মধুসূদনের বঙ্গবিজয় / দিলীপ মজুমদার
সময়সীমা মাত্র ছ’বৎসর । এর মধ্যে কোন ভাষা আয়ত্ত করে, সেই ভাষায় সাহিত্য রচনা ? সে রচনা আবার যেমন-তেমন নয়, কালজয়ী ? এ কি সম্ভব ? বিশ্ব সাহিত্যে কি এরকম কেউ আছেন ? জানি না। কিন্তু আমাদের বঙ্গ সাহিত্যে আছেন শ্রীমধুসূদন । মধুসূদন দত্ত । যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের রাজনারায়ণ দত্তের সন্তান । রাজনারায়ণ ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন । খিদিরপুরের একটা স্কুলে কিছুদিন পড়ার পরে ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে । ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দেখালেন দারুণ পারদর্শিতা । শুরু করলেন ইংরেজিতে কবিতা লেখা । ছাপাও হতে লাগল পত্র-পত্রিকায় । একটা স্বপ্নও অঙ্কুরিত হতে লাগল । ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে যশস্বী হবেন । শেলি, কিটস, বায়রনের মতো । চলে যাবেন শ্বেতদ্বীপ । মানে ইংল্যান্ড। । এমন সময় বাবার তাগিদ এল । বিয়ে করতে হবে । বাবা পাত্রী ঠিক করে রেখেছেন । বেঁকে বসলেন মধু । সম্বন্ধ করা বিয়ে ! নৈব নৈব চ । তিনি ইউরোপীয় রীতিনীতি আত্মস্থ করেছেন । কোর্টশিপই তাঁর পছন্দ । বিয়ে এড়াবার জন্য গ্রহণ করলেন খ্রিস্টধর্ম । হিন্দু কলেজ থেকে চলে গেলেন বিশপস কলেজে । সেখান থেকে মাদ্রাজ । কয়েক বছর মাদ্রাজে শিক্ষকতা আর সাংবাদিকতা করে ফিরলেন কলকাতায় । ১৮৫৬ সালে ।
তখনও মধুসূদন ভালো করে বাংলা লিখতে পারেন না । ‘পৃথিবী’ বানান লেখেন ‘প্রথিবি’ । বেলগাছিয়ার রাজাদের বাড়ি দেখতে গেলেন নাটক । এক সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ । তার মধ্যে কোথায় নাট্যরস? মধুসূদন গ্রিক নাটক পড়েছেন, শেক্সপীয়ার পড়েছেন । সে রকম নাটক তো নয় । এ যে অলীক কুনাট্য । মধু ঠিক করলেন তিনি বাংলায় লিখবেন নাটক । নতুন ধরনের । ইউরোপীয় রীতির আদলে । একের পর এক লিখে গেলেন ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড় শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ । আধুনিক বাংলা নাটকের পথিকৃৎ হলেন তিনি ।
ইংরেজরা আমাদের দেশে আসার পর থিয়েটারের চল হয় । নাটক দেখতে ভালোবাসে ইংরেজ । তারা থিয়েটার হল তৈরি করে সেখানে নাটকাভিনয় শুরু করে ।তখন আমাদের দেশেরা রাজা-রাজড়ারা তাঁদের বাড়িতে এরকম নাটকাভিনয় করার উদো্গ নিলেন । কিন্তু বাংলায় নাটক কই ? সংস্কৃতে আছে, তাই তার অনুবাদ করা হোক । মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের আগে কি কি নাটক ছিল ? ছিল জে সি গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’, তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’, হরচন্দ্র ঘোষের ‘ভানুমতী চিত্ত বিলাস’ ও ‘কৌরব বিয়োগ’, রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘ কুলীন কুলসর্বস্ব’-‘বেণীসংহার’-‘রত্নাবলী’ এইসব নাটক । মধুসূদনের মতে অলীক কুনাট্য ।
মধু কেন পাবেন বাংলা নাটকে পথিকৃতের সম্মান ? কারণ তিনি নাটকের বিষয়বস্তুর পরিধি বৃদ্ধি করেছেন।
শুধু ভারতীয় পুরাণ-মহাকাব্য নয়, তিনি হাত বাড়িয়েছেন গ্রিক পুরাণ আর ইতিহাসের দিকে ; তিনি এনেছেন ট্রজেডির রস; নাটকের আঙ্গিকে এনেছেন নতুনত্ব ; দুটি প্রহসনে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজবাস্তবতা ।
নাটকের মতো আধুনিক বাংলা কবিতারও পথিকৃৎ মধুসূদন দত্ত । পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে দেব-দেবীদের মাহাত্ম্যকীর্তন ছিল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একমাত্র বিষয় । এর মধ্যে অবশ্য সপ্তদশ শতকে চট্টগ্রামের আরাকান রাজসভার কবিদের কাব্য, ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গগীতিকায় এসেছে মানবিক বিষয় । মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘ব্রজাঙ্গনা’, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে পুরাণের ছায়ার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠল মানুষের আদল ।
মানুষ মানে ব্যক্তি মানুষ । গোষ্ঠীর মানুষ নয় । সেই মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভালো-মন্দ । নবজাগরণপর্বে এই ব্যক্তিমানুষের মুক্তি ঘটেছেল । উন্মোচিত হয়েছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার আবরণ । সে স্বাধীনতা শুধু পুরুষের নয়, নারীরও । কারণ নারীও মানুষ । রামমোহন শুরু করেছিলেন নারীস্বাধীনতার আন্দোলন । বিদ্যাসাগরে তার পরিপূণতা । বিদ্যাসাগর নারীস্বাধীনতার জন্য নারীশিক্ষাকেও হাতিয়ার করলেন । মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ নারীস্বাধীনতার কাব্যরূপ । এ কাব্যের নারীরা পৌরাণিক নারী । দ্রৌপদী, শকুন্তলা, দুঃশলা, জনা, উর্বশী এরা সব । কিন্তু এরা কথা বলছে, ক্ষোভ ও অভিযোগ জানাচ্ছে, অভিমান করছে একেবারে আধুনিক নারীর ভাষায় । ব্যক্তিস্বাধীনতার ভাব প্রকাশে এই সব নারীরা বীরাঙ্গনা । বীরাঙ্গনা ‘মেঘনাদবধে’র প্রমীলাও, যে বিপন্ন স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কোন বাধাকে গ্রাহ্য করে নি । প্রমীলা শুধু পত্নী নয়, সে যথার্থ অর্থে সহধর্মিনী ।
রামায়ণ. মহাভারত আমাদের বহুবন্দিত মহাকাব্য । ইলিয়াড, অডিসির মতো স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্য । যুগ বদলেছে । এখন আর স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্য হয় না । এখন হয় সাহিত্যিক মহাকাব্য । পাশ্চাত্যে ভার্জিল, তাসো, মিলটন সেরকম সাহিত্যিক মহাকাব্য লিখেছেন । মধুসূদন বাংলায় প্রথম লিখলেন সাহিত্যিক মহাকাব্য। ‘মেঘনাদবধ’ । সেই প্রথম, সেই শেষ । নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্ররা সে পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মধুর মতো সার্থকতা অর্জন করতে পারেন নি । সে মহাকাব্যের উপযোগী ছন্দ আবিষ্কারও করলেন তিনি । অমিত্রাক্ষর । মুক্তি ঘটল বাংলা ছন্দের ।
আধুনিক বাংলা কবিতার গতিপথ তিনি তৈরি করে দিলেন চতুর্দশপদী কবিতায় । যার ইংরেজি নাম সনেট। এ গুলি গীতি কবিতা । এসব কবিতায় স্বদেশ সম্বন্ধে, স্বদেশের নানা ব্যক্তি ও বস্তু সম্বন্ধে কবির ব্যক্তিগত ভাব-ভাবনা প্রকাশ পেল । পরে যে পথ ধরে হাঁটবেন বিহারীলাল, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথরা ।
এভাবেই মধুসূদন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন ।
এভাবেই মধুসূদন শেষ করলেন বঙ্গবিজয় । ( লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
৭২. পর্ণশ্রী কলকাতা= ৭০০ ০৬০ মোবাইল= ৯৯০৩৮৮৪৪১০
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct