পরিবর্তন (গল্প), তাসলিমা খাতুন: হ্যাঁ রে মুমতাহিনা সংসারটা একটু কষ্ট করে টিকিয়ে রাখলে হত না?
মুমতাহিনা কলপাড়ে কিছু কাপড় কাঁচছিলো। কদিন যাবত উকিলের কাছে বেশ যাতায়াত করতে হচ্ছে।এই ভ্যাপসা গরমে একটা শাড়ি দুবারের বেশি পরে যাওয়া যায় না।তাই বেশ কয়েকটা শাড়ি পরে যাতায়াত করেছে,সে গুলোই কাঁচছিলো।কাল আবারও যেতে হবে।নিপুণ হাতে কাপড় কাঁচতে কাঁচতে দাদির কথাই থমকালো মুমতাহিনা। একটু কষ্ট করে? মুমতাহিনা তো কম কষ্ট করেনি সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য। আর কত কষ্ট সহ্য করবে, তবে তো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তাকে।
মুমতাহিনা একটু হাসলো।সোনালী সুন্দর মুখোশ্রীতে হাসিটা শিশুর মতই নিষ্পাপ মনে হলো।
-- আমি মনে হয় একটু বেশি বোঝা হয়ে যাচ্ছি,তাই না দাদি?
-- সে কী কথা, বোঝা হবি কেন? একটা মেয়েকে তার স্বামীর ঘরেই মানায়, বাবার বাড়িতে থাকাটা দৃষ্টি কটূ দেখায়।
-- কেন? দৃষ্টি কটূ দেখাবে কেন ?বাবার বাড়ি বৈ পরের বাড়ি তো নয়।
-- বাবার বাড়িই নারীর কাছে পরের বাড়ি, স্বামীর বাড়িই তো আসল।
মুমতাহিনা বুকের কষ্ট বুকে চেপে বলল
-- হ্যাঁ, নারীর আবার আসল বাড়ি।
মুমতাহিনার কথাই দাদি কিছু বললো না। তার কথাটা বড়ো সত্য। সংসারে তাঁকেও তো কম নাটা-ঝামটা সহ্য করতে হয়নি। তাঁরও মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জেগেছে, নারীর আসল বাড়ি কোথায়? অল্প বয়েসে বিয়ে হয়েছিল তাঁর, শাশুড়ির উগ্র কথা সহ্য হত না, মায়ের কাছে গিয়ে সে কি কান্নাটাই না করত। মা বলতেন ‘ ওটাই তোর কাছে আসল বাড়ি মানিয়ে চলতে শেখ।’ শাশুড়ি রেগে বলতেন,’ নিজের বাড়ি যাও।’ কোনটা নিজের বাড়ি?সে কতজন কে প্রশ্ন করল
-- হ্যাঁ গো মেয়েদের আসল বাড়ি কোথায়?
সেই কৈশরী থেকে আজ বার্ধক্যে পদার্পণ করেছেন,সে প্রশ্নের উত্তর আজও মিলল না। তবে তাঁর সংসারের অশান্তি ছিলো ভিন্ন। শাশুড়ি যেমনই হোক স্বামীর সোহাগ ছিল। মুমতাহিনার সংসারে সেটাও নেই।তিনি আরো একবার বললেন
-- চার বছরের সংসারে দেড় বছরে একটা মেয়ে আছে, মেয়েটার ভবিষ্যৎ কী হবে?
-- আমি যদি তার সাথে সংসার করি তবে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ আরো খারাপ হবে দাদি, কবে হয়ত তোমরা শুনবে ওরা আমাকে মেরেই ফেলেছে।
কথা গুলো বলতে বলতে মুমতাহিনা দড়িতে কাপড় মেলতে লাগলো। বাম হাত উঠিয়ে কাপড় মেলতে গিয়ে ফর্সা কোমরে বেল্টের আঘাতের কালো দাগ গুলো বিদ্যমান হল, বড় বিভৎস লাগছে দেখতে। দাদি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললেন।
--বুঝি না বাবা তোরা ভালোবেসে ক্যামনে বিয়ে করিল! তারপর যে কি হয় সংসারে, যে সংসার টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পরে।
কিছুক্ষণ থেমে আবার ধীর কন্ঠে বললেন
-- তালাক দেওয়া ভালো না দিদি।আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে।
মুমতাহিনা বলতে চাইল, শুধু কি আল্লাহর আরশ? আমার হৃদয় তো কম কাঁপে না দাদি।
কিন্তু বলা হল না। দীঘির মত স্বচ্ছ চোখ জোড়ায় চিকচিক করতে থাকা জল গুলো শাড়ির আঁচলে মুছে বলল
-- জানো দাদি একটা সময় মানুষের মনের পরিবর্তন আসে, ভালোবাসা,ভালোলাগা , ঘৃণা এমনকি মানুষের রুচির পর্যন্ত পরিবর্তন হয়। যে ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভুতি,সেটাই একটা সময় বিষের চেয়ে বিষাক্ত মনে হয়। বছর খানেক কত সুন্দর সংসার করলাম আমরা , তারপর যে কি হলো সব কিছু আলাদা হয়ে গেল।
মুমতাহিনার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। বিয়ের পর সংসারটা কত সুন্দর ছিলো, শাশুড়ি যেমনই হোক, জায়ান তাকে খুব ভালোবাসতো। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তারা। মুমতাহিনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে , জায়ান ছিলো উচ্চবিত্ত বংশের ছেলে।
মুমতাহিনার বাবা তার শাশুড়ির মন মত জিনিস দিতে পারেননি। এটা নিয়েই সংসারে অশান্তি। শাশুড়ি উঠতে বসতে তাকে খোটা দেয়। ছেলেকে সুযোগ পেলেই বলে
-- সাদা চামড়া দেখে তো বিয়ে করে ফেললি, শশুর দিলো টা কি। চক্ষু লজ্জা বলেও তো কিছু একটা থাকে নাকি। এমন ভালো ঘর, ভালো জামাই অথচ মেয়েকে ভালো কিছু দিতে পারলনা।
কে জানত একদিন পণের লোভ জায়ানের মনেও ঢুকবে?
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সংসারে শুরু হল অশান্তি। সেটা যখন চরম আকার ধারন করলো তখন মুমতাহিনা অন্তসত্ত্বা। তাই ডিভোর্সের কথা সে তখন ভাবেনি। তারপর ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। বাবার বাড়িতে অনেক দিন কাটিয়ে সে শশুর বাড়ি গেলো। অশান্তি কিছু মাত্র কমলো না বরং বেড়েই চলল। মুমতাহিনাকে মাঝে মাঝেই মারধর করে জায়ান, একদিন মেয়ের গায়েও হাত তুলল। মুমতাহিনার আর সহ্য হলো না, সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি এলো।সে শুধু ভাবে মানুষের এতটা পরিবর্তন হয় কীভাবে? যে ভালোবাসা একদিন স্বর্গ সুখ দিয়েছিল ,সেই ভালোবাসা আজ নরকের যন্ত্রণা দেয়। সে বুঝেছিল , শয়তানের কুমন্ত্রণার চেয়েও মানুষের কুমন্ত্রণা বেশি ভয়ংকর।
মুমতাহিনা ক্ষীণ কন্ঠে দাদিকে বলল
-- আমি এ পৃথিবীতে সংসারের চেয়ে সুন্দর আর সংসারের ভয়ংকর কিছু দেখিনি।
মুমতাহিনা ঘরে গেল। দাদি চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন , কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বললেন
-- বলেছিলাম অমন উচ্চ বংশে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না। বাসলোই বা ভালো, টাকার কাছে ভালোবাসা হেরে যায়।
পরদিন সকাল বেলা প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ পত্র নিয়ে মুমতাহিনা বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল ,মা বললেন
-- তাহলে ডিভোর্সটা হয়েই যাচ্ছে।
মুমতাহিনা নীরব।
--একবার ভেবে দেখলে হয় না?
-- ভাবতে ভাবতে আজ তিন তিনটে বছর অতিক্রম করে দিয়েছি মা। কতটা আঘাত, কতটা যন্ত্রণা হৃদয়ে নিয়ে সংসার করে গিয়েছে। কেউ এতটুকু সহানুভূতি দেখায়নি।
-- ভালোবেসে...
-- আজও বাসি মা , তবে অনুভূতিরা আর জাগে না, বারবার অবহেলা পেয়ে, যন্ত্রণা পেয়ে তার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণাটাই তীব্র হয়ে গেছে।
মায়ের আর কিছু বলা চলে না, অমন রূপে গুণে ভরপুর মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এবার এর একটা সুরাহা হোক।
মুমতাহিনা বাবার সাথে বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে বলল
-- মহিমাকে একটু সামলে রেখো মা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct