ভারতের ইতিহাসে সুদীর্ঘ এই ছ’-শো (৬০০) বছর মূলত দুটো শাসকগোষ্ঠীর প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তুর্ক-আফগান ও মুঘল জমানা। এই দুই জমানার সময়কাল ছিল যথাক্রমে ১২০৬ খ্রিঃ থেকে ১৫২৬ খ্রিঃ, আর ১৫২৬-১৭৬০/১৮৫৭ খ্রিঃ পর্যন্ত। তুর্ক-আফগান শাসনকালে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক যে ক্রমবিকাশ তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সুদূরপ্রসারী। হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর সর্বতো এবং কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী ইসলামের মধ্যে একটি সমন্বয়ী মানসিকতার উন্মেষ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। ‘হিন্দুস্তান’-কে একসূত্রে গ্রথিত, ভৌগলিক দিক দিয়ে সংহতিস্থাপনের কৃতিত্ব বাদশাহ আওরঙ্গজীবেরই প্রাপ্য। তবুও হিন্দুস্তানি মুসলিম শাসনকে আজও অনেকে বিদেশী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেই ইতিহাসের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করেছেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
হিন্দুস্তান’-এ ইসলামাশ্রয়ী হুকুমত প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে
এতদ্দেশীয় পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে কবি হালি লিখেছেন:
‘ইধর হিন্দ মে হর তরফ অন্ধেরা কি থা গিয়ান গুণ কা লড়াইয়োসে ডরা।’ এই উদ্ধৃতিটি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালি জাতির ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এমনতরো একটি সময়ে মোহাম্মদ বিন কাশিম নামীয় আরবীয় এক তরতাজা তরুণ সৈনিক সিন্ধুপ্রদেশ দখল করে নেন। তিনশ বছর পরে এলেন সুলতান মাহমুদ। বড় তাজ্জবের কথা পাঞ্জাব দখল করে ভারতীয় হিন্দু-তিলক নামীয় একজন বিচক্ষণ সৈনিককেই সেনাবাহিনীর কর্তা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। আসলে এই লড়াই ধর্মীয় লড়াই নয়। এ হচ্ছে রাজনৈতিক অধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। তিলকের নিয়োগও রাজনৈতিক। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরে পৃথ্বীরাজ; শিহাবউদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরির কাছে পরাজিত হলেন। সেই থেকে মূলতঃ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ এবং বাহ্যত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর মসনদ মুসলমানদের অধীনে চলে গেল।
তুর্ক-আফগান ও মুঘল
ভারতের ইতিহাসে সুদীর্ঘ এই ছ’-শো (৬০০) বছর মূলত দুটো শাসকগোষ্ঠীর প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক. তুর্ক-আফগান, খ. মুঘল জমানা। এই দুই জমানার সময়কাল ছিল যথাক্রমে ১২০৬ খ্রিঃ থেকে ১৫২৬ খ্রিঃ, আর ১৫২৬-১৭৬০/১৮৫৭ খ্রিঃ পর্যন্ত। তুর্ক-আফগান শাসনকালে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক যে ক্রমবিকাশ তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সুদূরপ্রসারী। এই সময়কালে বহিরাগত শাসকশ্রেণি স্বদেশী ভাবাশ্রয়ীতে নিজেদের রূপান্তরিত করেছেন। হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর সর্বতো এবং কঠোর ভাবে একেশ্বরবাদী ইসলামের মধ্যে একটি সমন্বয়ী মানসিকতার উন্মেষ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষসিংহ জহিরউদদিন মুহম্মদ বাবর পরবাসকে নিজবাসভূমে পরিণত করেছিলেন। মহামতি আকবর সহিষ্ণুতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন। ‘হিন্দুস্তান’-কে একসূত্রে গ্রথিত, ভৌগলিক দিক দিয়ে সংহতিস্থাপনের কৃতিত্ব বাদশাহ আওরঙ্গজীবেরই প্রাপ্য। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ভারতপ্রেম ‘মীথে’-র পর্যায়ে পড়ে। তবুও হিন্দুস্তানি মুসলিম শাসনকে আজও অনেকে বিদেশী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটা ক্ষোভের কথা। বেদনার-ও। জওহরলাল নেহরু তাঁর বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘The Discovery of India’-তে এই জাতীয় মূঢ়তার সমালোচনা করেছেন।
বিকৃত ইতিহাস চর্চা
ভারতীয় ইতিহাসের এই ভুল বোঝাবুঝি বহুকালের। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ইসলামধর্মী শাসকশ্রেণির চেয়ে ইংরেজ শাসন উৎকৃষ্ট-- এমন একটা ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার বদ-মতলবে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। খোদ ভারতীয় ইতিহাসের তথাকথিত বিশেষজ্ঞরাও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মানসিকতার দ্বারা প্রভাবিত এবং লালিত। দীর্ঘকাল থেকেই হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণির মধ্যে দীর্ঘকালীন শত্রুতা সৃষ্টি এবং দাক্ষিণাত্যের চেয়ে আর্যাবর্তের প্রাধান্য কীর্তনের জন্য কত না কিসসা পয়দা করেছে, তার হদ্দ-মুদ্দ নেই। উদাহরণ হাতের কাছেই রয়েছে। গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসের ‘সুবর্ণ যুগ’-হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অথচ ঘটনা হল দাক্ষিণাত্যে ‘স্বর্ণযুগ’- শুরু হয়েছিল বহু পরে। চোল, চালুক্য, পল্লভ, রাষ্ট্রকূটদের শাসনের সময়। শুধু আর্যাবর্তই পুরো ভারতবর্ষ নয়। গৌরবীকরণের কারসাজি বহুভাবে হয়েছে। একটি সুদূঢ় জাতি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত হল-- নিরপেক্ষ ইতিহাস ভাবনা-চর্চা। ভারতের মত বহুজাতিক দেশে একথা আরও যুক্তিযুক্ত এবং জরুরী। স্বার্থান্ধমহলে এই বিচারভিত্তিক চর্চা আর পরিবর্তনের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্রী এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা উঠে পড়ে লেগেছে যাতে মুঘল আমলের ইতিহাসকে পাঠ্যসূচী থেকে লুপ্ত করে দেওয়া যায়। আমরা বিশ্বাস করি, ইতিহাসের ‘টেকস্ট বুকে’ প্রগতিশীল পরিবর্তন সম্ভব হলে জাতির ভবিষ্যৎ বংশধররা একটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ তৈরী করতে পারবেন। ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কমবে নিশ্চিতভাবে।
মিথ্যে ইতিবৃত্তের ধাক্কা ও আওরঙ্গজীব
মিথ্যে ইতিবৃত্তের ধাক্কাটা মূলত সম্রাট আওরঙ্গজীবের ওপর পড়েছে। অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু শাসকদের অতি সৎ এবং অতি বিবেকী হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই মানসিকতাকে প্রগতিশীল ঐতিহাসিকরা ‘Over Glorification’ আখ্যায়িত করেছেন। আওরঙ্গজীবকে হিন্দু নির্যাতনকারী হিসেবে হরবখত চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু বিদ্যার্থীবর্গ শৈশবকাল থেকেই ভাবতে শুরু করে মুসলমান শাসকরা নির্দয়-নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী বিদেশী। ভারতীয় জীবনের সঙ্গে তাঁদের কোন যোগসূত্র নেই। হিন্দু নৃপতির সঙ্গে মুসলমান শাসকদের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক লড়াই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঝোঁক সবিশেষ বর্তমান। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে জীবনের বহুক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে-- সেকথা কস্মিনকালেও উচ্চারিত হয় না। মোদ্দা কথা হল-- মুসলমান শাসনামলে যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিরন্তর বা লাগাতার চলত তা মূলতঃ সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় নয়, এটি রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই যুদ্ধ বিগ্রহের প্রকৃতি ধর্মীয় আর সাম্প্রদায়িক হলে আওরঙ্গজীবের সমর বিভাগে অজস্র হিন্দু সৈনিকের নিয়োগ হত না। উপরন্তু আওরঙ্গজীব অভিজাত বহু হিন্দু পরিবারের কৃতী সন্তানকে সেনা বিভাগের উচ্চপদেও নিয়োগ করেছিলেন। এঁদের বিশ্বাস সহকারে বাদশাহ আওরঙ্গজেব অশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। শিবাজীর ব্যক্তিত্বকে অতি গৌরবান্বিত করার প্রয়োজনে আওরঙ্গজীবকে হীন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস লক্ষিত হয়। শিবাজিও তাঁর লড়াইকে মারাঠা প্রাধান্য বিস্তারের জন্যই নিয়োজিত করেছিলেন। আওরঙ্গজীবকে ইসলামের সেবক হিসেবে না ধরে হিন্দুস্তানি মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবেই ধরা হচ্ছে এবং শিবাজীকে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিরোধের নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং একটি সনাতনী সন্তোষবোধ করছেন সাম্প্রদায়িকতাবাদে আচ্ছন্ন ঐতিহাসিকবর্গ। শিক্ষকরাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের মনকে বিষিয়ে দিচ্ছেন। এই মতটি আরও বহু ঐতিহাসিকবর্গের সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক এস. হাশিম কিদোয়াই। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ফায়দা লুটবেন এককে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে।
আওরঙ্গজীবের প্রতি অভিযোগ: জওয়াব
গত শতকের মধ্যবর্তীকাল থেকে প্রগতিশীল গবেষকরা প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য একটা আন্দোলন শুরু করেছেন-- বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজীবের প্রতি গূরুতর অভিযোগ, তিনি মন্দির ধ্বংসকারী অথচ আধুনিক ইতিহাস অনুসন্ধানীদের নজরে পড়েছে আওরঙ্গজীবের গয়া এবং বারাণসীতে সুবৃহৎ মন্দির নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থ দান হিসেবে বরাদ্দ করেছিলেন। শাহজাহানের শাসনকালের চেয়ে আওরঙ্গজীবের দরবারে বেশি হিন্দু মনসবদার সম্মানের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন। আওরঙ্গজীবকে ‘সিনিক’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এটি সর্বৈব মিথ্যে একটি ধারণা। তিনি সঙ্গীতের সুক্ষাতি-সূক্ষ্ম ধারার একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। এমনকি বীণাও তিনি বাজাতে পারতেন। তবে শাসন ছেড়ে ব্যক্তিগত আমোদ-প্রমোদকে প্রাধান্য দিতেন না। একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সুশাসকের পক্ষে এটিই স্বাভাবিক। ভারতকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ রূপান্তরিত করার অভিযোগ ওঠে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় উন্মাদনার কথা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু ইতিহাস বলে; আওরঙ্গজীব হিন্দুদের ব্যাপক ধর্মান্তরিত করার বিষয়ে কোন ভূমিকায় গ্রহণ করেননি। তিনি বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করলে দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাধিক্য দৃষ্ট হত। কার্যত তা হয়নি। অথচ সাম্রাজ্যের শেষ পূর্বপ্রান্তে বঙ্গভূমিতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আজও বাস্তব সত্য। আদতে বহুবর্ণ আর শ্রেণিভিত্তিক হিন্দু সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উপরন্তু তিনি ব্যাপক মন্দির-ও ধ্বংস করেননি। কেননা আওরঙ্গজীব বিশ্বাস করতেন-- ‘লা একরাহা ফিদ্দিন’-- এই তত্ত্বে। অর্থাৎ ধর্মে বলপ্রয়োগের স্থান নেই। তাঁকে ‘Champion of Islam’ বলা হয়ে থাকে। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা পোষণ না করে যে কোনও ধর্মপ্রিয় মানুষই তাঁর স্বীয় ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে পারেন— এটি কি গর্হিত কাজ? আওরঙ্গজীব মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগলিক বিস্তার ভারতবর্ষের সমগ্র প্রত্যন্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাবুল থেকে চট্টগ্রাম, কাশ্মীর থেকে কাবেরি পর্যন্ত মুঘল প্রাধান্য সু-প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অংশ মুঘল সাম্রাজ্যকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের উৎসভূমি ছিল লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত মন্দির। এর মধ্যে অব্যবহৃত মন্দিরগুলোকে নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্র মত্তজুদ করার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। কিছু কিছু মন্দির থেকে প্রতিরোধের যে দুর্গ গড়া হয়েছিল, নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাকে ভেঙে ফেলার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ছিলই।মন্দির সংক্রান্ত বিষয়ে আওরঙ্গজীব, রাজা জয়সিংহ এবং রাজা যশোবন্ত সিং-এর পরামর্শ মতই কাজ করতেন। শিবাজী-ও এমন পরিস্থিতিতে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ‘Shivaji Plundered and raided Hindus too’. uএরপর নয়ের পাতায় এখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অযৌক্তিক নয় যে হরকাজের পেছনেই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ধর্মীয় উন্মাদনা এর মূলগত কারণ নয়। যদি তাই হোত তাহলে আওরঙ্গজীব হিন্দু মন্দির নির্মাণ এবং সংস্কারের জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ করতেন না।
আওরঙ্গজীব ও জিজিয়ার প্রাসঙ্গিক বিবেচনা
জিজিয়া প্রসঙ্গে অসহিষ্ণু ঐতিহাসিকবর্গ বিচলিত হয়ে পড়েন। জিজিয়া সামরিক কর। তূর্ক-আফগান এবং মুঘল শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই কর প্রচলিত ছিলই। ব্যতিক্রম হিসেবে আকবর, কাশ্মীরের জৈনুল আবেদিন এবং গৌড়ের হুসেন শাহের নাম উল্লেখযোগ্য। বস্তুত জিজিয়া প্রসঙ্গ আওরঙ্গজীবের ক্ষেত্রেই অতিকথিত এবং সমালোচিত। প্রথম কথা তিনি জিজিয়ার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত তাঁর ধর্মীয় এবং ব্যক্তিজীবন ছিল পুরোপুরি ইসলামাশ্রয়ী। শেষোক্ত কারণেই একদেশদর্শী ইতিহাসকারদের গাত্রদাহের উদ্রেক করে। অথচ শিবাজি বলপূর্বক ‘সরদেশমুখী’ এবং ‘চৌথ’ আদায় করতেন, সে প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে যান। পরবর্তী মারাঠা শাসনে উপরোক্ত কর আদায়ের সময় অনাদায়ী প্রজাবর্গের উদরে তপ্ত বল্লম পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো বর্বর ঘটনা ঘটেছে।অযথা এবং অকারণে আওরঙ্গজীব হিন্দু প্রজাদের উপর ‘জিজিয়া’ চাপিয়ে দেননি। জিজিয়া ছিল সামরিক কর। হিন্দু প্রজারা মুঘল সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন না। তাঁরা নিশ্চিত জীবন যাপন বেশি পছন্দ করতেন। রাষ্ট্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে অথচ প্রজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন না, এটি সুপ্রজার লক্ষণ নয়। যুদ্ধে অংশ না নেবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে জিজিয়া আদায় করা হত। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে সমস্ত হিন্দু প্রজা মুঘল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতেন তাঁদের জিজিয়া কর দিতে হত না। সুতরাং ‘জিজিয়া’ বাধ্যতামূলক ছিল-- একথা স্বীকার্য নয়।
মুসলমান প্রজারা সোৎসাহে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, উপরন্তু ‘খারাজ’, ‘খামস’, সর্বোপরি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কর ‘জাকাত’ হিসেবে কর দিতে হত। এই তিনটি করের পরিমাণ জিজিয়ার থেকে অনেক বেশি ছিল। খুব সঙ্গত কারণেই মুসলমানদের ওপর যুদ্ধ কর বাবদ ‘জিজিয়া’র বোঝা চাপাননি। উপরন্তু হিন্দু-মুসলমান সমস্ত শ্রেণির প্রজার ওপর থেকেই বহুবিধ কর রদ করেছিলেন। ‘He remitted many Voxatious ceases and taxes’. (Source: ‘Three Doctors, An Advanced History of India’, Page-491.) শেরশাহ সুরি তাঁর অতি বিচক্ষণ অর্থমন্ত্রী টোডরমলকে দিয়ে সুসংহত রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, মুঘল সম্রাট আকবর সেই ব্যবস্থাকে আরও ফলপ্রদ করে তুলেছিলেন। টোডরমল পরে দক্ষতার সঙ্গে আকবরের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই রাজস্ব ব্যবস্থাই মূলতঃ আওরঙ্গজীবও অনুসরণ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর অর্থমন্ত্রী শ্রী রসিকলাল ক্রোড়ি কিছু পরিবর্তন করেন। কিছু নুতন বিধির সংযোজনের কৃতিত্বও রসিকলাল ক্রোড়ির। উল্লেখ করার মত ব্যাপার শেরশাহ, আকবর এবং আওরঙ্গজীবের অর্থমন্ত্রী জন্মসূত্রে এবং ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু ছিলেন। রাজস্ব আদায়ে প্রজাদের ওপর অত্যাচারের বন্যা বইলে শ্রী রসিকলাল ক্রোড়ি নিশ্চিতভাবেই পদত্যাগ করতেন, কিন্তু প্রমাণিত ইতিহাস সেকথা বলে না। শ্রী ক্রোড়ি সুদক্ষ আর ন্যায়বান প্রশাসক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।
আওরঙ্গজীবকে হেয় প্রতিপন্ন করবার জন্য অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন অথচ তাঁর ব্যক্তি ও শাসক জীবনের দিকগুলো অনালোচিত থেকে যায়। সরল অনাড়ম্বর জীবন। রাজকোষের অর্থের সঠিক ব্যয় (তিনি বিশ্বাস করতেন—’The Royal treasury belongs to the public’) শান-শওকতের সঙ্গে তাঁর জন্মদিন পালন এবং ব্যয়সাধ্য ‘নওরোজ’-উৎসব স্থগিত করেছিলেন। মানুষের প্রতি অগাধ গুরুত্ব আরোপ করে তিনি কল্যাণধর্মী সংস্কারেও হাত দিয়েছিলেন। সতীদাহ প্রথা রদের সঙ্গে লর্ড বেন্টিঙ্ক এবং রামমোহনের নাম সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে, অথচ একথা ক’জন জানেন যে, আওরঙ্গজীব সর্বপ্রথম হিন্দু বিধবা রমনীদের জন্য ব্যথিত হয়েছিলেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আওরঙ্গজীব সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘It is mentioned in the official guide book’s of Aurangzeb’s reign that he forbade sati.’ (December 1663)’. এইসব দৃষ্টান্ত সামনে রেখে আমাদের অন্ধ ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেঃ একজন সম্রাট যিনি সারা জীবন মন্দির ধ্বংস করলেন এবং বিদ্বেশবশতঃ জিজিয়া আদায় করলেন তিনি প্রায় সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর টিকে থাকলেন কি করে? এত দীর্ঘদিন সম্ভবতঃ পৃথিবীতে মধ্যযুগে আর কেউ হুকুমতি ‘তখতে’ ছিলেন না! মুঘল ঐতিহাসিকদের আওরঙ্গজেব সম্পর্কিত মূল্যায়ণে অনেকেই প্রশস্তির প্রশ্ন তোলেন। এই তর্কে না গিয়েও বলা যায় ইতালির আইনবেত্তা এবং চিকিৎসক Dr. Gemelli Careri আওরঙ্গজীবের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির এই পণ্ডিত স্বয়ং বাদশাহ-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনায় অংশ নেন। মহান সম্রাট আওরঙ্গজীবের বয়স তখন ৭৭ বছর। খুব সংক্ষেপে তাঁর জীবনকে এইভাবে প্রকাশ করা যায়: ‘His private life was marked by a high standard of morality.’ ‘রাফিজ কুশ’-তরবারির অধিকর্তা আওরঙ্গজীব তাঁর পুরো জীবন সমর্পণ করেছিলেন আল্লাহ’-র উদ্দেশ্যে। আপ্লুত হতে হয় -এমন একটি কবিতার খণ্ডাংশ দিয়ে আওরঙ্গজীবের জীবনদর্শকে বোঝানোর কোশেশ করা গেল:
‘আল্লাহ্!
কেউ না থাক
এ গোলাম
হাজির থাকাবে,
তোমার জন্য।’
... ... ...
জীবনে মরণে
সারাক্ষণ
তোমার জন্য
হাজির হাজির!!
(আবদুল আজীজ আল্-আমান)
শেষ কথা
নয়া পরিমার্জিত ইতিহাস রচনার সময় মুক্ত বুদ্ধি ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের প্রত্যেকটি অধ্যায় বিশ্লেষিত হোক। এটিই বাঞ্ছনীয়। নচেৎ ‘তোমার আমার ভালবাসা/ মুসলমানের মুর্গি পোষা’—এই ঘৃণ্য বোধ বহু মানুষের মনে রাজত্ব করবে আরও বহুকাল।
দ্রষ্টব্য:
‘আওরঙ্গজীব’—ফার্সি উচ্চারণ এবং এটিই সঠিক। ভারতীয় উচ্চারণ ‘আওরঙ্গজেব’ ফার্সি উচ্চারণ বিধি অনুসারে সঠিক নয়। দেখুন, ড. ভিনসেন্ট স্মিথ, ‘The Oxford History of Indian’, Page- 429.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct