চাঁদের মাটিতে সত্যিই মানুষের পা পড়েছে কিনা, তা নিয়ে বহুদিন থেকে চলছে জল্পনা। অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও এখনও এই বিতর্ক থেকে বের হতে পারেনি নাসা। সেই। সেই বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিকের একটি অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদন। সাংবাদিক রিচার্ড গডউইনের যে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান তা থেকে অনেক অজানা তথ্য ও রহস্য পাওয়া যাচ্ছে। গার্ডিয়ানের সাংবাদিক রিচার্ড গডউইন লিখেছেন, ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ আলড্রিন-এর চাঁদে অবতরণ সফল করার পেছনে ৪ লাখ নাসা কর্মী এবং কন্ট্রাক্টর তাদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং শক্তি বিনিয়োগ করেছিলেন। তবে মাত্র একজন ব্যক্তির ছড়ানো ধারণা এই সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে ধাপ্পাবাজি হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। ওই ব্যক্তির নাম বিল কেসিং। কেসিং মার্কিন মহাকাশ প্রকল্পে দক্ষতার সঙ্গে অবদান রেখেছিলেন এবং ১৯৫৬ এবং ১৯৬৩ সালের মধ্যে তিনি রকেট ডাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি স্যাটার্ন ভি নামের রকেট ইঞ্জিন তৈরির কাজে সাহায্য করে।
যদিও ধারণা ছিল, চাঁদে অবতরণের জন্য কিংবা আপাতদৃষ্টিতে চাঁদে গিয়ে আবার ফিরে আসার জন্য যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল। ১৯৭৬ সালে কেসিং ‘আমরা কখনও চাঁদে অবতরণ করিনি: আমেরিকার ৩০ বিলিয়ন ডলার প্রতারণা’ নামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি তার দৃঢ় বিশ্বাস প্রমাণের জন্য গ্রেইনি ফটোকপি এবং হাস্যকর কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি তার অনুসন্ধানের মাধ্যমে কিছু চিরজীবী ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব প্রণয়নে সমর্থ হয়েছিলেন, যেগুলো এখনও কিছু হলিউড সিনেমা, ফক্স নিউজ ডকুমেন্টারি, রেডিড ফোরাম এবং ইউটিউব চ্যানেলে জায়গা করে নিয়েছে।
তবে চাঁদে যাওয়া নিয়ে যদিও বেশকিছু অসাধারণ প্রমাণ রয়েছে, যেমন ৩৮২ কেজি চাঁদের পাথর, যা প্রায় ছয়টা মিশন থেকে সংগৃহীত। রাশিয়া, জাপান এবং চীনও একে সমর্থন দিয়েছিল। এছাড়া নাসার চন্দ্রপরিদর্শনকারী অরবিটের মাধ্যমে পাঠানো ছবি যেখানে চাঁদের পিঠে অবতরণকারীদের পায়ের ছাপ দেখাচ্ছে। তা নিয়ে সংশয় কাটেনি। এমন সংশয়বাদীর মধ্যে একজনের নাম কিংপিং জো রিগ্যান। ইউটিউবের শেন ডাওসানও তাদেরই একজন। এমনকি গত বছর নিউজার্সিতে একজন সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকও তার ছাত্রদের কাছে চাঁদে যাওয়ার ঘটনাটি মিথ্যা আকারে হাজির করেন। যেখানে খোদ কেসিং বিশ্বকে সচেতন করার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত বইয়ের ফটোকপির ওপর নির্ভর করেছিলেন, সেখানে এখনকার সংশয়বাদীরা নিজেদের ব্যক্তিগত উৎসাহ থেকে বিভিন্ন নথি তৈরি করছেন। যেমন নাসা কতো অলস ছিল যে, তারা অ্যাপোলো ১৫, ১৬ আর ১৭’র জন্য একটিমাত্র চন্দ্রযান ব্যবহার করেছিল। অথবা নাসা কীভাবে এতোগুলো বছর ধরে বোকা বানিয়ে রেখেছে। অথবা তারা ‘একটি জিনিস এখনও আমার মাথায় ঢুকছে না’ নাম দিয়ে বিভিন্ন নথি সামনে হাজির করার চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাসার সাবেক শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ রজার লওনিয়াস বলেন, সত্য কথা বলতে হলে ইন্টারনেট মানুষকে যা খুশি ইচ্ছামতোন বলার ও করার সুযোগ দিয়েছে এবং তা আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এটা সত্যি, মার্কিনিরা এসব ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব শুনতেও বেশ আগ্রহী। সবসময়ই কেউ না কেউ ব্যক্তি-বিপরীত ব্যাখ্যা তৈরি করে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকে। এমনকি চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ব্রিটিশদের কাছে আকর্ষণীয় তত্ত্ব হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। গত বছর ‘দিজ মর্নিং’ নামের সম্প্রচারিত একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে একজন অতিথিকে স্বাগত জানানো হয়, যার ধারণা ছিল কেউ কখনও চাঁদে পৌঁছাতে পারবে না। কারণ চাঁদ সম্পূর্ণ আলো দিয়ে তৈরি। মার্টিন কেরি নামের একজন ব্যক্তির দাবি, অতীতে চাঁদে অবতরণের যে দৃশ্য দেখানো হয়েছিল, সেটার সত্যতা প্রমাণের সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তরুণেরা এ ব্যাপারে নিজস্ব অনুসন্ধান জারি রেখেছে।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় (ইউগভ) দেখা গেছে, প্রতি ছয়জন ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে অন্তত একজন বিশ্বাস করে, চাঁদে অবতরণও যে একটি সাজানো ঘটনা ছিল। চার শতাংশ ব্রিটিশ বিশ্বাস করে, এটি স্রেফ ধাপ্পাবাজি। ১২ শতাংশের বিশ্বাস, ঘটনাটি সত্য হলেও হতে পারে, আর বাকি ৯ শতাংশের অভিমত, তারা এ ব্যাপারে জানেন না। চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে এই ভ্রান্তি সবথেকে বেশি ছিল তরুণদের মধ্যে। ৫৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের ১৩ শতাংশ চাঁদে যাওয়ার বিষয়টি সাজানো মনে করে। আর ২৪ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার ২১ শতাংশ।
কেসিংয়ের মূল অনুসন্ধান এই বিষয়ে আরও মদত জোগাচ্ছে। ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটি তারাও দৃশ্যমান। আরেকটা হলো ল্যান্ডিং মডিউলের নিচের অংশ: পর্যাপ্ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত না হওয়া। তৃতীয়ত: অবতরণকারীদের ছায়ার অবস্থান। যারা জানত, যে ব্যাপারগুলো নিয়ে এসব ষড়যন্ত্রকারী কথা বলছে, তা শুধুমাত্র এসব বিশৃঙ্খলাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপচয় করছে, তারা তাদের নিজেদের পেশায় সম্মানিত (ক্যামেরা এক্সপোজের সময় যেভাবে ভ্যাকিউমের ভেতর তৃষ্ণা কাজ করে এবং তাদের ধুলার প্রতিফলিত ধর্ম কাজ করে)। তথাপি ২০০৫ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেসিং স্বীকার করেন, এ সবকিছু্ই ছিল একটি মিথ্যাচার যা কিনা একটি টিভি স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে উইয়ার্ডকে তিনি বলেন, এটি খুবই তথ্যসমৃদ্ধ কাজ ছিল যে নাসা প্রায়শই এটিকে খারাপভাবে পরিচালনা করতো এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের গুণগত মানও খারাপ ছিল। কিন্তু ১৯৬৯ সালে আমরা কীভাবে হঠাৎ করেই একটি বলিষ্ঠ কাজে অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হলাম? তাও পরিপূর্ণ সফলতার সঙ্গে? এটা অবশ্যই সমস্ত পরিসংখ্যানে অস্বাভাবিকতার বিপরীত।
অবশ্য তিনি এই একটা ব্যাপারে যথাযথ ছিলেন, যখন সোভিয়েতরা ১ অক্টোবরে তাদের স্পুটনিক মহাকাশ উন্মোচন করলো (একমাস পর এটি স্পুটনিক ২-কে অনুসরণ করে, যা লাইকা নামের কুকুরটিকে বহন করেছিল), তখন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ ব্যবস্থার অস্তিত্বই ছিল না। নাসার জন্ম ১৯৫৮ সালে এবং তা অ্যালান শেফার্ডকে মহাশূন্যে নিতে সক্ষম হয় ১৯৬১ সালের মে মাসে। কিন্তু যখন জন এফ কেনেডি ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এ দশক শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আপাতত একটি মানুষকে চাঁদে পাঠানো এবং সুস্থভাবে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সক্ষম হতে হবে। তখন এ ঘোষণাটি অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হলো।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি মার্কিন রাষ্ট্রীয় বাজেটের ৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ ভোগ করছে নাসা। তবে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সবকিছু প্রথমেই অর্জন করে ফেলছিলো। যেমন মহাশূন্যে প্রথম নারী ভ্রমণ (১৯৬৩), প্রথম অতিরিক্ত যানবাহন সম্পর্কিত কার্যক্রম, যেমন স্পেস ওয়াক (১৯৬৫)। তখন মার্কিনিরা তাদের লাঞ্চপ্যাডে অগ্নিকাণ্ড অ্যাপোলো-১ এর তিনজন নভোচারীর মৃত্যুর হয়। ফলে রাশিয়ার উন্নতিতে নিজেদের অবনতি অনেক ভালোভাবে উপলব্ধি করছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গডউইন বলেন, আপনি যদি কখনও লন্ডনের বিখ্যাত জাদুঘরে যান, জানতে পারবেন লুনার মডিউল বিশেষত তৈরি করা হয়েছিল টিন ফয়েল দিয়ে। অ্যাপোলো-৮ চাঁদের কক্ষপথে পরিভ্রমণ করেছে ১৯৬৮ সালে। কিন্তু আর্মস্ট্রংয়ের ভাষ্যমতে সঠিক কোর্স নির্ধারণ করা এবং চাঁদে অবতরণ করা ছিল এই অভিযানের সবচেয়ে কষ্টকর অংশ। তিনি আরও বলেন, চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটা ছিল আরও ১০টি কষ্টকর কাজের মধ্যে একটি (যদিও তার পায়ে যেই টিভি ক্যাবল জড়ানো ছিল, সেটা নিয়ে হাঁটাটা একটু কঠিন), কিন্তু আমি মনে করি চাঁদে অবতরণ করা সমস্যার সংখ্যার দিক থেকে ১৩তম।
অর্ধশতাব্দী ধরে ‘মিথ্যাচারের’ ব্যাপারে নাসায় কর্মকরত একজন কর্মীর মুখ থেকেও একটি ‘সত্য’ বের করতে সক্ষম হওয়া যায়নি। একটি মিথ্যাকে পুরো দুনিয়ার কাছে টিকিয়ে রাখা নাসার পক্ষে তাই অনেক কঠিন। ফলে চন্দ্রাভিযানের ধাপ্পাবাজির ধারণাটি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। আপনাকে এটাও ভাবতে হবে, ১৯৬৯ সালে নাসাতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে ২০১৯ সালের স্পেশাল ইফেক্ট সমৃদ্ধ প্রযুক্তি মানুষের আওতাধীন ছিল এবং প্রায় ৬০ কোটি টিভি দর্শকদের মধ্যে কেউ এ ব্যাপারে কোনও খটকা অনুভব করেননি। স্ট্যানলি কুবরিক্স-এর ‘২০০১ অ্যা স্পেস অডিসি (১৯৬৪)’ সিনেমাটি একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ যে তখন হলিউড স্পেশাল ইফেক্টের গুণগত মান কেমন ছিল। সেই সময়ের সিনেমার প্রযুক্তি বিবেচনা করলে চাঁদের অভিযানের সম্প্রচার চূড়ান্তভাবে অনির্ভরযোগ্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটি সঠিক একটি লোকেশনেও সিনেমা করার জন্য অদক্ষ ছিল।
১৯৮৮ সালে রবিবারে খেলার পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার দুজন বোমারুকে চাঁদে পাওয়া গিয়েছে’ এই শিরোনামে ছাপানো ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে গেলেও ২০০১ সালে চাঁদ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবার জনমনে উৎসাহ তৈরি করে। সে বছর ফক্স নিউজ ‘আমরা কি সত্যিই চাঁদে অবতরণ করেছিলাম’ নামক একটি ডকুমেন্ট প্রচার করে, যার পরিচালক ছিলেন ‘দ্য এক্স ফাইলস’-এর অভিনেতা মিচ পিলেগ্গি। অনুষ্ঠানটিতে কেসিংয়ের দেওয়া তথ্যগুলোকে নতুন দর্শকদের কাছে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়। সে সময় নাসায় কাজ করা লওনিয়াস জানান, তিনি সবার সান্ত্বনার পরিবর্তে তাদের প্রতি শুধু বিদ্রূপটাই বেশি স্মরণ করতে পারে। তিনি বলেন, অনেক বছর পর্যন্ত তারা এসব বিষয়ের প্রতি কোনও সাড়া দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। তারা এর প্রত্যুত্তর দেওয়ার তেমন কোনও প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু যখন ফক্স নিউজ সেই তথাকথিত প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচার করলো, বিষয়টি সত্যিই তার সীমানা অতিক্রম করে। তখন তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন-উত্তরের সম্মুখীন হতে শুরু করে।
লওনিয়াস বলেন, সে সময় বেশিরভাগ ফোন সন্দেহকারীর কাছে থেকে নয় বরং পিতামাতা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে আসতে থাকে। সবাই বলাবলি করতে লাগলো ‘আমার বাচ্চা এটা দেখেছে, আমি তাকে কীভাবে উত্তর দেবো।’ পরিস্থিতি সামাল দিতে নাসা একটি ওয়েবপেজ তৈরি করে কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে জানিয়ে শিক্ষকদের তথ্য পাঠানো শুরু করলো।
ফক্স নিউজের ওই প্রামাণ্যচিত্রের সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় ছিল একটি পরিসংখ্যান। সেখানে দাবি করা হয়, মার্কিনিদের মধ্যে ২০ শতাংশ বিশ্বাস করে, চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটি একটি ধাপ্পাবজি ছিল। লওনিয়াস বলেন, প্রকৃতপক্ষে এই ভোটের ফলাফল ৪-৫ শতাংশের ভেতর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভোটের প্রশ্নগুলোকে অতিরঞ্জিত করার মাধ্যমে মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আকর্ষণীয় ফল অর্জন করা অনেকটাই সহজ ব্যাপার। প্রতিটা সময় যখন এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা, এমনকি সিনেমার সাধারণ একটা সংলাপও বিষয়টাকে ইন্ধন জোগায়। তিনি এই ব্যাপারে নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’ নামক একটি চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যের বর্ণনা করেন। যেখানে একজন স্কুলশিক্ষক ম্যাথিউ এক চরিত্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে জেতার জন্য জানান, চাঁদে অবতরণ করা একটি মিথ্যা। এটা শুধুমাত্র সিনেমার প্রয়োজনে তৈরি করা একটি দৃশ্য ছিল। কিন্তু এই ছোট ব্যাপারটি পুরো বিষয়টাকে নিয়ে বড় ধরনের সাড়া ফেলে দেয়।
‘দ্য মুন- অ্যা হিস্ট্রি ফর দ্য ফিউচার’ বইয়ের লেখক অলিভার মর্টন বিশ্বাস করেন, চাঁদে যাওয়া নিয়ে ষড়যন্ত্র করার ব্যাপারে অধ্যবসায় মোটেও অবাক করার কিছু নয়। যেখানে অনেক ধরনের প্রমাণ রয়েছে (যেমন অ্যাপোলো-১১), সেখানে অসম্ভব নামক ঘটনার ব্যাখ্যা এবং যে ঘটনার শূন্য প্রমাণ আছে, সেখানে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার বর্ণনা করে কিছু মানুষ জবাব চাইবেই। অ্যাপোলোর উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দেখানো যে বিভিন্ন বড় কাজ করার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকার কতটা ক্ষমতাধর। আর চাঁদ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বোঝানো যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মানুষকে বোকা বানিয়ে রেখে যা সত্য না তা বিশ্বাস করানোর ক্ষেত্রে ততটুকু ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে ধাপ্পাবাজির গল্প তখনই সত্য হতো, যদি অ্যাপোলেকে কখনোই কোথাও না পাঠানো হতো। ১৯৭২ সালের পরও তার আর কোনও অভিযান ছিল না। তিনি আরও বলেন, যখন মার্কিনিদের মন আবার ১৯৭০-এর ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’তে রূপান্তরিত হয়, তবেই এই বিষয়ে বিশ্বাস করা বেশি আনন্দদায়ক হবে।
গার্ডিয়ানে আরো বলা হয়েছে, এই দোষের একটু ভাগ জেমস বন্ডকেও দিতে হবে। ‘ডায়মন্ড আর ফরেভার (১৯৭১)’ সিনেমাতে সিনকানারি ল্যাস ভেগাস ক্যাসিনোর পথে যাওয়ার সময় নাসার একটি ভবনে ঢুকে পড়ে। সেখানে পুরো সিনেমায় চাঁদের মধ্যে পৃথিবী অভিমুখী নভোচারীদের ছোটাছুটি দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখানে এটা শুধু দৃশ্যত রসিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং নেভাদা মরুভূমির চারপাশে চাঁদের পোকার মতো ঘোরাঘুরির ঘটনাটি সত্যতা প্রদানের একটি পথ তৈরি করে। পরে ১৯৭৮ সালে পিটার হাইমে’র কেসিংয়ীয় ষড়যন্ত্র নিয়ে থ্রিলার ক্যাপ্রিকর্ন ওয়ান (১৯৭৮) সিনেমা নির্মাণ করেন। এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল, সরকার সবাইকে বোকা বানাচ্ছে। তখনই বিষয়টি আর হাসি তামাশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সিনেমার থিম ছিল মঙ্গলে অভিযান নিয়ে যে মিশনটা সাফল্য লাভ করে। বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য এবং সত্য গোপন রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ সেই মিশনের নভোচারীদের হত্যা করা শুরু করে। যার মধ্যে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন ও জে সিম্পসন। সেই ‘পোস্ট ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল’ যুগে সরকার এমন বড় মাপের একটি মিথ্যাচার করতে পারে এই ধারণা একটি বিশ্বাসযোগ্য বিষয়ে পরিণত হয়।
গডউইন বলেন, অ্যাপোলো ষাটের দশকে আশাবাদ এবং সত্তরের দশকে হতাশাবাদের ক্ষেত্রে একটি চূড়ান্ত ভূমিকা রেখেছিল। তখন আমরা একটি মানুষকে চাঁদে রেখে আসতে পারি। তো এখনও আমরা কেনও অলৌকিক কিছু করতে পারি না। এই প্রবাদটি একটি সাধারণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে। মর্টনের ভাষ্যমতে, অবশ্যই সরকার অনেক অসাধারণ কিছু লক্ষ্য স্থির করতে পারে এবং সেটা পূরণ করার জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন, করতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয়, তারা ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধ জয়, অভ্যন্তরীণ শহরকে পরিচ্ছন্ন করা, ক্যানসারের প্রতিকার কিংবা এসব কিছুই যা মার্কিনিরা আসলেই সবচেয়ে বেশি চেয়েছিল তা পূরণ করতে পারবে। সরকার আসলে যেরকম ক্ষমতাধর হিসেবে নিজেকে দেখাতে চায়, আসলে তারা এতটা ক্ষমতাবান নয়। এই ধারণাটি তখন সবকিছুতে চরমভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। যেটা চন্দ্র ষড়যন্ত্রের বিষয়টিকে একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়।
চন্দ্র ষড়যন্ত্র মূলত কোন কোন বিষয় নিয়ে করা হয়েছে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার চেয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে কোন কোন বিষয় তখন করা হয়নি তার ওপর। অ্যাপেলো, মার্স, জেমিনি এবং অ্যাটলাস মিশনের সবই কি মিথ্যা ছিল, নাকি লাইকা অথবা ইউরি গ্যাগারিন আসলেই কখনো মহাশূন্যে ভ্রমণ করেছিল। এবং কুবকিক কী ভূমিকা পালন করেছে, এ মতবাদগুলো নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে বিভেদ রয়েছে। কিন্তু যখন চন্দ্রষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম প্রজন্ম রাগের মাধ্যমে আবেগতাড়িত ছিল, তখনকার সময় বিষয়টি একঘেয়েমি লাগার চেয়ে আরও কিছু বিষয় ছিল। তখন ষড়যন্ত্র এবং বিনোদনের মধ্যকার তফাৎ অনেক বেশি ঝাপসা ছিল।
তারপরও চন্দ্র ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার মানুষদের যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে বাজ অলড্রিন ২০০২ সালে বার্ট সিব্রল নামক এক ষড়যন্ত্রকারীকে ঘুষি মারেন। যদিও একদিক থেকে বিবেচনা করলে এই ষড়যন্ত্রটা গণহত্যা ও ভ্যাকসিন ভয়াবহ তথ্যের তুলনায় নিরীহ। মর্টন নোট করেন, এটি অনেক অল্প ষড়যন্ত্রের মধ্যে একটা, যা ইহুদিবিদ্বেষ দ্বারা সংক্রমিত না। এমনকি এটি ডেনাল্ড ট্রাম্প যিনি কি না সংবাদমাধ্যমে বিনোদনের বিরাট এক উৎস, তার সঙ্গেও জড়িত নয়। এ বিষয়ে আধুনিক ইন্টারনেটের প্রগতিশীলতাও স্পষ্টত কোনও সাহায্য করতে পারেনি। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ইউটিউবে অ্যাপোলোর ভিডিওগুলো এবং বড় বড় চন্দ্র ষড়যন্ত্রের আগের ভিডিওগুলো অটোপ্লের সারিতে একসঙ্গে দেখা যাবে। কিন্তু এখানে ছোট একটি প্রমাণ আছে, রুশ এজেন্টরা চাঁদ ষড়যন্ত্র এই ভুল তথ্য সরিয়ে দিয়েছে। যেমনটি তারা আগেও করেছিল। উদাহরণস্বরূপ টিকাদানবিরোধী প্রচারণা। আপনি যদি এ ব্যাপারে একটু গভীরভাবে চিন্তা করেন, আপনি এসব করার পেছনে তাদের যুক্তিযুক্ত অনেক কারণ পাবেন। তথ্য নিয়ে যুদ্ধ এবং নীরব যুদ্ধের মধ্যে তাদের সম্মান আবার পুনরুদ্ধার করার একটি পরিষ্কার পদ্ধতি।
আবার সেই সেময় সোভিয়েত ইউনিয়নও আমেরিকানদের কিছু উন্মোচন করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। রুশ মহাকাশচারী অ্যালেক্সিও লিওনোভ সম্প্রতি স্মরণ করেন, ‘আমরা তখন সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটি-৩২১০৩ ছিলাম।’ তিনি আরও জানান, আমি ঈশ্বরের দিব্যি খেয়ে বলছি, আমরা তখন খুবই উদ্বেগের সঙ্গে ওই মুহূর্তের অপেক্ষা করছিলাম। আমরা আশাবাদী ছিলাম, তারা আমাদের স্বপ্ন সত্য করতে পারবে। আমরাও চাচ্ছিলাম এটা হোক। সে সময় বোর্ডে যে মানুষগুলো ছিলেন, আমরা তাদের চিনতাম এবং তারাও আমাদের চিনতো।
লওনিয়াস আক্ষেপ করে বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে বর্তমান শক্তি হলো, জিনিসগুলো সময়ের সঙ্গে দূরে সরে যায় এবং সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। এই জিনিসগুলো আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং গণহত্যার সময় অনুভব করেছি। এই ঘটনায় অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু মানুষ এসব ঘটনাকে সহজেই অস্বীকার করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রূপকথা জন্ম, নেয় এবং এককালে তা প্রভাবশালী তত্ত্ব হিসেবে স্থান নেয়।
সম্ভবত বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কষ্টকর হলো, মানুষ এমন কিছু একটা অতিক্রম করেছে, এমন কিছু একটা অর্জন করেছে, যা নিক্সনের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট কিছু বের করে আনতে পেরেছিল। কারণ তিনি অলড্রিন ও আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে এক ফোনালাপে তাদের বলছিলেন, ‘আপনারা যা কিছু করেছেন, তার মাধ্যমে পুরো পৃথিবী এক হয়ে গেছে। আপনারা চাঁদের মধ্যকার প্রশান্তির সমুদ্র থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন, এটা আমাদের এই পৃথিবীর মধ্যে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের উৎসাহ দ্বিগুণ করেছে।
আমাদের প্রতি আমাদের নিজেদের বিশ্বাসই এখন কমতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ ষড়যন্ত্রকারীই সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এখন একটি পরিহাসের বিষয়ে পরিণত করেছেন। সম্ভবত যদি নাসা আবার ২০২৪-এর দিকে ট্রাম্পের খেয়ালমতে চাঁদে আবার ফেরত যায়, এটা তখন মঙ্গলের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
তথাপি আপনার এই ষড়যন্ত্রকারীদের অধ্যবসায় ও মতামতগুলোকে অ্যাপোলো বিজ্ঞানীদের মতামত হিসেবে খুঁজে পেতে পারেন। মর্টনের ভাষ্যমতে, একদিক থেকে চাঁদ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা অন্যান্য মানুষের তুলনায় অ্যাপোলো মিশন নিয়ে অনেক বেশি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেন। সত্যি বলতে চাঁদে অবতরণ আসলে পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রায় কোনও পরিবর্তন আনেনি। অন্তত এখন পর্যন্ত নয়।
এই প্রবন্ধটি ১০ এবং ১১ জুলাই ২০১৯-এ সংশোধন করা হয়েছে। এর প্রথম সংস্করণে বলা হয়েছিল, নাসার অ্যালান শেফার্ডকে ১৯৬১ সালের মে মাসে উন্মুক্ত করেছিল। যাই হোক, অভিযানটি আংশিক কক্ষপথের। উপরন্তু নাসা ১৯৬৩ সালে মার্কিন কেন্দ্রীয় বাজেটের ৪ শতাংশেরও বেশি ভোগ করেছিল, পুরো দেশের জিডিপির ৪ শতাংশের বেশি নয়। যেমনটি আগের লেখাতে বলা হয়েছিল। এই তথ্যগুলো সংশোধিত হয়।
অনুবাদ: গ্লোরিয়া অমৃতা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct