিছু করতে হবে।
বেকি: ওই রাতে কী ঘটেছিল, তাতে ফিরে যাই। আপনি ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে পৌঁছালেন। সিএনএন টার্কের ফেসটাইম সম্প্রচারের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই ফ্লাইটে কী ঘটছিল? কারণ খবর পাওয়া যাচ্ছিল, জঙ্গিবিমানগুলো আপনার বিমানের জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করছিল। সত্যি সত্যি তাদের রাডার আপনার বিমানকে লক্ষ করেছিল বলে খবর পাওয়া গেছে। আপনি কি তখন তা জানতেন?
এরদোগান: তখন কী ঘটছিল, আমাকে সাথে সাথেই সব কিছু সঠিকভাবে জানানো হচ্ছিল। তারা ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক বিমানবন্দরের ফ্লাইট টাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করছিল। আমার ফোনের মাধ্যমে ইস্তাম্বুলের নিরাপত্তাপ্রধান, পুলিশপ্রধানকে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম। আর আমি তাকে ফ্লাইট কমান্ড সেন্টার বা ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের টাওয়ার নিয়ন্ত্রণকারী অভ্যুত্থানকারীদের হটিয়ে দিতে নির্দেশ দেই। আর তারাসেই অভিযানটি সফল করে, সেখান থেকে তাদের উপস্থিতির অবসান ঘটায়। আমরা ছিলাম আকাশে। ফলে যোগাযোগে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। ফ্লাইটের সময় আমার পাইলটদের সাথে কথা বলছিলাম। আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কতক্ষণ আকাশে থাকতে হবে? তারা বলল, আমাদের লাগবে তিন থেকে চার ঘণ্টা। আর আমাদের যাত্রা শুরু থেকে আতাতুর্ক বিমানবন্দরে অবতরণের আগে পর্যন্ত এফ-১৬এস জঙ্গিবিমান আমাদের ওপর দিয়ে, মাটির খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সেগুলো সম্ভবত শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটছিল। আপনি জানেন, শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটলে, যেটাকে বলা হয় সনিক বুম, যে শব্দ হয় সেটা বোমা ফেলার শব্দ বলে ভুল হতে পারে। দুই ধরনের শব্দই একই রকম। আবার আমরা শুনলাম, বিমানবন্দরে ১০ হাজারের বেশি লোক উপস্থিত রয়েছে। আমরা এভাবেই সেখানে পৌঁছি। বিমান থেকে বের হয়ে লোকজনের সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ হয়।
বেকি: ইস্তাম্বুল অবতরণের কোনো পর্যায়ে কি আপনার মনে এমন কোনো চিন্তার সৃষ্টি হয়েছিল যে, আপনি আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নন?
এরদোগান: এমন কথা একবারও আমার মাথায় আসেনি। কারণ আমার সহকর্মীরা আমার সাথে ছিল। তা নিয়ে একবারও চিন্তা করিনি, সে ধরনের সমস্যার কথা ভাবিনি। আর আমার প্রথম ঘোষণা, প্রথম বক্তব্যের পর থেকে তুরস্ক রাষ্ট্র অটুট ছিল, সরকার কাজ করছিল, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় ছিলেন। উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো কারণ ছিল না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব হানাদার থেকে মুক্তি পেতে হবে। আর তাতে লেগেছিল ১২ ঘণ্টা। ১২ ঘণ্টাতেই হয়ে গিয়েছিল। আমরা যা চেয়েছিলাম, তা হাসিল করতে পেরেছি।
বেকি: আর প্রথম দিকে যারা বলছিল, আপনি নিজেই এসব ঘটাচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?
এরদোগান: দেখুন, আমি বলব, এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমি বলতে চাচ্ছি, আমি কিভাবে এসব ঘটাব? কিভাবে আমি এত লোকের প্রাণহানির কারণ সৃষ্টি করব? ২০৮ জন বেসামরিক লোক প্রাণ হারাল, ১,৫০০ লোক আহত হলো, ট্যাংক আটকানোর জন্য লোকজন মাটিতে শুয়ে পড়ল। এটা কিভাবে করা সম্ভব? মানুষের বিবেক কিভাবে সেটা করতে দিতে পারে? না, সেটা কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। আর তাইয়্যেপ এরদোগান, তার বন্ধু ও সহকর্মীরাই প্রথম এ মধরনের কাজ প্রত্যাখ্যান করবে সবার আগে। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে আমরাই সবসময় জনগণের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখেছি। আমরা এভাবেই রাজনীতি করি। যারা এসব কাজ করেছে, যারা এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তারাই এমন মানুষ, যারা সবসময় এ ধরনের কাজ করে থাকে। অর্থাৎ এটা আসলে একটা খারাপ কাজের পরিণতিতে ভালো কিছু হয়ে যাওয়া। এর ফলে ফতেহউল্লাহ গুলেনের সন্ত্রাসী সংগঠনটি এই দেশে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আঘাত লাভ করছে। কারণ তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে গেছে। এই গ্রুপটি অস্ত্র হাতে নিয়ে সেগুলো ব্যবহারের আগে পর্যন্ত নিরস্ত্র ছিল। এখন সবাই আসল বিষয়টি জানল। তারা এই জাতি, এই রাষ্ট্র, এই জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
বেকি: আর আপনি এমন একটি গ্রুপের দিকে ইঙ্গিত করছেন, যেটি পরিচালিত ও উদ্দীপ্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফতেহউল্লাহ গুলেন নামে এক লোকের মাধ্যমে। তিনি একজন ইসলাম প্রচারক। আপনি একেবারে দ্বিধাহীনভাবে তাকে গ্রেফতার কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যর্পণের দাবি করেছেন। এই পর্যায়ে তুরস্ক কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে?
এরদোগান: আমি প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে আলোচনার সময় কয়েকবারই সে অনুরোধ করেছি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও করেছেন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিখিতভাবে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতে যাচ্ছি। পাশ্চাত্য ও আফ্রিকান কয়েকটি দেশের কাছেও অনুরোধ করতে যাচ্ছি। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এসব অনুরোধ করব।
বেকি: আপনার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘কেউ গুলেনের পাশে দাঁড়ালে, সে আর তুরস্কের বন্ধু থাকবে না, সে তুরস্কের সাথে মারাত্মক যুদ্ধরত অবস্থায় থাকবে।’ তিনি স্পষ্টভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র এই পর্যায়ে গুলেনকে গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ না করলে কী হবে?
এরদোগান: খুবই সহজ ব্যাপার। আমি আগেও এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছি। এ কারণে প্রথমে আমাদের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতে হবে। আমরা প্রত্যর্পণের অনুরোধ করব। আনুষ্ঠানিক অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া না গেলে- যুক্তরাষ্ট্রের চোখে কেউ অপরাধী বিবেচিত হলে এবং তারা তার প্রত্যর্পণ চাইলে সেটা করা না হলে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তা কোনোভাবেই মেনে নেবো না। কারণ আমাদের পক্ষ থেকে কে অনুরোধ করেছে, তা কোনো ব্যাপার নয়, তাদের নিজেদের বিবেচনাতেই সন্ত্রাসী, আমরা সবসময় ওইসব লোককে প্রত্যর্পণ করি। অবশ্য, আমাদের মধ্যে অপরাধীদের পারস্পরিক প্রত্যর্পণের চুক্তি রয়েছে। ফলে এখন প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা হচ্ছে, আপনি আমার কৌশলগত অংশীদার, আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করলে, আমি আপনার কথা মেনে নিলে, আপনি কেন একই কাজ করবেন না? এমনকি তিনি (গুলেন) যুক্তরাষ্ট্রেরনাগরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো সন্ত্রাসীকে রাখতে পারে না। আর সন্ত্রাসী সংগঠনটি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের সরকারি নথিতে রয়েছে। আমরা কৌশলগত অংশীদার, আমরা মডেল অংশীদার। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে ওই ব্যক্তিকে তুরস্কে হস্তান্তর করতে হবে। আমি আশা করব, যুক্তরাষ্ট্র তা করবে।
বেকি: আচ্ছা, আপনাকে এটা জিজ্ঞাসা করছি এ কারণে যে, আপনি ফাঁকা বুলির লোক নন। আর আমি জানতে চাইছি, প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যে দেশই গুলেনের পেছনে থাকবে, তাদের সাথেই তুরস্কের মারাত্মক লড়াই হবে। এই পর্যায়ে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর হতে পারে?
এরদোগান: প্রধানমন্ত্রী ঠিক কী বলেছেন বা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা জানি না। তবে আমার কথা শুনুন। আমি যেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি, তারা সবাই আমাদের অনুরোধে ইতিবাচক জবাব ও সাড়া দিয়েছেন। তারা সবসময় পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে রয়েছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একসাথে আইনি কাঠামোর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। তারা এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত লোকদের প্রত্যর্পণের সুযোগ সৃষ্টির কথাও বলেছেন।
বেকি: যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় ফতেহউল্লাহ গুলেনের নাম নেই। ফলে (এখানকার প্রক্রিয়া থেকে সেখানকার প্রক্রিয়া ভিন্ন হবে) তাকে আপনি কিভাবে সন্ত্রাসী বিবেচনা করবেন?
এরদোগান : দেখুন, আপনি যে দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছেন, সেটা সত্যি সত্যি আরেকটি বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। কারণ যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো সন্ত্রাসীকে প্রত্যর্পণের জন্য তুরস্কের কাছেও অনুরোধ করে, তবে সেই লোক আমাদের সন্ত্রাসী তালিকায় না-ও থাকতে পারে। তখন আমরা কী বলব, আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? কোনো ব্যক্তি আপনাদের সন্ত্রাসী তালিকায় থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। কিন্তু সে যেহেতু আমার তালিকায় আছে, তাই অপরাধীদের প্রত্যর্পণের চুক্তি অনুযায়ী, আমি অনুরোধ করলে আপনার ওই ব্যক্তিকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। আর এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ আছে, তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, অনেক দেশেই এ ধরনের কাজ হয়ে থাকে। একই কথা প্রযোজ্য বিন লাদেনের ক্ষেত্রে। তিনি আফগানিস্তানের বিবেচনায় সন্ত্রাসী ছিলেন না, তাই তো? কী ঘটল? অনুরোধ জানানো হলো, সাড়া দেয়া হলো না। তখন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সেখানেই হত্যা করার উদ্যোগ নিলো। এই যুক্তিতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং প্রত্যর্পণ চুক্তিই প্রাধান্য পাবে, যেকোনো তালিকায় থাকা লোকজনই এই প্রক্রিয়ায় স্থান পাবে। আমরা যা বলছি, তা নিয়ে অনেক ফাইলপত্র তৈরি করেছি, সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো হবে।
বেকি: কখন হবে? চলতি সপ্তাহেই?
এরদোগান: চলতি সপ্তাহেই। পুরো প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি।
বেকি: মৃত্যুদণ্ড একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অভ্যুত্থান চেষ্টার প্রেক্ষাপটে লোকজন এ নিয়ে কথা বলছে। আর আপনি বলছেন, জনগণ চাইলে আপনি মৃত্যুদণ্ডাদেশ পুনর্বহালের জন্য সবার সাথে আলোচনা করবেন। আপনি কি এটা সমর্থন করেন? কারণ মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি গ্রিসে যাওয়া আট সৈন্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে গুলেনের সাথেও স্পষ্টভাবে সম্পর্কিত হবে। এ নিয়ে কী ভাবছেন?
এরদোগান: এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে, ২০৮ জন নিহত হওয়ায় নাগরিকেরা তা বলছে। তারা বারবার মৃত্যুদণ্ডাদেশের কথা বলছে। আমার প্রশ্ন হলো, আপনাদের যুক্তরাষ্ট্রে কি মৃত্যুদণ্ডাদেশ নেই? আছে। রাশিয়ায়? আছে। চীনে? আছে। হ্যাঁ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নেই। আর আমাদের দেশে, আমাদের প্রশাসনে আগে ছিল। আমরা ইইউর সদস্যপদ লাভের আলোচনার জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ বিলুপ্ত করেছিলাম। এখন বিষয়টা নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হতে পারে। নিশ্চিতভাবেই বলছি, অতীতে আমাদের প্রশাসনই এটা বিলুপ্ত করেছিল। কিন্তু আমরা যেকোনো সময় আগের অবস্থায় ফিরে সেটা পুনর্বহাল করতে পারি। পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
বেকি: তা হবে বলে কি আপনি মনে করেন?
এরদোগান : হতে পারে। কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনার পর লোকজন এটা নিয়ে ভাবছে। তারা মনে করছে, এসব সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলা উচিত। লোকজন এমনই ভাবছে। তাদের অবস্থান এটাই। তারা এ ছাড়া অন্য কিছু চায় না। অর্থাৎ যাবজ্জীবন বা আজীবন কারাদণ্ডে সন্তুষ্ট নয়। আমি কেন তাদের সারা জীবন কারাগারে রেখে খাওয়াব? লোকজন এ কথাই বলছে। তারা খুব তাড়াতাড়ি এর অবসান চায়। কারণ লোকজন তাদের স্বজনদের হারিয়েছে, তাদের প্রতিবেশীদের হারিয়েছে, তাদের শিশুদের হারিয়েছে।(অভ্যুত্থান চেষ্টার সময়) ৮০ বছর বয়স্ক, ১৫ বছরের, ২০ বছরের মানুষ (মারা গেছে)। এ কারণে লোকজন খুবই স্পর্শকাতর। এসব অনুরোধের মুখে আমাদের খুবই স্পর্শকাতরভাবে কাজ করতে হচ্ছে। আমি জনগণকে যা বলছি তা হলো, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুস্পষ্ট অপরাধ হয়েছে। আর আপনাদের অনুরোধ আমাদের সরকার কখনো প্রত্যাখ্যান করবে না। তবে সাংবিধানিক ব্যবস্থার আকারে পদক্ষেপ নিতে পার্লামেন্টারি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য নেতাদের বসতে হবে, এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তারা এ নিয়ে আলোচনায় একমত হলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পার্লামেন্টের যেকোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করব।
বেকি: ইতোমধ্যেই, আমি অনুমান করছি, আপনি এই অভ্যুত্থানের দায়ে আটক হাজার হাজার লোকের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন, ঠিক তো?
এরদোগান: অবশ্যই, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তবে এটা শেষ হতে কত সময় লাগবে, জানি না। অবশ্য বিচার বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। আমাদের বিচার বিভাগের প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা দিন-রাত সারাক্ষণ যেভাবে পরিশ্রম করছে, তাতে কেবল তাদের প্রশংসাই করতে পারি। একই কথা প্রযোজ্য তুর্কি জাতীয় পুলিশের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে আমাদের এমন লোক রয়েছে, যারা অভ্যুত্থানকারীরা যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে কাজ করতে অস্বীকার করেছিল। তারা অবশ্যই জনগণের সাথে রয়েছে। আমরা পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই চেষ্টা দমন করতে পেরেছি।
বেকি: আমরা যখন আটক ব্যক্তিদের নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তখন, আপনি বুঝতে পারছেন, ইনসারলিক এয়ারবেসে কী ঘটছে; তা আপনি জানেন। আমি জেনেছি, ঠিক আজকে সেখানে নতুন করে নিরাপত্তা অভিযান চলছে। সেখানে ১৫ হাজারের মতো মার্কিন সৈন্য রয়েছে। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। সেখানকার মার্কিন সৈন্যরা কি নিরাপদ? আর ওয়াশিংটনে অনেকে জানতে চাইতে পারেন, কারা করছে এমনটা? সেখানে এখন অনেক সামরিক ব্যক্তি রয়েছেন। ওয়াশিংটন কী কথা বলেছে?
এরদোগান: ওয়াশিংটন জানে, তুরস্কে কার সাথে কথা বলতে হবে। তারা আমাদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলেছে। তারা ওই সব স্থানেও কথা বলেছে। তাদের ফোনের জবাব দেয়া হয়েছে। তারা সবসময় সাড়া পেয়েছে। আমাকে বিষয়টা স্পষ্ট করতে দিন , ইনসারলিক নিয়েই কথা বলছি। তবে জেনে রাখুন, তুরস্কের সব ঘাঁটিতেই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর দরকার ছিল। আমরা বিদ্যুৎ বন্ধ করে না দিলে ওইসব ঘাঁটি থেকে বিমান উড়তে পারত। আর সন্ত্রাসীদের দখলে থাকা বিমান যদি উড়তে পারে, সেটা জনগণের জন্য এবং জাতির জন্য হবে মারাত্মক হুমকির কারণ। আমরা তা হতে দিতে পারি না। এ কারণেই আমরা এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। নিশ্চিতভাবেই বলছি, এটা সাময়িক পদক্ষেপ, দ্বিতীয় নির্দেশনার আগ পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় নির্দেশনায় অবশ্যই সব স্থানে বিদ্যুৎ চালু হবে। হবেই। তা নিয়ে কারোই কোনো উদ্বেগ বা চিন্তা করার দরকার নেই। এটা স্রেফ স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। যৌক্তিক কৌশল, যৌক্তিক পরিকল্পনায় কাজগুলো করা হচ্ছে।
বেকি: আচ্ছা, অভ্যুত্থান চেষ্টার পর আপনি এটাকে ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে নতুন তুরস্কের জন্য উপহার’হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। নতুন তুরস্ক কেমন হবে দেখতে? এটা কি আপনি যাদের বিরোধিতা করছেন এবং দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধিতা করে আসছেন, তাদের সাথে সহাবস্থান হবে?
এরদোগান: প্রথম কথা হলো, আমাদের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে নতুন করে সম্পর্ক সৃষ্টির ধারণা নেই। তবে যারা কখনোই সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত ছিল না, যারা তাদের দেশকে, পতাকাকে, জাতিকে, তুর্কি রাষ্ট্রকে ভালোবাসে, আমরা সবসময় ওইসব তুর্কিকে, ওই সব লোককে কাছে টেনে নেবো।
বেকি: প্রশ্নটা হলো সহাবস্থান কিংবা দমন অভিযান বলা হচ্ছে, সেটা নিয়ে?
এরদোগান: দেখুন, মিস. বেকি, আমি আপনার মতো কারো কাছ থেকে এ ধরনের কিছু শুনতে চাই না। কারণ দমন অভিযানের ধরন নিয়ে আমি কিছু জানি না। কোনো ধরনের দমন অভিযান চলছে বলে জানি না। কোনো ধরনের নির্যাতন চলছে বলে জানি না। এটা স্রেফ পরনিন্দা। আমি বোঝাতে চাইছি, দমন নীতির মাধ্যমে তাইয়েব এরদোগান হওয়া যায় না। কারণ তাইয়েব এরদোগান দমনপীড়ন চালালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫২ ভাগ ভোট পেতেন না। হয়তো পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমরা আসল পরিস্থিতির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাবো। কারণ জনগণকেই কিছু করতে দেয়া হলো, ঠিক কাজ। যদি জনগণ বলে এই লোকটি, এই ব্যক্তিটি ভালো মানুষ, ভালো কাজ করে, আমি মনে করি, এর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা উচিত। এর প্রতি আসলে কেউ কর্ণপাত করে না। কারণ তাদের মনোযোগ অন্য স্থানে, অন্য তথ্যের দিকে। অন্য স্থানের লোকজন কিছু মন্তব্য করে এবং আরেক স্থানের লোকজন তা অনুসরণ করে। এটা স্রেফ অগ্রহণযোগ্য। আর এটা আমাকে গভীরভাবে পীড়া দিয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনেকে ফতেহউল্লাহ গুলেনের কাছে গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, টুইন টাওয়ারে হামলার পর বিন লাদেন জীবিত ছিলেন। ওইসব মিডিয়া কি তার কাছে গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল? তখন তারা তার বক্তব্য সম্প্রচার করলে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হতো, তারা কী বলত? এগুলো কি ইতিবাচক হতো? একই বিষয় প্রযোজ্য যারা ফতেহউল্লাহর কাছে গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। তারা এই একই কাজ করেছে আগেও। কার সাথে? বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের কিংবা পার্বত্য এলাকার পল্লী অংশে জনগণের প্রতি সন্ত্রাস চালানো সাবেক নেতার সাথে। তারা এসব সাক্ষাৎকার নিয়ে বই প্রকাশ করে বিক্রিও করছে। কোনোভাবেই এসব কাজকে কোনো সাংবাদিক বা কোনো লেখকের পেশাদার কাজ বলে মনে করি না। কারণ কোনো লোক যদি সন্ত্রাসী হয়, তবে আপনি তাদের মর্যাদাবান করতে পারেন না বা তাদের ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। আপনি সেটা তরুণ প্রজন্মের কাছে করলে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বেকি: ধন্যবাদ, স্যার।
এরদোগান : অনেক অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct