হতে পারতেন ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখা সফল ভারতীয় কবি, হতে পারতেন দর্শনের সফল অধ্যাপক বা অর্থনীতির পণ্ডিত, কিন্তু তার আশৈশবের মননভূমি তাকে সংস্কৃতির স্বাধীনচেতা ও লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে নাট্যাঙ্গনে টেনে নিয়ে আসে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার প্রতিকুলতা তাকে কাবু করতে পারেনি, তীব্র শ্বাসকষ্ট উপেক্ষা করেও হাজির হতেন ভারতের ক্ষমতাসীন শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আহূত প্রতিবাদ সভায়। নাকে অক্সিজেনের নল, সঙ্গে পোর্টেবল সিলিন্ডার। ‘আরবান নকশাল’ তকমা দিয়ে প্রতিবাদী সামাজকর্মীদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে গোটা দেশজুড়ে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিলো, সেই প্রতিবাদ মিছিলের সামনে ছিলেন ৮০ বছর পার হওয়া গিরিশ কারনাড—ধর্মীয় সংকীর্ণতা, স্বৈরতান্ত্রিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াকু সংস্কৃতযোদ্ধা সেই বার্ধক্যের কাছেই হেরে গেলেন।
২০১৫ সালে টিপু সুলতানের ২৬৫তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথি গিরিশ কারনাড প্রস্তাব রেখেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে বিমানবন্দরের নাম কেম্পেগৌড়ার বদলে টিপু সুলতানের নামে রাখার জন্য, বলেছিলেন, ‘টিপু’ যদি হিন্দু হতেন তবে তার স্থান শিবাজীর স্থানে হতো। সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে টিপু এক আপোষহীন যোদ্ধা। এর ফলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের খতম তালিকায় সর্বাগ্রে ছিলেন তিনি। এই ইস্যুতে কলকাতায় কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আমি ভয় পাই না। জীবন নশ্বর।’ শুনিয়েছিলেন বাংলার সেই গানের কলি, ‘ভয় কী মরণে!’। এই অকুতোভয় মানুষটি চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। যিনি বলেছিলেন, ‘থিয়েটার সমাজ বদলাতে পারে না, কিন্তু সমাজ বদলের ক্ষিদে জাগাতে পারে।’
গিরিশ কারনাডের জন্ম মহারাষ্ট্রের মাথেরানে, ১৯৩৮ সালে। তার মানসিক দৃঢ়তা মা কৃষ্ণাবাই মানকিকারের কাছ থেকে পাওয়া। খুব কম বয়সে স্বামীকে হারান কৃষ্ণবাই। এক পুত্রকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন। এর পর সংসার চালানোর জন্য নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন। সেখানেই পরিচয় হয় ডাঃ রঘুনাথ কারনাডের সঙ্গে, তিনি তখন মুম্বাই মেডিকেল সার্ভিসে যুক্ত। দুজন ক্রমশ কাছাকাছি আসেন ও বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিধবার বিয়ে তৎকালীন কন্নড় সমাজে সহজ ছিলো না, তারা শেষপর্যন্ত আর্য সমাজের বিধি মেনে বিয়ে করেন। তাদের চারজন সন্তানের তৃতীয়জন গিরিশ। জন্ম মহারাষ্ট্রে হলেও শৈশব কাটে তার কর্নাটকের শির্ষিতে। সেখানে পারিবারিকভাবেই তিনি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন। স্থানীয় লোকনাট্য ও ট্র্যাডিশনাল পালা ‘যক্ষগান’ দেখে এর প্রতি আগ্রহী হন সেসময় থেকেই, যা তাকে পরবর্তীকালে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কর্নাটকের গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হন সেই সময় থেকেই, অনাড়ম্বর গ্রামীণ লোকনাটক তাকে আকর্ষণ করতো, এই টান চিরকাল তাকে আটকে রেখেছিলো শেকড়ের সঙ্গে। কিশোর বয়সেই চলে আসেন ধারোয়ারে, ১৯৫২ সালে ভর্তি হন বাসেল মিশন হাই এডুকেশন ইন্সটিটিউটে। সাহিত্যে আগ্রহী হলেও পাঠ নেন গণিতে। ১৯৫৮ সালে কর্নাটক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে গণিতে স্নাতক হন। ১৯৬০ সালে রোডস স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ড, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও রাজনীতির পাঠ নিতে। সেখানে সক্রিয় থাকেন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবেও, অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সম্পাদকও হন।
আবার ফিরে আসেন নিজের শেকড়ে। চাইলে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মগ্ন থাকতে পারতেন, কিন্তু মাতৃভাষা কন্নড়কেই বেছে নেন কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। ১৯৬২-৬৩ সালে কাজ নেন চেন্নাইয়ের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে। এই সময়েই হাত দেন নাটক রচনায়, তখন তিনি মাত্র ২২ বছরের তরুণ, মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে লেখেন ‘যযাতী’। নাটকটি ইংল্যান্ডেও মঞ্চস্থ হয়েছিলো। সি রাজাগোপালচারিয়ার মাহাভারত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘যযাতি’ চরিত্রটিকে তার প্রথম সাহিত্যকীর্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। নহুষের পাঁচ পুত্রের দ্বিতীয় পুত্র যযাতি। প্রথম সন্তান যাতি সন্যাস নিলে যযাতি রাজা হন। দেবগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানিকে বিয়ে করেন যযাতি, তাদের দুই পুত্র, যদু ও তুর্ব্বসু। কিন্তু সেই রাজা যযাতির আকর্ষণ জন্মে রূপসী দৈত্য রাজকন্যা শর্মীষ্ঠার প্রতি, রূপমুগ্ধ যযাতি শর্মীষ্ঠার মিলন হয়, তাদের তিন পুত্র জন্মে, দ্রুহ্যু, অনু, পুরু। দেবযানি এই সংবাদ তার পিতাকে দেন এবং এর বিহিত চান। ক্ষুব্ধ শুক্রাচার্য এসে রাজা যযাতিকে অভিশাপ দিলেন, যযাতি রূপে জরাজীর্ণ হয়ে গেলেন। কিন্তু তার কাকুতি মিনতিতে দেবগুরু অভিশাপ থেকে রক্ষার পথও রাখলেন। বললেন যদি তাদের কোনো সন্তান যযাতির জরা এবং বার্ধক্য গ্রহণে সম্মত হয় এবং তার নিজের যৌবন যযাতিকে দান করেন তবেই যযাতি আবার আগের চেহারা ফিরে পাবেন। একে একে পুত্ররা অসম্মত হলেও কণিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার জরা গ্রহণে সম্মত হন। যযাতি তার রাজত্ব পুরুকে অর্পণ করেন। মহাভারতের এই আখ্যানটি নিয়ে বাংলা সাহত্যে অনেক কাজ হয়েছে, মাইকেল থেকে দেবেশ রায় পর্যন্ত এই আখ্যান নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু গিরিশ স্বতন্ত্র, এখানেই যখন তিনি পুরুর স্ত্রী চিত্ররেখার বয়ানে শুক্রাচার্যের সামনে প্রশ্ন রাখেন—নৃপতি যযাতির, যিনি সম্পর্কে তার শ্বশুর—কী অধিকার আছে তার দাম্পত্য হরণের? পুরাণ থেকে উঠে আসা চরিত্রের এক নারী এভাবেই পুরুষতন্ত্রের সামনে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেন। এখানেই পৌরাণিক আখ্যানের বয়ানে আধুনিক কালের নারীবাদী জিজ্ঞাসা তুলে আনেন।
গিরিশ কারনাড তার শৈশবের আকর্ষণ থেকেই ভারতীয় আখ্যান ও পুরাণ, মিথ, মহাকাব্য থেকে উপকরণ খুঁজেছেন তার নাটকের জন্য। সেই উপকরণকে তিনি আধুনিক সময়ের ক্যানভাসে সমসাময়িক করে এঁকেছেন মঞ্চের জন্য। এইভাবেই লিখেছেন ‘হয়বদন’, ‘নাগমণ্ডল’ প্রভৃতি নাটক। ‘হয়বদন’ নাটকটি স্বাধীনতাউত্তর ভারতীয় নাটকের একটি ‘মাইলফলক’ হিসাবে চিহ্নিত, নাট্যকার হিসাবেও তাকে ভিন্ন উচ্চতায় তুলে আনে এই নাটকটি।
গিরিশ কারনাডের যে নাটকটি নাট্যসাহিত্য এবং মঞ্চনাটক হিসাবে পাঠক ও দর্শককে তুমুলভাবে আবিষ্ট করেছিলো সেটি এই ‘হয়বদন’, যার প্রযোজনা ও মঞ্চায়ন ছিলো সম্পূর্ণ আধুনিক, কিন্তু বিষয় হিসেবে তুলে এনেছিলেন ভারতীয় প্রাচীন আখ্যান থেকে, যেভাবে ‘নাগমণ্ডল’ এ-ও করেছেন। ১৯৭৫ সালে কন্নড় ভাষায় তিনি মূল নাটকটি লেখেন, এর পর এটি হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা-সহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জার্নাল ‘Enact’-এ সেটির ইংরেজি অনুবাদ-সহ প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে মাদেরাস প্লেয়ারস এই নাটকটি মঞ্চস্থ করে। ‘হয়বদন’ এর কাহিনি কাঠামো তিনি নিয়েছিলেন সংস্কৃত নীতিশিক্ষামূলক ‘কথাসরিতসাগর’ থেকে, তবে তিনি অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছেন টমাস মানের ‘The Transposed Heads’ দ্বারা। ‘হয়বদন’ মানুষের অসম্পূর্ণতার আক্ষেপ, হৃদয়বৃত্তি ও মননের দ্বন্দ্বের আখ্যান। মানুষের অস্তিত্ব বা পরিচিতি কী? মানবসত্তার বিকাশের পথ কী? এই গভীর জিজ্ঞাসা ‘হয়বদন’-এ উঠে এসেছে। ত্রিভূজ প্রেমের এক আশ্চর্য আখ্যান এটি।
এই আখ্যানটিকে সমসাময়িকতার ক্যানভাসে রেখেছেন কারনাড। মঞ্চায়নের সময় ব্যবহৃত হয়েছে ঐতিহ্যগত লোক উপকরণ। কারনাডের কৈশোরে দেখা গ্রামীণ লোকনাট্য সেই ‘যক্ষগান’ এর অভিজ্ঞতা তাকে এই নাটকটির নির্মাণে সাহায্য করেছিলো। নাটকটিতে লোকনাটকের মতোই অনেক গান ব্যবহার করেছেন তিনি।
‘হয়বদন’ আসলে একজন অসম্পূর্ণ মানুষ যে পূর্ণতার খোঁজ করে চলছে। দুই অঙ্কে বিভাজিত এই নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র পদ্মিনীর ভালোবাসা দুই জনের প্রতি, যারা আবার দুই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু; গল্পের মূল প্রতিপাদ্য হৃদয় ও দেহের দ্বন্দ্ব।
নাটকের সূচনায় সূত্রধর ভাগবতকে মঞ্চে দেখা যায়, সে ঈশ্বরের ক্ষমতা ও মানুষের অভলিপ্সা নিয়ে কথা বলে, মঞ্চে বিঘ্নেশ্বর গণেশের পুজা আরাধনা করে, শুরু হয় মূল নাটকটি। ভগবত হাতীর মাথাওয়ালা দেবতা গণেশকে আরধনা করে তাকে বর্ণনা করেন সাফল্য ও পার্ফেকশনের দেবতা হিসেবে, শুদ্ধতা ও পবিত্রতার মূর্তি বলে আরাধনা করেন। এরপর সেই ধর্মপূরের দুই যুবকের প্রসঙ্গ আনেন। মঞ্চে প্রবেশ করে হয়বদন, মাথাটি যার অশ্বের মতো, দেহ তার মানুষের, মানুষের ভাষায় কথা বলে। হয়বদনের বয়ানেই জানা যায় তার মা কর্নাটকের এক রাজকন্যা ছিলেন। যৌবন এলে তার বাবা তার বিয়ের প্রস্তুতি নেন, এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের রাজপুত্রদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তার কাউকে পছন্দ হয় না, অবশেষে আরব দেশের একজনকে তার মনে ধরে, রাজা তখন রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তুতি নেন সেই আরব রাজপুত্রের সাথে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে রাজকন্যা বলেন যে, তার পছন্দ আরব পুত্র নয় তার ঘোড়াটি, এবং সেই ঘোড়াটিকেই সে বিয়ে করবে। ১৫ বছর তারা একসাথে ঘর করে, হঠাৎ একদিন দেখে ঘোড়াটি উধাও, সেখানে এক গন্ধর্ব পুরুষ। পরে সে দেখে যে ঘোড়াটি আসলে এক গন্ধর্ব পুরুষ, মানবীর ভালোবাসা তাকে আবার গন্ধর্ব রূপ ফিরিয়ে দিয়েছে। সে তখন হয়বদনের মা’কে গন্ধর্ব দেশে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তিনি রাজি হন এই শর্তে যে তাকে ঘোড়া হয়েই থাকতে হবে।
সে সেই অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্তি চায়। সুত্রধর তার পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য ইচ্ছাময়ী মা কালীর কাছে আরাধনার কথা বলা হয়। এভাবেই আখ্যানটি উপস্থাপনা করা হয়, যে আখ্যানটি মঞ্চে উপস্থাপন করা হয় সেখানে দেবদত্ত ও কপিলা দুই আভিন্ন হৃদয় বন্ধু। দেবদত্ত একজন ব্রাহ্মণের সন্তান, আর কপিল একজন কামারের সন্তান। দেবদত্ত পদ্মীনি নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে, যিনি এক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা। কপিল বন্ধুর বিষণ্ন মুখ দেখে তার অনুমান করে এবং তাকে মেয়েটির কাছে নিয়ে যায়। একদিন তিনজনে উজ্জ্বয়নের মেলায় যায়। দেবদত্তের কাছে বন্ধু ও প্রমিকা দুজনের প্রিয়, কাউকেই ছাড়তে পারবে না। মেলায় গিয়ে তাই পদ্মীনি ও কপিলকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবদত্ত কালি মায়ের মন্দিরে যায় এবং নিজের শিরচ্ছেদ করে আত্মাহুতি দেয় । কিছুক্ষণ পরে কপিলও মন্দিরে গিয়ে বন্ধুর দ্বিখন্ডিত দেহ দেখতে পায়, এবং নিজেও তৎক্ষণাৎ শিরচ্ছেদ করে আত্মহত্যা করে। পদ্মীনি এসে দেখে—দুই বন্ধুর শিরচ্ছেদ হওয়া দেহ মায়ের সামনে পড়ে আছে। সে এদের পুনঃজীবন প্রার্থনা করে। দেবী-মা এদের বেঁচে ওঠার বর দান করেন। কিন্তু পদ্মীনি একজনের দেহের সাথে অন্যজনের মাথা যুক্ত করে দেন। ফলতঃ দেবদত্তের মাথার সাথে কপিলের দেহ আর কপিলের মাথার সাথে দেবদত্তের দেহ যুক্ত হয়। নাটকটির পরের অংকে দেখা যায় দেহ ও মাথার দ্বন্দ্ব। দেবদত্তের সন্তানের মা হন পদ্মীনি, যেহেতু কপিলের দেহ থেকে এই সন্তানের জন্ম তাই কপিলকে সে পিতৃত্বের অধিকার নিতে বলে। এই নিয়ে নাটকে আর একটি দ্বন্দ্ব এসে যায়। নাটকটিতে কারনাড অস্তিত্ববাদকে অন্বেষণ করেছেন তীব্র অসম্পূর্ণতায়। আমরা প্রত্যকেই আসলে পূর্ণ নই, কিন্তু তার অন্বেষণ করে চলি সবসময়। নাট্যকার দর্শকের সামনে তিনটি চরিত্রকে আনেন, যাদের বর্ণ ও শ্রেণী ভিন্ন। নাটকটির ক্লাইমেক্সে এসে আমরা দেখি পদ্মিনী তার স্বামীতে তৃপ্ত নয়, শক্তিশালী কপিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেমের পূর্ণতা চায়, মনন থেকে গুরুত্ব পায় দৈহিক শক্তির, যা বর্তমান সমাজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। এই দেহ ও মনের ভিন্নতায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত তুলে আনা হয়েছে নাটকটিতে। দেহ এখানে শারীরিক অভিজ্ঞতার স্মারক, মন সেখানে পরিচিতির ও স্মৃতির স্মারক। এটি একটি সায়কোলজিক্যাল ড্রামা হলেও অভিনয় ও উপস্থাপনার গুণে হয়ে উঠলো দ্বন্দ্ব-চিত্রিত সমাজচিত্রণের আখ্যান। নাট্যকার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, গিরিশ যেন নতুন করে বুঝয়ে দিলেন, আমরা কেউ আর কখনো কোনও একটি পরিচয়ে নিজেদের অভিহিত বা চিহ্ণিত করতে পারব না। নতুন শতকের মানুষেরা হবেন সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে, ব্যক্তিজীবনে, সমাজে—সংকর।
‘যযাতি’র পরে, ১৯৬৪ সালে কারনাড লেখেন ‘তুঘলক’। কন্নড় ভাষায় যদিও এটি লিখেছিলেন দু’বছর আগেই। আলেক পদমসির অনুরোধে সেটার ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন কারনাড। বম্বে থিয়েটার গ্রুপ এর মঞ্চায়ন করে—১৯৭০ সালে ভুলাভাই অডিটোরিয়ামে। এ সময়ই নাটকটি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা হিন্দিতে মঞ্চায়ন করে, বাংলাতেও মঞ্চস্থ হয়। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দ, সুলতানি আমল, মহম্মদ বিন তুঘলক এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই নাটকটি তাকে খ্যাতির শীর্ষে তুলে আনে। তের অংকের এই নাটকে দিল্লীর খামখেয়ালি শাসকের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সে সময়ের শাসক চরিত্রকে চিত্রিত করেছেন তিনি। একজন খামখেয়ালি শাসকের চরিত্র, বিচিত্র খেয়াল ও স্বপ্ন ভঙ্গের কাহিনীর পাশাপাশি এই নাটকটিতে স্বৈরতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কেও সচেতনতার বার্তা দেন কারনাড। অনেক সামালোচক এই নাটকের সাথে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। প্রচুর স্বপ্ন নিয়ে শাসনে বসা ও সেই স্বপ্নগুলোর ভেঙে পড়া দেখেছেন দুজনেই। গিরিশ কারনাড এই প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন, ‘তুঘলক নাটকের ঘটানাবলীতে অনেকেই সাম্প্রতিকতা ছায়া দেখেন, এটা সত্য যে তার মতো স্বপ্নদর্শী, আদর্শবাদী ও বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনায়ক দিল্লীতে আর আসেননি। তবে তিনি একজন পরাজিত মানুষও বটে। ২০ বছর তার আদর্শবাদী পদক্ষেপ, তার পাশাপাশি হঠকারিতা এসবের জন্য দায়ী।
স্বাধীন ভারতের ষাটের দশকের প্রথমার্ধে এই রকম ঘটনাই দেখা যায়। অন্য প্রসঙ্গে কারনাড বলেছেন, পাগলা রাজা বলে খ্যাত বিন তুঘলক হিন্দু বিষ্ণুপ্রসাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তিনি চাননি তাঁর রাজত্বে হিন্দু-মুসলমান দ্বৈরথ হোক। এই নাটকটি নিয়ে বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক ইউ আর অনন্তমূর্তি লিখেছেন, ‘The intrigue here not only enhances the theatrical interest of the play, but is a dramatized projection of Tughlaq’s tortured, divided self. Thus, the external action throughout an acts the inner drama of Tughlaq. Both Tughlaq and his enemies initially appear to be idealistic; yet, in the pursuit of the ideal, they perpetrate its opposite. The whole play is structured on these opposites: the ideal and the real; the divine aspiration and the deft intrigue.’’ গোটা দেশে এই নাটকটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ও মঞ্চস্থ হয়, ইব্রহীম আলকাজি, শ্যামানন্দ জালান, অরবিন্দ গোউড়ার মত পরিচালকেরা এর মঞ্চায়ন করেন। বাংলাতেও এই নাটকের বেশ কয়টি মঞ্চায়ন হয়েছিলো।
গিরিশ কারনাডের বয়ানেই জানা যায় তার শৈশবের একটি মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা। তখন তিনি নেহাতই শিশু, গ্রামের পথে চলছিলেন, পাশদিয়ে একটি মেয়ে চলছিলো। হঠাৎ দেখেন কিছু লোক এসে মেয়েটিকে টানতে টনাতে নিয়ে যাচ্ছে। বলছে, ‘খুব শখ নিচু জাতের ছেলের সাথে মেলামেশার!’ শৈশবের এই ঘটনাটি তার স্মৃতিতে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। পরবর্তিতে এর প্রেক্ষিতেই লেখেন ‘তালেডন্ড’, যেটা শঙ্খ ঘোষ অনুদিত ‘রক্তকল্যাণ’—বাংলার মঞ্চজগতে সাড়া ফেলেছিলো। দ্বাদশ শতকের ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত এই নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কন্নড় কবি বাসবান্না। তিনি শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে তৈরি করেছিলেন ‘শরণ সংঘ’, রাজা বিজ্জল ছিলেন বাসবান্নার বন্ধু। ‘শরণ সংঘ’-এর অনুগামীরা সঞ্চয় করা বা জমিয়ে রাখাকে অন্যায় মনে করতেন। শিব তাদের উপাস্য হলেও তারা জাতপাতের গন্ডি মানতেন না। এই সংঘে এক মুচির ছেলের সঙ্গে এক ব্রহ্মণের মেয়ের বিবাহ হয়। আঁতে ঘা লাগে অভিজাত উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের। রাজা সে সময় ব্রাহ্মনদের পক্ষ নেননি, রাজা নিহত হন—সামাজিক অগ্রগামী বিরোধীদের হাতে। বাসপন্না আবার পথে নামেন সমাজকে মুক্ত করার পথের সন্ধানে। নাটক ‘তালেডন্ড’-এর এই কাহিনী আজও প্রাসঙ্গিক।
গিরিশ কারনাডের অন্যান্য বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘মা নিষাদ’, ‘আঞ্জুমালিগ্নে’, ‘টিপু সুলতান কান্ডে কানাসু’, ‘ওদাকালু বিম্বা’ প্রভৃতি। ১৯৭২ সালে তার লেখা ‘হায়বদন’ তাকে নাট্যকার হিসাবে বিশেষ স্বীকৃতি এনে দেয়।
থিয়েটারের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও সমান দক্ষতায় হাজির হন গিরিশ কারনাড। অভিনয় জীবনের শুরু হয় ১৯৭০ সালে কন্নড় ফ্লিম ‘সংস্কার’-এ অভিনয় দিয়ে। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বার্তা ছিলো এখানে। এর সহকারী চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। এরপর ১০টি সিনেমার পরিচালনা করেন কারনাড। তার পরিচালিত ‘ভষ্মবৃক্ষ’ জাতীয় পুরষ্কার পায়। পরিচালক, চলচ্চিত্রকার ছাড়াও অভিনেতা হিসাবেও তিনি স্বতন্ত্র সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন। এমন কি ছোট পর্দায়ও তিনি ছিলেন সফল। তার অভিনিত আর কে লক্ষ্মণ রচিত ‘মালগুডি ডে’জ’-এ তার অভিনয় আজও চর্চিত হয়।
যোগ্যতার বলে পুনের FTII এর অধিকর্তা ও পরবর্তিতে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন গিরিশ কারনাড।
থিয়েটারের মতই সমান্তরালভাবে ফিল্ম আন্দোলনেও তার ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়ে থাকে। শ্যামবেনেগালের ‘অঙ্কুর’ ‘নিশান্ত’( ১৯৭৫), ‘মন্থন’(১৯৭৬)-এ গিরিশ কারনাডের অভিনয় ভারতীয় ফিল্ম অভিনয়ের আর্কাইভে চিরকালের সম্পদ হয়ে থাকবে। বাসু চ্যাটার্জীর ‘স্বামী”(১৯৭৭)-তে অসাধারন অভিনয় করেছিলেন তিনি। এর পাশাপাশি বানিজ্যিক ফিল্মের দুর্দান্ত ছিলেন, এর মধ্যে ‘পুকার’(২০০০), ‘ইকবাল’(২০০৫) উল্লেখযোগ্য। অর্ধশতক ধরে ৯০টির বেশী বানিজ্যিক ফিল্মের অভিনয় করেছেন তিনি, এমনকি গুরুতর অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’, ‘চক এন্ড ডাস্টার’-এর মত বানিজ্যিক ফিল্মেও অভিনয় করেছেন গিরিশ।
বাংলা থিয়েটার আন্দোলনও গিরিশ কারনাডের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। শঙ্খ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন ঘোষের অনুবাদে ‘হয়বদন’ এখনকার অনেক নাট্যদল মঞ্চস্থ করেছে। সম্প্রতি ‘কথাকৃতি’, ‘ঘোড়ামুখো পালা’ নামে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়েছে। সীমা মুখোপাধ্যায় ‘রক্তকল্যাণ’ প্রযোজনা করেছেন। বিভাষ চক্রবর্তী ‘ফায়ার আন্ড দি রেইন’ অবলম্বনে ‘অগ্নিজল’ প্রযোজনা করেছেন। ‘তুঘলক’, ‘নাগমন্ডল’ এখানে মঞ্চস্থ হয়েছে। ‘তুঘলক’এ শম্ভু মিত্র অভিনয় করেছেন বিন তুঘলকের চরিত্রে।
সোজা কথা সরাসরি বলতে গিয়ে কখনো পিছু হটেননি কারনাড। তাই নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ভি এস নাইপল যখন দেশের মুসলিমদের অবদান নিয়ে অভিমত করেছিলেন, তখন সবার আগে প্রতিবাদ করেন কারনাড। ২০১০ এর জুলাই-তে নাইপল ভারতে এসেছিলেন, তখন তার এই অভিমত নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। তিনি এই সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন যে, ‘ভারতবর্ষ ও তার ইতিহাস সম্পর্কে নাইপলের কোনো বাস্তব ধারনা নেই, ৩০০০ বছর ধরে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে মুসলিমদের অবদান সম্পর্কেও তার ধারনা নেই, তাই তিনি আপত্তিকর ভাবে মুসলিম অবদানকে নস্যাৎ করেছেন’
ভারতীয় নাট্যসাহিত্য বা নাট্যআন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা নিয়েও তিনি স্বছ বক্তব্য ছিল তার। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে কথোপকথনের সময় অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে ভারতীয় থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের ভুমিকার কথাও উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘কবি ও দার্শনিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অসামান্য, কিন্তু নাট্যকার হিসাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর বলে তিনি মনে করি’। এতে দেশজুড়ে, বিশেষত, বাংলায় বেশ আলোড়ন ওঠে। এই নিয়ে ব্রিটেনে একজিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য আলোচক হিসাবে গিরিশ পুনরায় একই কথা বলেন, ‘উনিশ শতকের ভারতীয় নাটকে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা গৌণ। তার নাটক সেসময় দেশের মানুষ দেখেইনি, বোঝা তো দূরে থেক। পেশাদাররা তার নাটক সেসময় ছুয়েও দেখতেন না।’
(বা. টি)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct