দোতলার ঘরে ভৃত্যরাজতন্ত্রে বন্দি বালকটি উন্মুখ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত বাইরের দিকে। দেখত সূর্যালোক, মেঘের খেলা, বাতাসের হিল্লোল, গাছপালার কম্পন। এইতো প্রকৃতি। মনে হত প্রাণের স্পন্দন আছে তাদের মধ্যে। এই সজীব প্রকৃতির সঙ্গে তার প্রথম প্রেম। পূর্বরাগের পর্ব শেষ হয়ে মিলনের পর্ব শুরু হবে। কিন্তু তখনও বাধামুক্ত হয়নি মিলন। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে খাঁচার পাখির সঙ্গে বনের পাখির মিলন হত চঞ্চুতে চঞ্চুতে। মুক্ত প্রকৃতির অনুভূতিময় স্পর্শ বন্দি বালকের শিরায় শিরায় দুর্বার এক ইন্ধন সঞ্চার করে দিয়েছিল। ‘পুর্ব জনমের স্মৃতি’ তাড়িত করেছে তাকে। কি এক অদৃশ্য বন্ধন আছে এই বসুন্ধরার সঙ্গে। ‘ছিন্নপত্র’এর একাধিক পত্রে, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ প্রভৃতি কবিতায় পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে, বসুন্ধরার সঙ্গে তাঁর জন্মান্তরীণ সম্পর্ক প্রকাশ করেছেন। এই সৌহার্দ্যের জন্যই ‘বিপুলা এ পৃথ্বীর কত আয়োজন’ দেখার আগ্রহ।
‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’র পরে তাঁর যে দুর্বার চলমানতার উৎসমুখ অবারিত হল, তার মূলে আছে ইঙ্গিতে সঙ্গীতে নৃত্যের ভঙ্গিতে প্রকৃতির অঙ্গুলিসংকেত। যৌবন সন্ধিলগ্নে স্বাধীনভাবে বাইরে বিচরণের প্রথম সুযোগ এল জমিদারি তত্ত্বাবধানের আদেশে।‘অবারিত মাঠ গগন ললাট’ সুন্দরী বঙ্গভূমির নিবিড় সংস্পর্শে এলেন তিনি। দেখলেন পদ্মাকে। চিনলেন তাকে। পদ্মার অবিরাম প্রবাহ তাঁর বিশিষ্ট জীবনদর্শন গড়ে তুলতে সাহায্য করল। পদ্মা এক নদী। চলাই তার ধর্ম। যখন সে স্থির তখন বদ্ধ জলা মাত্র, ‘অন্ধ মূক কবন্ধ’। স্রোতের আবেগে সে ভরিয়ে ভাসিয়ে চলে যায় সম্মুখের দিকে। কি তার বাণী ? ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে’। গতির আবেগে বারবার সে উজাড় করে দেয় নিজেকে—‘চলার আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় করি ক্ষয়’। সঞ্চয় তার ধর্ম নয়। ‘যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই’। নদীর কথা এভাবেই বলেছেন কবি। ‘বলাকা’ কাব্যে। এ তাঁর নিজের কথাও। নদীর স্রোত, ক্রমাগ্রসরমান স্রোতের আবেগ সংক্রমিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে।
যৌবনবিকাশ থেকে তাঁর জীবনে শুরু হয়েছিল অবারণ অবিরাম পথচলা। রবীন্দ্রজীবনচরিত তল্লাশ করলে জানা যাবে একনাগাড়ে তিন মাসের বেশি কোথাও থাকেন নি তিনি। আমাদের মতো গৃহস্থ মানুষের যেমন একটা স্থায়ী ঘর থাকে, তেমন কোন ঘর রবীন্দ্রনাথের ছিল না। ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। আভিধানিক অর্থে ভ্রমণবিলাসীরাও তাঁর ভ্রমণের পরিমাণ বৈচিত্র্যে লজ্জা পাবেন। গভীর আত্মীয়মমতায় তিনি স্পর্শ করেছিলেন পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভূখণ্ড। কিন্তু তারপরেও ‘বিপুলা এ পৃথ্বীরে আমি কতটুকু জানি’ বলে কি গভীর ক্ষোভ ও ব্যাকুলতা।
তবু তিনি লৌকিক জগতের অধিবাসী, সীমা আছে শারীরিক শক্তির। কিন্তু বসুন্ধরার অনেক কিছু যে ‘রয়ে গেল অগোচরে’। তাই তিনি কল্পনার পক্ষবিহারী হয়ে অতিক্রম করেন সেই সীমা। কল্পনার বিমানগতিতে উপনীত হন দুর্গম মেরুপ্রান্তে চিরতুষারাবৃত জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গতার ধূসর রাজ্যে, উড়ে আসেন ঘন অরণ্যের জটিল জটার জালে বন্দি অন্ধকারের রহস্যময় গহ্বরে, আবার মুহূর্তেই স্থাপিত হন মরুভূমির কেন্দ্রে একটি উজ্জ্বল নির্জন তারকার স্নিগ্ধ অনিমেষ দৃষ্টির ছায়ায়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও নাটকে বারবার এসেছে পথের প্রসঙ্গ। সে পথের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই, সে পথ বাধাগ্রস্ত হয় নি কোথাও, সে পথের পদেপদে দুঃখদহনের সাধনা। সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে করতে এগিয়ে চলেন কবি। পথের বাহ্যরূপের পরিবর্তন হলেও অন্ত্যহীনতার সুর লেগে থাকে। কবি তো ঘরের মানুষ নন, তাঁর তো শুধু ‘ঘরের দিকে যাওয়া’। পথপ্রেমিক কবি সেই পথের যাত্রী, ‘যাত্রী আমি ওরে/ কোন দিনান্তে পৌঁছাব কোন ঘরে।’
সব ঠাঁই তাঁর ঘর আছে। ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়। এসব কি উৎকৃষ্ট কবি কল্পনার ফসল ? মনে হতে পারে সে কথা। রবীন্দ্রজীবনের অন্তরঙ্গ পাঠক একবার ভাবুন তো, কবির কোন সুনির্দিষ্ট গৃহকোণ ছিল কি ! যেমন আমাদের মতো সংসারী মানুষদের আছে ! ‘ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসার’ কথা লিখেছিলেন কোন এক কবিতায় ল কিন্তু ‘এতটুকু বাসা’ তাঁর ছিল না। অন্তরে তিনি আরব বেদুইনের আত্মজ, যার চরণতলে বিশাল বিশ্ব দিগন্তে বিলীন। জোড়াসাঁকো ধেকে শান্তিনিকেতন, শান্তিনিকেতন থেকে শিলাইদহ, শিলাইদহ থেকে বর্হিভারত, সেখান থেকে ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশ... ‘শুধু ধাও শুধু ধাও শুধু বেগে ধাও উদ্দাম উদাহ’। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই তাঁর ঘর, পেয়েছেন বন্ধু , আর ‘ যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।’
অবিরাম চলার পথে বাধা কি ছিল না ? ছিল তো। মায়াবন্ধন সেই বাধা। সেই মায়ার বন্ধন অদৃশ্য কিন্তু বড় কঠিন। সে তো কেবলই বলে ‘যেতে নাহি দিব।’ বলে, ‘আমি ভালোবাসি যারে সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ?’ তবু তো যেতে দিতে হয়। জগতের নিয়ম যে ! এ সত্য আমরা জানি সবাই, তবু মানতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ বলেন ও মানেন, ‘ ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’ মৃত্যু ও শোকতাপে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া দেখলে সেটা বোঝা যাবে। ব্যক্তিগত দুঃখকে সচল বিশ্বজগতের পটভূমিকায় স্থাপন করে তিনি যেন তৃতীয় ব্যক্তি হবে তাকে দর্শন করেন। শমীন্দ্র ছিল খুব প্রিয়। মৃত্যু হল তার। কিন্তু পৃধিবী্তো থেমে থাকল না, অকৃপণ হল নাতো জ্যোৎস্নালোক। মৃণালিনীর চিরবিদায় নেওয়ার পরে বিষাদছায়াবিস্তারি মেঘমালা তো আবৃত করল না পৃথিবীকে।
বিজ্ঞানের সত্য পদার্থ অবিনশ্বর। রবীন্দ্রেরও উপলব্ধি যে যায় সে তো হারিয়ে যাব না চিরতরে। নয়ন সম্মুখে থাকে না কিন্তু ‘ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। যেখানেই যাই না কেন ‘সেথা অসীম বাঁধনে অন্ত্যবিহীন আপনা’। কিন্তু এইরকম উপলব্ধিতে আমাদের মতো লৌকিক মানুষ তো সান্ত্বনা পায় না। দুঃখের অভিঘাতে কিছু বিকার দেখা দেবেই। আমরা কাঁদব, চিৎকার করব, হাহুতাশ করব। ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। অথচ মৃত্যুবিলাসী কবি তিনি নন। আসলে এটা তাঁর জীবনদর্শন। সেই যে নটরাজ। যার পায়ের তালে তালে ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু’। তাতা থই থই তাতা থই থই। শোক রবীন্দ্রনাথকে স্তব্ধ করে দিতে পারে নি। দুঃখ মৃত্যু শোকের মধ্য দিয়ে চলেছেন তিনি।
এই চলিষ্ণুতার ধর্ম সংক্রমিত হয়েছিল তাঁর জীবনে। তাই বারবার জীবনের পুরাতন ছক ভেঙে নতুন ছকে প্রবেশ করেছেন। অনেকটা যেন ‘চতুরঙ্গের’ শচীশের মতো। নির্দয় তিনি পুরাতনের প্রতি। ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’।পুড়িয়ে ফেলতে হবে জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা। ‘হে নতুন এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি’। সবুজ সংসদের এই গুরুটির মনের তারুণ্য অবিচল ছিল আজন্ম। তাই আধুনিক মনকে ছুঁতে পরেছিলেন তিনি অনায়াসে। কল্লোলযুগের সদ্যোথ্থিত তরঙ্গেরা তাঁকে অভিযুক্ত করেছিল তাঁর অনাধুনিক
মনোভাবের জন্য। ‘শেষের কবিতা’ বেরুবার পরে তাঁরা চমকিত হন। ‘শেষের কবিতা’ তো শুধু ভঙ্গির চমক, এটি তথাকথিত রবীন্দ্রবিদ্রোহীদের প্রতি পরিহাসরসিক রবীন্দ্রের অনায়াসসিদ্ধ ভঙ্গিমার এক উপহার মাত্র। রবীন্দ্রমানসের প্রবল গতিশীলতার দিকটি অনুধাবন করার চেষ্টা করলে অনাধুনিকতার দায়ে তাঁকে আসামিরূপে খাড়া করতেন না।
জীবনের ছক ভাঙার যে কথা বলেছি তার বড় প্রমাণ রবীন্দ্রের বহুমুখী কর্মসাধনা। সৃষ্টির আবেগ স্রষ্টাকে চঞ্চল করে। কিছুতেই যেন তৃপ্তি হয় না। ‘ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই’। নিজেই তাই নিজের রচনাকে কাটেন ছেঁড়েন, ধিক্কার দেন নিজের দীনতাকে, অতৃপ্তির বিষাদে দগ্ধ হতে থাকেন। স্রষ্টা যত বড় হন, অতৃপ্তি তত বেশি হয়। স্বর্গীয় অতৃপ্তি একেই বলে। সেইরকম অতৃপ্তিতে আমৃত্যু ভুগেছেন রবীন্দ্রনাথ, বিচিত্র উপায়ে আত্মপ্রকাশের মুক্তির সন্ধান করে ফিরেছেন। বলেছেন, ‘কবিতা আমার আজন্ম প্রেয়সী। কিন্তু সীমাবদ্ধ ও তৃপ্ত থাকতে কি পরেছেন কাব্যের সীমায় ? কথাসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ, সঙ্গীত—কত বিচিত্র শিল্পরূপের আশ্রয় নিতে হয়েছে তাঁকে। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন চিত্রচর্চার। আবার শিল্পকলার বৈচিত্র্য ও অজস্রতায় এই চির-অভাবী মানুষটির ক্ষুধা মেটেনি।জমিদারি তত্ত্বাবধানে, আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপনে, স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণে, নতুন শিক্ষা পরিকল্পনায়, পল্লি পুর্নগঠনে স্রষ্টার অতৃপ্তি আত্মমুক্তির পথ খুঁজে ফিরেছে।
কোন কাজই তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি। কোন প্রতিভাই তা পারে না। সব কাজই ‘শেষ হয়ে না হইল শেষ’। তাই অন্তরে চির অতৃপ্তি আবার অসমাপ্ত কর্মের জন্য অন্তরে নেই ক্ষোভ। যে সাধনা তাঁর জীবনে শেষ হল না-‘ জানি হে জানি তাও হয় নি হারা’। মানব জীবনকে যাঁরা মানবজীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন তাঁদেরই হারিয়ে যাবার ভয়।
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct