জলের অপর নাম জীবন। জলবিহীন একটি দিন কল্পনা করা আমাদের জন্য অসম্ভব। গত শতাব্দীতে, বিশ্বব্যাপী জলের চাহিদা মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলের অভাব ইতিমধ্যেই প্রতিটি মহাদেশে কৃষির জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটি আগামী শতকে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সত্য হল, যেই দেশগুলোতে পর্যাপ্ত জলের উৎস রয়েছে সেখানেও বিশুদ্ধ জলের অভাব রয়েছে। শুবরং এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন সোহরাব হোসেন।
জলের অপর নাম জীবন। জলবিহীন একটি দিন কল্পনা করা আমাদের জন্য অসম্ভব। গত শতাব্দীতে, বিশ্বব্যাপী জলের চাহিদা মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলের অভাব ইতিমধ্যেই প্রতিটি মহাদেশে কৃষির জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটি আগামী শতকে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সত্য হল, যেই দেশগুলোতে পর্যাপ্ত জলের উৎস রয়েছে সেখানেও বিশুদ্ধ জলের অভাব রয়েছে। শুধু মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন জল সংকটের জন্য দায়ী নয়, বরং এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। এভাবে সংকট ঘনীভূত হতে থাকলে এটা বলতেই হবে, মানবজাতির জন্য অশুভ সময় ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবীতে সব জলীয় উৎসের মাত্র ২.৫% মিঠা জল এবং তন্মধ্যে মাত্র ১% জলই কেবল মানুষের হাতের নাগালে। সুতরাং আমরা পৃথিবীর মাত্র ০.০০০৭ শতাংশ জল ব্যবহার করতে পারি এবং যেটি কিনা ৬.৮ মিলিয়ন মানুষের খাবার জলের উৎস। যখন জল সংকটের কারণে খরা দেখা যায়, এবং অজস্র মানুষ অনাহারে থাকে আর এর জন্য জীবনের অবসান ঘটে অনেকেরই। খরা-পীড়িত অঞ্চল এবং আফ্রিকা উপমহাদেশে নিরাপদ পানীয় জলের অভাব রয়েছে। সেখানকার মানুষ সাধারণত নিরাপদ জল খুঁজতে পাড়ি দেয় কয়েক কিলোমিটার পথ। বিশ্বে বিশুদ্ধ মিঠা জলের অভাবের জন্য বেশকিছু প্রভাবক দায়ী, আর সেই প্রভাবকগুলো খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর স্বাস্থ্য, এই সবকিছুকেই প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানীরা জলের সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়, এসবের ফলে বিশুদ্ধ জলের উৎস নষ্ট হয়ে সেখানে সংকট দেখা দেয়। উপরন্তু, অতিরিক্ত খরার কারণে সাব-সাহারার আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত জলের স্তর বৃদ্ধির ফলে, বিভিন্ন উৎসের জল পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট অনুসারে, লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জমির মোট পরিমাণ ১৯৭৩ সালে ছিল ৮৩.৩ মিলিয়ন হেক্টর, ২০০০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ মিলিয়ন হেক্টরে, আর বর্তমানে এর পরিমাণ ১০৫.৬ মিলিয়ন হেক্টর এবং এই পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ইউনিসেফের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৈশ্বিক জল সংকটের অন্যতম একটি কারণ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংগঠিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল জল সম্পর্কিত। প্রথমত, বন্যা এবং খরা বিশুদ্ধ জলের উৎসকে ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন জলবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
অন্যদিকে জল সম্পদের ব্যাপারে আমাদের যথাযথ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেই। অনেক জলপথ একাধিক দেশের সীমানাকে কেন্দ্র করে রয়েছে যেটাকে বলা হয় ডি ফ্যাক্টো শেয়ার্ড সম্পত্তি। হতাশাজনকভাবে, রাষ্ট্রসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর সর্বশেষ তথ্যানুসারে মাত্র ২৪টি দেশ তাদের সব আন্তর্জাতিক নদী, হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ জলের উৎসগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত রাখে। সুতরাং একটি দেশের পক্ষে একটি জলাভূমির কিছু অংশ পরিষ্কার রাখার জন্য সব কার্যক্রম অর্থহীন হতে পারে যদি এই জলাভূমিটির বিপরীত তীরের জলকে পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব না দেওয়া হয়। এছাড়া জলের অপচয়, যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বা শরণার্থী সংকটও জল সংকটের জন্য দায়ী। এমন অবস্থায় আমাদের বিশুদ্ধ জলের সংকটের সমাধানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রথমত, জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে, এককথায় আমাদের চলমান জীবনযাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষকে এই সংকট সম্পর্কে সচেতন করা এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া। এনজিও এবং সরকারকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে সর্বশ্রেণির মানুষ, তথা একটি পরিবার, গৃহিণী থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানার শ্রমিক পর্যন্ত সবাই এ বিষয়ে সচেতন হয়। দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে, পৃথিবীর কিছু অংশে ২০৩০ সাল নাগাদ জনসংখ্যার তুলনায় জল সম্পদের চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবধান ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হতে পারে। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অভাবী মানুষকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ জল সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া বর্ষাকালে কীভাবে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে হয় এবং পরে তা ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে জনগণকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী মিঠা জলের সমস্যা সমাধানে এবং বিশ্বজুড়ে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে, সরকার এবং এনজিওগুলোকে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাই সচেতন হতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct