কর্নেল মহিমচন্দ্র । রাজা নন, কিন্তু ত্রিপুরা রাজপরিবারের এক প্রভাবশালী পুরুষ । বর্ণবন্ত চরিত্র তাঁর, তুলনাহীন ব্যক্তিত্ব । সাংবাদিক হরিশ মুখার্জীর মতো প্রথাগত শিক্ষা ছিল না তাঁর অথচ তাঁরই মতো ইংরেজি ভাষায় অনন্য পারদর্শিতা । দুজনেই স্বশিক্ষিত এবং বিচক্ষণ । দুজনেরই প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞান । তবে হরিশ ছন্নছাড়া, মদ্যাসক্ত ; কর্নেল মহিম হিসেবি ও স্থিতধী ।
আগরতলার ঠাকুর পরিবারে ১৮৬৪ সালে মহিমের জন্ম । ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য মাত্র তিনবছরের । মহিমের পিতা ভারতচন্দ্র ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের রাজপরিষদ, মাতা সাবিত্রী রানি ভানুমতীর সহচরী । মহিমচন্দ্রের জীবনে সাবিত্রদেবী ছাড়া আর যে নারীর গভীর প্রভাব পড়েছিল তিনি তাঁর জ্যাঠাইমা । মহিমের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কুমিল্লা শহরে । তারপর তিনি চলে এলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে । কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না তিনি । কারণ অকৃতকার্য হলেন অঙ্কে । প্রথাগত লেখাপড়ায় ইতি এখানেই ।
অঙ্ক নয়, মহিমের রুচি ও অনুরাগ সাহিত্যে । তাই বলেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এবং সেই সূত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অনায়াস যাতায়াত, রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য । সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যালোচনায় হৃদয়কে রঞ্জিত করা । তবু বৈপরীত্য ও ব্যতিক্রম ছিল । রসের জগতে বিচরণ করেও মহিম রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্মের পাঠও গ্রহণ করেছিলেন । নবাব আবদুল লতিফ চিনতে ভুল করেন নি তাঁকে । তিনি মহিমকে নিয়ে এলেন লাটসাহেবের দফতরে। নিযুক্ত করলেন আবগারি দফতরে পরিদর্শকের পদে ।
ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র অনেকদিন ধরে নীরবে লক্ষ্য করছিলেন মহিমকে । ভাবছিলেন আর একটু পরিণত হলে বলা যাবে । কিন্তু যখন দেখলেন সরকারি চাকরিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত পাকা হতে যাচ্ছে, তখন ডেকে পাঠালেন মহিমচন্দ্রকে নিযুক্ত করলেন তাঁর এ ডি সি পদে । সেই থেকেই মহিমচন্দ্র ত্রিপুরা রাজসভার সঙ্গে যুক্ত । সুদক্ষ প্রশাসক, নানা বিরোধের সেতু, নানা সংকটের পরিত্রাতা এবং কিছু ষড়যন্ত্রের শিকার ।
ত্রিপুরার রাজপরিবারে যোগদানের কিছুপূর্বে মহিমচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় । তরুণ রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ পাঠ করে আপ্লুত বীরচন্দ্র রাধারমণ ঘোষকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন কবির কাছে । আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
“ মহারাজ তাঁকে সুদূর ত্রিপুরা হতে বিশেষভাবে পাঠিয়েছিলেন কেবল জানতে যে, আমাকে তিনি কবিরূপে অভিনন্দিত করতে ইচ্ছা করেন ।”
রাজা ও কবির পরোক্ষ পরিচয় ঘটল যখন মহিম তখন কলকাতায় । মহারাজের নির্দেশ এল তাঁর কাছে। মহিম জানাচ্ছেন : “বাংলায় প্রকাশিত নতুন গ্রন্থ মহারাজ বীরচন্দ্রের নিকট পেশ করিবার ভার আমার মতো কিশোর সেবকের উপর অর্পিত ছিল, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সহিত আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হয় ।”
বীরচন্দ্র মাণিক্যের উত্তরাধিকারী কে হবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব সংকট সৃষ্টি হয় । শেষপর্যন্ত রাধাকিশোরই রাজপদ লাভ করেন । মহিমছিলেন রাধাকিশোরের পক্ষে । রাধাকিশোরের রাজত্বকাল ছিল ১৮৯৭-১৯০৯ । এই বারো বৎসরের সময়সীমায় রবীন্দ্রনাথ রাজার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তাঁর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন, নানাবিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, প্রশাসন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন । মহিমচন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে । কিন্তু এর মধ্যেই সূত্রপাত হয়েছে বিরোধের ।
ত্রিপুরা রাজ্যে তখন শোচনীয় আর্থিক অনটন । তারই মধ্যে বন্ধু রবীন্দ্রনাথের আবেদনে রাজা অন্ধকবি হেমচন্ড্র বন্দোপাধ্যায়ের জন্য মাসিক ১৫টাকা বৃত্তি বরাদ্দ করেছেন, বিলাতে গবেষণার জন্য জগদীশচ্দ্র বসুকে ১০ হাজার টাকা দান করেছেন, ‘বঙ্গদর্শন’ পুনঃপ্রকাশের জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন । এসব ব্যাপারকে মহিমচন্দ্রের অবিমৃশ্যকারিতা বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় ।
প্রশাসনিক ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের উপর রাধাকিশোরের আত্যন্তিক নির্ভরতা মহিমচন্দ্রের পছন্দ হয় নি । রবীন্দ্র ও মহিম দুজনেই রাধাকিশোর তথা ত্রিপুরার মঙ্গলাকাঙ্খী ছিলেন কিন্তু সেই মঙ্গলসাধনের পথ সম্বন্ধে দুজনের মতের পার্থক্য ছিল।
১. রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রাধাকিশোর মহৎ মানুষ, কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ । তাই উপযুক্ত মন্ত্রী নির্বাচন করে তাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করা প্রয়োজন ।
মহিমচন্দ্র কিন্তু রাজার কর্তৃত্ব খর্ব করার ব্যাপারে একান্তভাবে বিরোধী ছিলেন।
২. রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্র বিশ্বস্ত বহিরাগতের উপর নির্ভর করতে বলেছিলেন ।
মহিমচন্দ্র কিন্তু এক্ষেত্রে ত্রিপুরার ভূমিপুত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
সম্ভবত মন্তী নিয়োগের ব্যাপারে সম্ভবত মহিমচন্দ্রের একটা অভিমান ছিল রবীন্দ্রনাথের উপরে। মহিমের যোগ্যতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের উচ্চ ধারনা ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘ইহা নিশ্চয় বুঝিয়াছি মহিমের বুদ্ধি অত্যন্ত দ্রুত ও তীক্ষ্ম, তাঁহার ধারনা শক্তি প্রবল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের হিত সম্বন্ধে তাঁহার যে উৎসা্ নাই তাহা নহে।’ অথচ মহিমকে মন্ত্রীপদে নিয়োগের সুপারিশ করেন নি তিনি।
মহিম সম্বন্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন সেটাও মহিমের অভিমানের কারণ হতে পারে। মহিমকে লেখা কবির দুটি চিঠির কিছু অংশ :
১. ‘ তুমি মহারাজের অনুগ্রহে পালিত, ত্রিপুরার এই অবস্থায় তুমি কি সর্বনাশের স্রোত ঠেকাইবার জন্য একাগ্রমনে চেষ্টা করিয়াছ ? নাকি স্বার্থান্বেষী.......’
২. ‘ লোকের সাধু উদ্দেশ্যে তোমাদের বিশ্বাস নাই—সকলকেই তোমরা সন্দেহচক্ষে দেখ-মহারাজের স্বাভাবিক ঔদার্যকে তোমরা আচ্ছন্ন করিয়া আছ।’
রাজা রাধাকিশোরকে লেখা এক চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথ মহিমচন্দ্রের বুদ্ধিমত্তা স্বীকার করেও বলেন, ‘ কিন্তু সেই সঙ্গে তাহার দুর্বলতা আছে। সে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ একেবারে ভুলিতে পারে নাই, এই আমার বিশ্বাস।’
মহিমচন্দ্রের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই ভ্রান্তির মূলে ছিল ত্রিপুরার বাঙালি কর্মচারীদের বিকৃত তথ্য পরিবেশন। মহিম সম্বন্ধে ঈর্ষান্বিত ছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের কান ভাঙানোর কাজও করে যাচ্ছিলেন ক্রমাগত।
শেযপর্যন্ত রাধাকিশোরই রবীন্দ্রনাথের ভ্রান্তি দূর করেন। বিরোধের পরে ফিরে আসে বন্ধুতা । রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে লেখেন :
“ মহিম সম্বন্ধে আমার যে ধারনা হইয়াছে তাহা সম্ভবত অমূলক এবং সেই অমূলকতার সম্ভাবনা মনে রাখিয়াই তাহার সহিত বন্ধুভাব রক্ষা করা আমার পক্ষে কঠিন হয় না ।.... মহিম সম্বন্ধে আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হইয়া আছি । ”
( লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক )
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct