শিশুপাঠ্য গ্রন্থ ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নিজের জীবনে এই গ্রন্থটির প্রভাব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
“ সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না—তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনও তাহার ঝংকারটা ফুরায় না, মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িত ও পাতা নড়িতে লাগিল।” [ শিক্ষারম্ভ / জীবনস্মৃতি]
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে [ ১লা বৈশাখ, সংবৎ ১৯১২]। ৭৫ বছর পরে ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’। শান্তিনিকেতন প্রেস থেকে রায়সাহেব জগদানন্দ রায় প্রকাশ করেন এই বই। ‘সহজপাঠে’ রচনার প্রেরণা সম্পর্কে চিত্তরঞ্জন দেব লিখেছেন :
“ মিলের খেলাতেই তিনি বিশ্বজয়ী হয়েছেন। এই মিলের খেলার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে তাঁর জীবনের নানা পর্যায়, নানা বাসনা-কামনা, তার রূপায়ণে নানা সমস্যা। সংসারী হয়েছেন। পত্নীরূপে পেয়েছেন মৃণালিনীদেবীকে। পাঁচটি পুত্র-কন্যার জনকরূপে একদিন যখন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে এসে সংসার পেতেছেন, এসেছে আপন সন্তানদের শিক্ষাদানের পালা। শিশুদের বর্ণপরিচয়ের কথা চিন্তা করে মনে পড়ছে তাঁর শেশবে পড়া ‘বর্ণপরিচয়’ বইখানির কথা। বইখানির নাম ভুলে গেলেও ভুলতে পারেন নি সেই বই-এর জল পড়া ও পাতা নড়ার ছন্দটি। ঠিক তেমনই ছন্দে লিখতে চাইলেন তিনি তাঁর পরিকল্পিত প্রথম শিশুপাঠ্য। ঠিক করলেন, তাঁর বই-এ তিনি বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে করে তুলবেন মিলের খেলা। শিশুরা যাতে সহজে চিনতে পারে প্রতিটি বর্ণ, খেলার ছলে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে হল বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়ে’র চেয়েও সহজ করে লিখবেন একখানি বই। ‘সহজপাঠ’ নামটি তাঁর মনে এসেছিল কিনা, সেকথা অবশ্য জানা যায় না।” [ সহজপাঠের সুবর্ণ জয়ন্তী / দেশ / ১০ শ্রাবণ, ১৩৮৭ ]
‘সহজপাঠ’ রচনার কাজ সর্বাগ্রে হাতে নিলেও দেখা গেল অন্যান্য সংস্কৃত ও ইংরেজি শিশুপাঠ্য গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হবার পরে ‘সহজপাঠ’ প্রকাশিত হয়। শ্রীদেবের অনুমান, হয়তো বা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল বাংলা পাঠ্যগ্রন্থ শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আরও কিছু ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের শিশুপাঠ্য গ্রন্থের সংখ্যা ১২ টি। তার প্রথম দিকে আছে সংসকৃত ও ইংরেজি গ্রন্থ। সেগুলি প্রকাশ করার পরে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য রাখতেন তাদের মধ্যে কোন অসঙ্গতি ও অপূর্ণতা আঢ়ে কিনা। এইসব অসঙ্গতি ও অপূর্ণতা সামনে রেখে, আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ‘সহজপাঠ’ রচনা ও প্রকাশ করলেন।
‘সহজপাঠ’ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম ভাগের আরম্ভেই মুদ্রিত হল স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয় ছোট ছোট ছন্দোবদ্ধ বাক্যের সাহায্যে। প্রথম ভাগে আছে মোট দশটি পাঠ। প্রতিটি পাঠ শুরু হয়েছে গদ্য রচনা দিয়ে, সমাপ্ত হয়েছে কবিতায়। দ্বিতীয় ভাগে আছে মোট ১৩ টি পাঠ। প্রথম ভাগের মতো দ্বিতীয় ভাগে কিন্তু প্রতিটি গদ্যপাঠের পরে একটি করে কবিতা পাওয়া যায় না।
‘সহজপাঠে’র কবিতাগুলি রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যত ভাবনা করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবনা করেছেন গদ্য রচনাগুলির ক্ষেত্রে। অপরিসীম ধৈর্য্য সহকারে শব্দচয়ন করেছেন, সেইসব শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন করেছেন, বাক্যগুলি সন্নিবেশিত করে চোখের সামনে এক একটি ছবি মেলে ধরেছেন।
‘সহজপাঠে’র সাহিত্যগুণ ও মনোজয়িতা অনন্যসাধারণ। বুদ্ধদেব বসুর মতে :
“ পাঠ্যপুস্তক বলে যদিও রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর প্রতিভাকে সীমিত রেখেছিলেন তথাপি তার প্রয়োগে কোন কার্পণ্য করেন নি।‘সহজপাঠ’ যেন প্রতিভার বেলাভূমিতে উৎক্ষিপ্ত, ক্ষুদ্র, নিটোল, স্বচ্ছ একটি মুক্তো। এর ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে চরিত্র, আর সেই সঙ্গে ব্যবহারযোগ্যতা, ছন্দোবদ্ধ ভাষায়, ভাষার কান্তিতে, চিত্ররূপের মালায়, গদ্যছন্দের বৈচিত্র্যে, অনুপ্রাসের অনুরণনে ‘সহজপাঠ’ অনবদ্য।
“ যে বয়েসে ক-খ চিনলেই যথেষ্ট সেই বয়সেই সাহিত্যরসে দীক্ষা দেয় ‘সহজপাঠ’। এই একটি বইএর জন্য বাঙালি শিশুর ভাগ্যকে ঈর্ষাযোগ্য বলে মনে করি।” [ বাংলা শিশু সাহিত্য / প্রবন্ধ সংকলন ]
ড. অরবিন্দ পোদ্দার ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই বইএর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে প্রাগাধুনিক জগতে মোহরঙিন জগতের দিকে শিশুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হত না বলেই শিক্ষা তার কাছে বিভীষিকা হয়ে দেখা দিত। রবীন্দ্রনাথ শিশুমনের প্রয়োজনের দাবি মিটিয়ে ছিলেন। [ রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্য ]
শিশুর সামগ্রিক বিকাশে ‘সহজপাঠ’এর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সুপ্রিয়া কর্মকার ও দেবপ্রসাদ সিকদার। তাঁদের বক্তব্য শিশুপাঠ্য গ্রন্থ হিসেবে ‘সহজপাঠ’ একেবারেই স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতায় সচেতনতার সঙ্গে শিশুমনের উপযোগী করে তদানীন্তন সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক বিষয় উপস্থাপিত করেছেন। গ্রাম,শহর, আচার-আচরণের সঙ্গে শিশুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। যে ৭ টি দিক নিয়ে কর্মকার ও সিকদার দৃষ্টান্ত দিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলি হল :
ক] সহজপাঠ ও শিশুর দৈহিক বিকাশ
খ] সহজপাঠ ও শিশুর মানসিক বিকাশ
গ] সহজপাঠ ও শিশুর সামাজিক বিকাশ
ঘ] সহজপাঠ ও শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশ
ঙ] সহজপাঠ ও শিশুর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ
চ] সহজপাঠ ও জাতীয় সংহতির বিকাশ
ছ] সহজপাঠ ও শিশুর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশ
১৯৮০ সালে ‘সহজপাঠ’কে কেন্দ্র করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নকল্পে এক নতুন সিলেবাস কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি ‘সহজপাঠে’র বদলে নতুন শিশুপাঠ্য প্রণয়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে সামিল হন দেশের বুদ্ধিজীবীরা। নীহাররঞ্জন রায়, সুশোভন সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, গোপাল হালদার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুশীল মুখোপাধ্যায়, সুবিনয় রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশি, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবু সৈয়দ আইয়ুব প্রমুখরা সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন। সিপিআই, কংগ্রেস[আই] প্রভৃতি রাজনৈতিক দলও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। ‘সহজপাঠ : কঠিন কথা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। ‘যুগান্তর’ লেখেন ‘অনিলাদেবীরা আবার ভাবুন’।
সরকারপক্ষের বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কে যোগ দেন। প্রভাতকুমার গোস্বামীর ‘ নতুন পাঠ্যসূচি ও সহজপাঠ’ , শুভঙ্কর চক্রবর্তীর ‘সহজপাঠের বিকল্প ভাষাপাঠ কি অন্যায় হবে’, সোমনাথ দে-র ‘ সহজপাঠ : কিছু ভাবনা’, হীরেণ দাশগুপ্তের ‘প্রাথমিক পাঠ্যসূচি ও সহজপাঠ’, প্রভৃতি লেখায় এবং এ বি টি এ-র নেত্রী অনিলাদেবীর বক্তব্যে সরকারপক্ষকে সমর্থন করা হয়।
যাঁরা সরকারপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের অভিযোগগুলি এইরকম :
ক] গোপনীয়তার অভিযোগ। তাঁদের মতে দেশের মানুষকে , শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষানুরাগীদের না জানিয়ে, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ না করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। প্রমথনাথ বিশি ও সোমেন্দ্রনাথ বসু প্রশ্ন তুললেন-
•‘সহজপাঠ’ কোন শিক্ষকমণ্ডলী বাতিল করার সুপারিশ করেন ?
•‘সহজপাঠ’ যে যোগ্য নয় কে তার বিচার করলেন ?
•নতুন পাঠ্যগ্রন্থ রচনা্য় কোন ভাষাবিজ্ঞানী আছেন ?
• সমস্ত ব্যাপারটা এত গোপনে করা হল কেন ?
খ] রবীন্দ্রবিরোধিতার অভিযোগ। নীহাররঞ্জন রায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে সেই অভিযোগ করেছেন। তাঁর মতে ‘ পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বামপন্থী সরকারের যে রাজনৈতিক দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথের প্রতি সে দলটির দৃষ্টি ও চিন্তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে।’ রবীন্দ্রনাধ বেঁচে থাকলে নিজেই ‘সহজপাঠে’র পরিবর্তন করতেন—অনিলাদেবীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ‘আমমোক্তারনামা কে দিল’ প্রবন্ধে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত বললেন, ‘ অনিলাদেবী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সহজপাঠ বদলাতেন। একথা তিনি জানলেন কি করে ? রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরে তাঁর মনের প্রতিচ্ছবি অনিলাদেবীর কাছে কেমন করে এল ? রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে আমমোক্তারনামা দিয়ে গিয়েছেন একথা তিনি মানুষকে কেন বোঝাতে চাইছেন ?’
গ] দলবাজি ও ক্ষুদে কমিউনিস্ট বানানোর অভিযোগ। সিলেবাস কমিটির ২৩ জন সদস্যের তালিকা পড়লে দলবাজির অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদক মনে করেন যে কমিউনিস্ট তৈরির প্রচেষ্টার জন্য সিলেবাস কমিটিতে বেছে বেছে দলের লোকেদের গ্রহণ করা হয়েছে ( ২৮.১০.৮০ )। দেখা যাচ্ছে এই সিলেবাস কমিটিতে কোন ভাষা বা শিক্ষাবিজ্ঞানীর স্থান হয় নি, স্থান হয় নি প্রখ্যাত কোন লেখকের। রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, বিমল মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপকরা ভিন্ন এক যুক্তি তুলেছিলেন, ‘ শিক্ষকদের দীর্ঘকালের দাবি যে পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা ও পরিবর্তনে নির্দিষ্ট স্তরের শিক্ষকদের মতামত নেওয়া উচিত। ... যাঁরা কখনও সুকুমারমতি শিশুশ্রেণিতে পড়ালেন না, তাদের জন্য কিছু লিখলেন না, তাঁরা যত বড় বুদ্ধিজীবী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকই হোন, তাঁদের প্রতিবাদ যতটা জনবিরোধী রাজনীতির অঙ্গ, ততটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।’(গণশক্তি / ২৭.১০.৮০ )। মহাশ্বেতা দেবী এই যুক্তিকে সমর্থন করে লেখেন, ‘সবচেয়ে দরকারি হল , এ বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষাদানকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করা।’ ( দৈনিক বসুমতী ২৪,১০,৮০ )
‘সহজপাঠ’ প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে শুধু আন্দোলন নয়, এই প্রসঙ্গে ‘সহজপাঠে’র সাহিত্যগুণ, শিশুমনের ক্ষেত্রে তার উপযোগিতা ইত্যাদির ব্যাপক আলোচনা-বিশ্লেষণ শুরু হল। গত ৪০ বছরের মথ্যে এই বইকে কেন্দ্র করে এত আলোচনা হয় নি। এত প্রতিবাদ সত্বেও বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ৩০ বছর পরে ‘সহজপাঠে’র শাপমুক্তি ঘটল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct