ডা. পার্থসারথি মল্লিক
এম.ডি (কন্)
প্রাণধারণের জন্য অক্সিজেনের পরেই জলের প্রয়োজন। খাদ্য না খেলে বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকা যায়, কিন্ত কয়েকদিন জল খেতে না পারলে মৃত্যু অবধারিত। জলাভাবে দেহের ওজন ১০-২০ শতাংশ কমে গেলে প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মানুষের দেহের ওজনের প্রায় ২/ ৩ অংশই জল। বয়স্ক ব্যক্তির তুলনায় শিশুদের দেহে এবং প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের দেহে জলের পরিমাণ বেশি। একজন আাথলিটের দেহে জলের পরিমাণ বেশি। জল কলাকোষ গঠনের জন্য অপরিহার্য উপাদান। জল দেহের অন্তদেশীয় তরল পরিবেশের সাম্যাবস্থা বজায় রাখে এবং এই সাম্যাবস্থার ওপর প্রাণিকোষের সজীবতা ও সক্রিয়তা নির্ভর করে। দেহকোষের ভেতরে ও বাইরে এবং বিভিন্ন দেহকলায় জলের বন্টন ও পরিমাণ প্রধানত ওইসব স্থানের জলে দ্রবীভূত নানা বস্তুর অভিস্রবণ চাপের ওপর নির্ভর করে। জল একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বক এবং এই প্রবীকরণ ক্ষমতা অন্তঃকোষীয় ও বহিঃকোধষীয় রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়াগুলি সম্পাদনে সহায়তা করে।পোষ্টিকতন্ত্র থেকে ক্ষরিত বিভিন্ন পরিপাককারী রসের জলীয় অংশ খাদ্যকে নরম ও তরল করে পরিপাকের উপযোগী করে এবং আর্দ্রবিশ্লেষণের সহায়তায় খাদ্যবস্তকে পরিপাক ও বিপাকে সাহায্য করে। জলীয় মাধ্যমের সাহায্যে প্রাণিদেহের কোষগুলি প্রয়োজনীয় পুষ্টি লাভ করে এবং দূষিত বজপিদার্থ জলের মাধ্যমে রেচন অঙ্গে পৌছায়। জল আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে ঘর্ষণ ও শুষ্কতা প্রতিরোধ করে। ফলে, বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। এছাড়া জল আমাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ত্বক ও ফুসফুসের মাধ্যমে জলের বাম্পীভবন দেহ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
জলের মাধ্যমে আমরা শরীরের জন্য তরকারি কিছু খনিজ লবণ যেমন ফ্লোরাইড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, তামা ইত্যাদি পেয়ে থাকি। আবার কিছু বিষাক্ত দ্রব্য যেমন সিসা, ক্যাডবিয়াম, আর্সেনিক, পেস্টিসাইড জলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে শারীরিক নানা ক্ষতি করে। সেজন্য এই সব বিষাক্ত পদার্থ মুক্ত পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা জনস্বাস্থ্য বিভাগের অবশ্য কর্তব্য। বিভিন্ন উপাদান সংবলিত দেহমধ্যস্থ জলীয় তরলকে দেহতরল বলা হয়। দেহের মধ্যে দুটি প্রধান স্থানে একটি বিস্তৃত থাকে - ৫১) কোষের মধ্যে এবং (২) কোষের বহির্দেশে যার মধ্যে কোষ ডুবে থাকে)। কোষবিল্লির দ্বারা পৃথকীকৃত, কোষমধ্যস্থ তরল অঙ্ককোষীয় তরল এবং কোষ বহির্ভূত তরল বহিঃকোষীয় তরল নামে পরিচিত। বহিঃ্কোষীয় তরল, প্লাজমা, কলারস, লসিকা, কোষাস্তরীয় জল, তরুনাস্থি ও ঘনসংযোগ রক্ষাকারী কলা নিহিত জল এবং অলভ্য অস্থি নিহিত জলের সমন্বয়ে গঠিত। দেহের বিভিন্ন রসে দ্রবীভূত সোডিয়াম, পটাশিয়াম ক্লোরাইড প্রভৃতি অজৈব আয়ন এবং প্রোটিন ও অন্যান্য জৈব যৌগের অভিস্রবণ চাপ দেহের কোষ বহির্ভূত এবং কোষাভ্যন্তরীণ রসে জলের সঠিক বন্টন বজায় রাখে। শরীরে ফলে কোষের ভিতর থেকে জল বাইরে চলে আসায় কোষগুলি জলহীন বা শুষ্ক (ডিহাইড্রেটেড) হয়। উদরাময়, অত্যধিক বমি ও ঘাম, গ্রীষ্মকালে উপযুক্ত জল পান না করা, উচ্চ তাপসম্পন্ন কারখানার চুল্লিতে কাজ করা জলহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে রক্তসংবহনের ব্যাঘাত ঘটে। রক্তচাপও কমে যায়, পেশিকোষের দুর্বলতা দেখা যায়। খাবার ইচ্ছ কমে যাওয়া, অবসাদপ্রস্থৃতা বৃদ্ধি পায়। ব জীবনযাত্রার পদ্ধতির ওপর। সাধারণত এরপরিমাণ হয় ৫০ ৮০ মিলিলিটার/ কেজি দৈহিক ওজনের ওপর। ব্যায়াম, উচ্চতাপ, কম আর্দ্রতা, সমুদ্রতলের ওপর উচ্চতা, উচিত এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য শরীরে জলের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। কোনও কারণে অতিরিক্ত জল দেহমধ্যে হয়ে যায় এবং কোষের মধ্যে বেশি জল ঢুকে পড়ে। এর ফলে জলাধিক্যের উপসর্গ দেখা যায়। তার কারণ কোষগত তড়িৎ-বিশ্লেষের তীব্রতার হাস এবং বিপাক জিয়ার বিপর্যয়।
উপসর্গগুলির মধ্যে আছে দেহতাপ কমে যাওয়া, কোষের মধ্যে জল জমা, পেশির খিঁচুনি, রোগীর চালচলনে অস্বাভাবিকতা, হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা, চেতনা লোপ ইত্যাদি দেখা যা প্রতিদিন আমাদের মোট জলীয় পদার্থ গ্রহণ বা বর্জন একই প্রকার নাও হতে পারে, তবুও স্বাভাবিক অবস্থায় দেহে নানা সুত্র থেকে আহুত জন এবং দেহ থেকে নির্গত জলের পরিমাণ সমান হলে অর্থাৎ দেহে জলের পরিমাণ সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকলে সেই অবস্থাকে জলসাম্য বলে। বিভিন্ন অবস্থায় দেহের জলসাম্য ধনাত্মক বা খণাত্মক হয়। যে সব অবস্থায় মানুষ ধনাত্মক জলসাম্যে অবস্থান করে তার মধ্যে প্রধান হল শৈশবের ক্রমবৃদ্ধি, গর্ভাবস্থা এবং রোগমুক্তির পরবর্তী অবস্থা। আবার, যেসব অবস্থায় মানুষ ঋণাত্মক জলসাম্যে অবস্থান করে তার মধ্যে প্রধান দেহ থেকে রক্তপাত, অগ্নিদগ্ধ হওয়া, অস্ত্রোপচারের মধুমেহ, বহুমূত্র এবং আযাডিসোন রোগ প্রভৃতি। মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে যেমন জল গ্রহণ করে তেমনি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ থেকেজলের রেচন ঘটায়। মানুষের জল গ্রহণের উৎস হল (১) পানীয়, যেমন জল, দুধ, চা, কফি, শরবত, ফলের রস ও অন্যান্য পানীয়। (২) কঠিন খাদ্যের মাধ্যমে গৃহীত জল যেমন ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, তরিতরকারি ইত্যাদি। (৩) বিপাকজাত জল এভাবে প্রতিদিন যে জল গ্রহণ করা হয় তার পরিমাণ গড়ে ২৫০০ মিলিলিটার। মল, মূত্র, ধর্ম এবং শ্বাসপ্রশ্বাস ও ত্বক থেকে জলীয় বাম্পের আকারে শরীর থেকে ২৫০০ মিলিলিটার জল রেচিত হয়। তৃষ্ণাপ্রক্রিয়া, তড়িৎ বিশ্পেষ্য, বুক, হাই পোথ্যালামাস, অক্ষরাণাস্থি খাদ্যগ্রহণ, উষ্ণতা, আর্দ্রতা, শ্বাসকার্য প্রভৃতি জলসাম্য নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করে।গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে সুস্থ থাকার জন্য যখনই খান পরিশ্রুত সাদা জল (সম্ভব হলে এতে দিন এক চিমটি নূন ও এক চামচ চিনি), গরম চা, তরমুজের সরবত, ফলের রস, সুপ, ডালের জল, ঝালমশলা কম দেওয়া সবজি ও মাছের ঝোল। শশাও আমাদের জলের পিপাসা মেটাতে সাহায্য করে। মনে রাখবেন রাস্তার বরফ দেওয়া রঙিন জলের সরবত, লেবুর জল একেবারেই খাওয়া চলবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct