তিরুনেল্লাই নারা্যণ আয়ার শেষন ১৯৯০ সালে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার হন । এই পদে তিনি ছিলেন ৬ বছর । দলমতনির্বিশেষে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা এই ৬টি বছর আতঙ্কে ছিলেন । বাহুবলের প্রতাপ আর দুর্নীতির পঙ্ককুণ্ড থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন শেষন । রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছাচার, ভণ্ডামি আর ছলনায় মানুষ যখন তিতিবিরক্ত ও হতাশ তারা এক মুণ্ডিত মস্তক, আকার ও প্রকারে বিশাল এক বাঘের হুঙ্কার শুনতে পেল : ‘ গাজরের মতো আমি রাজনীতি আর রাজনীতিকদের চিবিয়ে খাই ।’
সেই বাঘের নাম টি এন শেষন । তাঁর হুঙ্কার শুনে সাধারণ মানুষের বুকের ভেতরে গুঞ্জরিত হয়ে উঠতে লাগল একটা স্বপ্ন । মনে হল : পারবেন, ইনি পারবেন । আমাদের টাইট করে রেখেছেন যাঁরা, তাঁদের ইনি পারেবেন টাইট করতে । শেষনের আস্ফালনটা বৃথা নয় । কারণ ইনি এলেবেলে সাধারণ নন । যেমন চৌখশ ছাত্র, তেমনি দুঁদে আমলা । স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুই স্তরে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম । আই পি এস ও আই এ এস দুটোতে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী । বুদ্ধিমান, তীক্ষ্মদর্শী। কর্মজীবনে বড় বড় পদের অভিজ্ঞতা । পরমাণু দপ্তরের ডিরেক্টর, মহাকাশ গবেষণা দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী দপ্তরের সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, ক্যাবিনেট সচিব, যোজনা কমিশনের সদস্য । এবং অবশেষে ১৯৯০ সালে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার ।
আদর্শ আচরণবিধি তৈরি করলেন শেষন । সে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেই গ্রেপ্তার । যে সব অফিসারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ, তাঁদের করতে লাগলেন সাসপেন্ড । এমন কি ছাড় পেলেন না স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও । তাঁর মন্ত্রীসভার দুই সদস্য ভোটারদের প্রভাবিত করছেন, এই অভিযোগে তাঁদের সরিয়ে দিতে বললেন শেষন । এমন কি সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনার চেষ্টাও হয়েছিল । শেষন দ্বিধাহীন এবং ভয়হীন । নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কি তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি । সে কথা স্বীকার করেছেন তাঁর উত্তরাধিকারীরা । সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন যে শেষনের আমলে নির্বাচন কমিশন যে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার ।
আমাদের স্বপ্ন সেই শেষন ১৯৯৬ সালে নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নিলেন । ১৯৯৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হলেন । নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরতে লাগলেন । পশ্চিমবাংলায়ও এলেন । জ্যোতি বসুর কাছে । আমরা তবুও আশা করেছিলাম । একবার বসুন না রাষ্ট্রপতি হবে ! ঠুঁটো জগন্নাথের পদটাকে দেবেন তিনি সজীব করে । রাষ্ট্রপতি শেষনের কাছে প্রধানমন্ট্রীরও জারিজুরি খাটবে না । আইনের শাসন হবে । না হলে আটকে দেবেন বিল । ডাকবেন আদালতকে । জোরদার তদন্তের আদেশ দেবেন ।
রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হতে গিয়ে তাঁকে যখন শিবসেনার কাছে হাত পাততে হল, তখনও স্বপ্নভঙ্গ হয় নি আমাদের । কি আর করবেন ! অন্যদলগুলো তো হাত গুটিয়ে নিয়েছে । হয়তো সাহসে কুলোচ্ছে না তাদের। ফল যা হবার তাই হল । শোচনীয় পরাজয় হল শেষনের । আমরা ভাবলাম এবার সসম্মানে বিদায় নেবেন তিনি । কিন্তু তিন বছর পরে তাঁকে দেখা গেল রাজনীতির অঙ্গনে । শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবি পরা শেষনকে চিনতে পারা যায় না যেন । ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচন । গান্ধিনগরে শেষন কংগ্রেস দলের প্রার্থী । বংশগতভাবে ক্ষমতার দাবিদার নেহেরু পরিবারের অনুগ্রহপ্রার্থী তিনি । সে জেদ নেই, সে মেজাজ নেই, নেই সেই হুংকার । একদিন যাদের চিবিয়ে খাবেন বলেছিলেন, আজ তাঁদের হাতে নিজেকে শর্তহীনভাবে তুলে দিয়েছেন তিনি । এভাবে সর্বগ্রাসী রাজনীতি চিবিয়ে খেতে লাগল শেষনকে । অর্থের লোভ না থাকলেও হয়তো ক্ষমতার লোভ তাঁর মনের গভীরে হানা দিতে শুরু করেছিল ।
সেই শেষন আজ দিন কাটাচ্ছেন চেন্নাইএর এক বৃদ্ধাশ্রমে । সন্তান নেই তাঁর । স্ত্রী জয়লক্ষ্মী ছিলেন । গত বছর মারা গেলেন স্ত্রী । তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে শেষন মারা গেছেন । নিঃসঙ্গ শেষন এখন দিন গুনছেন । আমাদের দেশে আবার নির্বাচনের ঢাক বেজেছে । লোকসভা নির্বাচন । বাহুবল ও অর্থবলের খেলা শুরু হয়েছে । নির্বাচন এলেই মনে পড়ে শেষনের কথা । স্মৃতি তুমি বেদনা ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct