১৯২০ সালের ২৪মে অবিভক্ত বাংলাদেশের ঢাকায় সোমেন চন্দের জন্ম। সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে তিনি প্রগতি পাঠাগার পরিচালনা করেন, প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তোলেন ঢাকায়, রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্ব করেন, হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করার পর ফ্যাসিবিরোধী প্রচার শুরু করান। এসব রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহিত্য রচনার কাজও করে যান। তাঁর ১টি উপন্যাস, ২টি নাটিকা, ৩টি কবিতা এবং ২৪টি ছোটগল্প পাওয়া গেছে। আমরা গল্পকার হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করে জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা নিবেদন করব।
সোমেনের রচনা সম্বন্ধে সবচে্য়ে বড় কথা তিনি তাঁর রাজনীতিকে মেলাতে পেরেছিলেন শিল্পের সঙ্গে। গল্পের আড়ালে কোন মতবাদ প্রচার করেন নি তিনি। তাঁর গল্পগুলি যেন বেদনার কুসুম। দরিদ্র তরুণীর মর্মজ্বালা, অবহেলিতা বৃদ্ধার মর্মদাহ, বঞ্চিতা বধূর আত্মপীড়ন, নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণের অসহায়তা ও দীর্ঘশ্বাস তাঁর গল্পের বিষয়। কিন্তু সোমেন জীবনের অপরিমেয়তাব বিশ্বাস করতেন বলে গল্পের ভেতর থেকে যায় এক প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ ।
তথ্যের অভাবে আজ আর সোমেনের গল্পগুলির সঠিক কালানুক্রমিক বিভাগ করা সম্ভব নয়। তবু গল্পের বিষয় ও ভাষার নিরিখে তাঁর মানসবিবর্তনের ধারা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। শিশুতপন, ভালো-না-লাগার শেষ, গান, প্রত্যাবর্তন- প্রভৃতি গল্পকে প্রথম পর্বের রচনা বলা যেতে পারে। মহাপ্রয়াণ গল্প থেকে তাঁর মানস-পর্বান্তর সূচিত হয়েছে। এবার লেখক মানব চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করতে চলেছেন, বিদ্ধ করতে চেয়েছেন মানবসমস্যার উৎস। দেখা যাচ্ছে এখন তাঁর এক বিশিষ্ট জীবনবোধ গড়ে উঠেছে, এবং সেই বোধকে রূপ দেবার জন্য তিনি আয়ত্ত করেছেন শিল্পরূপ। এ পর্বের অন্তর্গত : ইঁদুর, সংকেত, একরাত্রি, দাঙ্গা, মুহূর্ত, অকল্পিত, অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন প্রভৃতি গল্প।
সোমেনের অধিকাংশ গল্পে ইঙ্গিতগর্ভ সংক্ষিপ্ততা ছোটগল্পের বিশিষ্ট দ্যুতি এনেছে। ব্যতিক্রম বনস্পতি গল্প। মনে হয় এ গল্পের মূল পরিকল্পনা উপন্যাসের। এতে শুধু আকারগত বিস্তার নেই, আছে কালেরও বিস্তার। দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে গল্পের কাহিনি। ইঁদুর, একটি রাত বা সংকেত গল্পের আয়তন বড়, কিন্তু তাদের ভাবগত ঐক্য আছে, আছে বিশিষ্ট সংহতিকেন্দ্র। মহাপ্রয়াণ ও মুহূর্ত একেবারে নির্ভেজাল ও সার্থক ছোটগল্পের উদাহরণ ।
সোমেনের গল্পে আরম্ভ ও পরিসমাপ্তির নাটকীয়তা আমাদের চমকিত করে। গল্প শেষ করে মনে হয় শেষ হয়ে না হইল শেষ। নাটকীয়তার পাশাপাশি আছে কাব্যময়তা। বাক্যগঠন ও শব্দচয়নেও তাঁর সতর্কতা আমাদের অবাক করে। জীবনের খন্ডাংশের পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন নিপুণ নিষ্ঠায়। বিন্দুতে সৃষ্টি করেছেন সিন্ধুর অভিব্যঞ্জনা। পদ্মা নামের কিশোরী হয়ে উঠেছে বঞ্চিত ও অসহায় মানুষের প্রতিনিধি। নির্বোধ তাঁবেদার শ্রীপতি যেন আত্মবিক্রিত মানুষের প্রতীক, ঘটনার আঘাতে আঘাতে মানুষের কিভাবে জাগরণ হয় রহমান তারই উদাহরণ। গল্পের মথ্যে লেখক আশ্চর্য কৌশলে তুলে ধরেছেন এক উদ্যত জিঞ্জাসা, এক উচ্চকিত প্রশ্ন ।
পরম দুঃখের বিষয় এই যে জীবনের মুকুলবিকাশের পর্বেই সোমেনের জীবনের উপর যবনিকা পড়ে গেল ঘাতকের ছুরি রুদ্ধ করে দিল তাঁর কণ্ঠ। এতে বিপুল ক্ষতি হল বাংলা সাহিত্যের ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct