বাগদাদ
কোথায় গেল সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস!
ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে বর্তমান আলোচনাটির উপস্থাপনা। ‘হাফ বেকড ’ তথাকথিত পণ্ডিতবর্গ ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলে আলটপকা মন্তব্য করে বসেন। ইসলাম ‘মিস আন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রুশেডের কাল থেকে এই বেতমিজ অপপ্রচার চলছে। সদ্যতন সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। চার্চ এবং যাজক সম্প্রদায়ের কুসংস্কার আর অমানবিক কার্যাদির কারণে বহু বৌদ্ধিক ব্যক্ত্বিকে তারা নির্মভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম তার ‘আহল-ই-কলম’ (বিদ্বৎসমাজ)-কে কস্মিনকালেও বিড়ম্বিত করেনি। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সহরত, শান-সওকত, সমৃদ্ধি-সৌন্দর্য আর ইসলামি সংহতির শহর বাগদাদ। অধ্যাপক হিট্টি বলছেন, আব্বাসীয় শাসনকালে শহরটি ‘Prodigious Wealth’ এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা আর গুরুত্বের স্মারক হয়ে উঠেছিল। বানজেটিয়াম; বাগদাদের অতুল্য বৈভবে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খাতিবের অনুভব হল এই রকম: ‘আ সিটি উইথ নো পিয়ার থ্রোআউট দ্য হোল ওয়ার্ল্ড।’ আদতে স্বপ্নের মহানগর বাগদাদ শিক্ষার শ্রেষ্ঠতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। আব্বাসীয় ঘরানার দ্বিতীয় খলিফা আবু জাফর আল্ মনসুর এক স্থাপক। আল্ মনসুরের স্থায়ী মোকাম ছিল আল-কুফা এবং আল হীরার মধ্যস্থলে আল্-হাশিমিয়ায়। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে আল্ মনসুর নতুন রাজধানী বাগদাদ-এর ভিত্তিস্থাপন করেন। বাগদাদ-এর অর্থ হচ্ছে ‘Given by God’— আল্লাহ প্রদত্ত। চার বছরের প্রখর পরিশ্রম ছিল এই নির্মাণের পিছনে। ৪,৮৮৩,০০০ দিরহাম খরচ হয়েছিল। সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া আর সাম্রাজ্যের ভিন্নতর অঞ্চল থেকেও হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রমের বদৌলতে সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামি ‘সিয়াসতি’— মর্যাদার শহর বাগদাদ / বোগদাদ। বাগদাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবু জাফর আল্ মনসুরকে মুগ্ধ করেছিল। শহরটির ভৌগলিক অবস্থান ছিল সাসানিদ অঞ্চলের একটি মনোরম জায়গায়। টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম প্রান্তের এক অপূর্ব সৌন্দর্য সমন্বিত অঞ্চল। পূর্ব প্রান্তে এক বিশাল সুদক্ষ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রাখা হত। ইসলামের এই বহু গৌরবান্বিত রাজধানীর নাম দিয়েছিলেন ‘দার-উল-ইসলাম’ (‘Adobe of Peace’)। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাগদাদে প্রবেশের জন্য চারটি তোরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাজদরবার আর বৃহৎ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হুকুমত এবং ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য। দর্শকের জন্য যে কক্ষ তৈরি হয়েছিল তার গম্বুজের উচ্চতা ছিল একশো তিরিশ ফুট।
মৃত্যুর পূর্বে খলিফা আল্ মনসুর, কাসার আল্ খালিদ (Palace of eternity) নামে আর একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। মনোরম উদ্যান তৈরি করে এই রাজপ্রাসাদের শোভা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এর কিছু উত্তরে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ আল মেহদির জন্য ‘আল্- রুসাফা’(রাফিকা) নামে তৃতীয় প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। কুফা এবং বসরায় সুদক্ষ সৈন্য নিয়োগ করে সুরক্ষা আর নিরাপত্তার বেষ্টনী তৈরি করেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাগদাদ আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠল। পার্থিব তুলনারহিত সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি আর বহুবিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার স্থল হয়ে উঠল। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল ইসলামি শাসনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। খলিফা হারুণ-অর-রশিদ এর রাজত্বকালে (৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ /১৭০-১৯৪ হিজরি) বাগদাদ উন্নতির চরম শীর্ষে আরোহণ করে। হারুণ-অর-রশিদ ‘তখত’-এ আরোহণের পর মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, বৃহৎ ইমারত, স্মৃতিস্তম্ভ, মিনার আর মসজিদ নির্মাণ করে নগরীর গুরুত্ব বৃদ্ধি করলেন। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে বাগদাদ, বাইজেন্টাইনের প্রতিদ্বন্দ্বী শহরে পরিণত হল। জাঁকজমকের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রাচুর্য বাগদাদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নততর করেছিল। খলিফা হারুণ-এর চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধ এবং তাঁর অব্যবহিত পরের উত্তরাধিকারীদের তৎপরতায় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গাণিতবিদ, রসায়নবিদ, তত্ত্ববিদ, ভাস্কর, গায়ক, কারুশিল্পী রাজধানীতে জমায়েত হতে থাকে। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতায় তুরন্তগতিতে এগিয়ে গেল বাগদাদ। এক গৌরবময় অধ্যায়ের পুঙ্খানুপঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন সমাজবেত্তা কবি আবু নওয়াজ। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একটি বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। জীবনের নিরপত্তার কোনও অভাব ছিল না, ফলত সকলেই উদ্বেগহীন জীবনযাপন করার সুযোগ পেয়েছিল। আল মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় চিকিৎসক, আইনবেত্তা, শিক্ষক ও লেখকসমাজ রাজদরবারে মর্যাদাপূর্ণ স্থান পেলেন। আল মামুন ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘বায়তুল হিকমা’ (House of wisdom / House of learning) নামে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদে গবেষণাগার, গ্রন্থাগার এবং অনুবাদ বিভাগ খোলা হয়েছিল। গ্রিক এবং ল্যাটিনগ্রন্থের আরবি ভাষায় অনুবাদ এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে অদৃষ্টপূর্ব সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করল। বাগদাদের অন্যতম শিক্ষা-গবেষণাকেন্দ্র হয়ে উঠল ‘বায়তুল হিকমা’। (সূত্র: হিট্টি, হিস্ট্রি অব দ্য অ্যারাবস’, পৃ. ৩৬৩-৪০৭, ৫৫৭-৫৯০)। আব্বাসীয় হুকুমতে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির যে বিকাশ দৃষ্ট হয় তা মূলত খলিফা হারুণ এবং আল্ মামুনের অবদান। ইসলামের ইতিহাসে এই জমানা উন্নত রুচি আর প্রগতির যে নজির স্থাপন করেছিল তা অনবদ্য এবং অনিন্দ্যসুন্দর। একজন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ মন্তব্য করেছেন, আরবীয় এবং হিসপানি-আরবীয় মুসলমানরা যদি অনুবাদের মাধ্যমে অ্যারিস্টটল, গ্যালেন এবং টলেমির গবেষণাকর্মগুলোকে সংরক্ষণ না করতেন তাহলে এই পণ্ডিতবর্গ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতেন। রাজধানী বাগদাদের স্থাপনার পর থেকে পুরো পাঁচশ বছর আব্বাসীয় শাসকবর্গ জ্ঞানগরিমার ক্ষেত্রে ‘রাজ’ করেছেন।
জ্ঞানচর্চার নানান শাখা-প্রশাখায় অগণন বিদ্বজ্জনের সমাবেশ বিস্ময়কর। এখানে বিষয়ানুসারে খুবই উঁচুমানের বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হল:
ঔষধ বিজ্ঞান: আলি আর তাবারি, আল্-রাজি, আলি ইবন আল্-আব্বাস, আল মাজুসি, সর্বোপরি ইবনে সিনা। আল্-রাজি এবং সিনা শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ইবন সিনার ‘কানুন’ কয়েক শতাব্দী ধরে ‘মেডিক্যাল বাইবেল’ রূপে প্রতিভাত হয়েছিল।
দর্শন: আল্-কিন্দি, আল্-ফারাবি, আল গাজ্জালি। আল্-ফারাবিকে দ্বিতীয় অ্যারিস্টটল বলা হত। মহান আরব দার্শনিকদের মধ্যে আল্-কিন্দিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন, দর্শনকে গণিতের ওপর নির্ভর করে দাঁড়াতে হবে। ফ্রান্সিস বেকন আর দেকার্ত— আল কিন্দির তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আল্-গাজ্জালিকে বলা হয় ‘Restorer of faith’. মহাদার্শনিক—পণ্ডিত।
জ্যোতির্বিজ্ঞান: সিন্দ ইবন আলি, আল্-আব্বাস, মুসাইবেন শাহির, আল্-বাত্তারি, আবুল হাসান এবং আল্ খোওয়ারাজমি প্রমুখ। খোওয়ারাজমি ‘কিতাব সুরাত আত আরদ’ নামক জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
অঙ্ক: আবু রিহান মোহাম্মদ আল্ বেরুনি, ওমর খৈয়াম। এঁরা দুজনে অঙ্কশাস্ত্রবিদ হলেও যথাক্রমে ঐতিহাসিক ও কবি হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। আবু মুশা জাফরকে আধুনিক রসায়নবিদ্যার জনক বলা হয়ে থাকে। হামবেল্ট বলছেন, আরবরা হলেন পদার্থবিজ্ঞানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
ভূগোল: ইবন খুবদাবেহ, জৈহানি, আল্-মাসুদি, আল্-ইসতাবরি, ইবন হাওকল, ইয়াকুৎ, আল্-বাকারি, আল্-মুকাদ্দাসী এবং ইদরিস। পৃথিবী যে সমতল নয়, গোলাকৃতি তা আরবীয় ভূগোলবিদরা বাগদাদের মানমন্দিরে প্রমাণ করেছেন। আল্-মামুন এ বাবদে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন।
ইতিহাস: বালাদুরি, হালাদান, মাসুদি, তাবারি এবং ইবন-আল-আথির। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, অসাধারণ মনীষী ইবন খলদুন ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের জন্মদাতা। চতুর্দশ শতাব্দীতে সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে অমূল্য অবদান রেখেছেন আফ্রিকার এই মনীষী ইবন খলদুন (১৩৩২-১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ)। সূত্র: সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হজরত মোহাম্মদ (দঃ) তাঁহার শিক্ষা ও অবদান, পৃ. ৩০৮।
সাহিত্য: ইসপাহানি, ইবন খাললিকান, আবু নওয়াজ, আল্-ভূতারি, ফিরদৌসি, আনসারি, জালালউদ্দিন, আবুল ফরজ মোহাম্মদ বিন ইশাক প্রমুখ।
আইনশাস্ত্র: ইমাম-এ-আযম আবু হানিফ, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল। উপরোক্ত বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় অত্যন্ত সঙ্গতকারণেই মন্তব্য করা হয়েছে, ‘The host of literatures and Savants who flourished during the period directed their minds to every branch of human study.’ আল-ওয়াতিকের মৃত্যুর পর বাগদাদ তথা তামাম সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হযে পড়ল। দুর্বল উত্তারাধিকারীদের পরিচালনায় কেন্দ্রীয় আধিপত্য পরাক্রমহীনতায় ভুগতে থাকল। আল্-নাসিব দীর্ঘ ৪৫ বছরের (১১৮০-১২২৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বে সাম্রাজ্যের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে জানপাত কোশেশ করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাঁর পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠল না। আল্-নাসিরের সমসাময়িককালেই পূর্বাঞ্চলে প্যাগান মোঙ্গলরা ভয়ঙ্কর প্রতিপত্তি নিয়ে উদিত হয়। এদের নেতৃত্ব রয়েছিল চেঙ্গিজ খানের উপর। চেঙ্গিজ খান তাঁর যুগের এক ভয়ঙ্কর মানুষ। তাঁর নেতৃত্বে হাজার হাজার অশ্বারোহী দুর্ধর্ষ সৈন্য যেকোনও ধ্বংসাত্মক কাজকে অত্যন্ত সহজ মনে করত। সুউচ্চ ইমারত ও গ্রন্থাগারগুলোকে ভেঙে মাটিতে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তারা হিরাট, বুখারা, সমরখন্দ এবং বালখ শহরকেও বিধ্বস্ত করে ফেলল। অজস্র নরনারীকে হত্যা করল নির্মমভাবে। বন্দি হিসেবে ধরে নিয়ে গেল— আরও অনেককে। এইভাবে ইসলামের মর্যাদার কেন্দ্রটিকে ধ্বস্ত করে দিল। চিন থেকে আড্রিয়াটিক স্পেন পর্যন্ত— এই বিস্তৃত অঞ্চল চেঙ্গিজের নির্মম আক্রমণে ভীত আর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। খলিফা নাসির ও তাঁর দুর্বল বংশধররা মোঙ্গল আক্রমণের বীভৎস দৃশ্য মনে করে শান্তি পেলেন না। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই বর্বর মোঙ্গলরা সামারা আক্রমণের চেষ্টা করে। বাগদাদের নাগরিক নিরাপত্তার জন্য ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু বিপদ কেটে গেল। দুর্বল শাসকরা এই সুবর্ণ সুযোগে তাদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে পারলেন না। এটি যেন দুর্দম ঝড়ের আগে একটুখানি নিঃস্তব্ধতা। ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে হালাকু (চেঙ্গিজ খানের পৌত্র) পুনরায় বিপুল সৈন্য সমভিব্যাহারে ধ্বংস ও হত্যার জন্য মোঙ্গলিয়া ত্যাগ করলেন। খোওয়ারিজম শাহের পতনের পর যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল সেগুলো দখল করে নিলেন হালাকু। এমনবিধ অবস্থায় হালাকু বাগদাদের খলিফা আল্ মুতাসিমকে দাওয়াত জানালেন। জিয়াফত পত্রের কোনও জওয়াব এল না। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকুর কাছে চরমপত্র পাঠালেন। এই পত্রে খলিফাকে আত্মসমর্থন করতে বলা হল। উত্তর স্বাভাবিকভাবেই নঞর্থক এল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু শহরের বহির্প্রাচীর ভেঙে ফেললেন। হালাকুর সৈন্যবর্গ সোৎসাহে শহর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল। হতভাগ্য খলিফা আর আমির-উমরাহ বর্গ আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হল। সেদিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখ ছিল ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি। আত্মসমর্পিত খলিফা আর রাজ কর্মচারীদের দশদিন ধরে হত্যা করা হল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাগদাদ নগরী পুড়ে ছাই হয়ে গেল। চারিদিক শুধু আগুন আর আগুন। বর্বর মোঙ্গলরা ধনী-দরিদ্র, যুবক, শিশু-বৃদ্ধ, স্ত্রীলোক এবং অন্ধ নির্বিশেষে নির্মমভাবে হত্যা করল। মৃতদেহে বাগদাদের পথঘাট রুদ্ধ হয়ে গেল। সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি রক্তে রক্তে সয়লাব হয়ে গেল। ‘For three years the street ran with blood and the water of the Tigris was dyed red for miles along the course’. হালাকু ধ্বংসাত্মক অভিযান শেষ করে মোঙ্গলিয়ায় ফিরে গেলেন। বাগদাদে নেমে এর কবরস্তানের শূন্যতা। সুনসান নিঃস্তব্ধতা।
শেষ কথা: পাঁচশ বছর ধরে বাগদাদ আদম সভ্যতাকে ঋদ্ধ করেছে। হালাকুর এই সামরিক অভিযানের পর বহু অধ্যবসায় ও সাধনার সুফলও ধ্বংস হয়ে গেল। এতে সারা বিশ্ব চিন্তা, বিজ্ঞান ও শিল্প স্থাপত্যের দিক দিয়ে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হল। আব্বাসীয় হুকুমতের গৌরবময় অধ্যায় খতম হয়ে গেল। “ফর দ্য ফার্স্ট টাইম ইন ইটস হিস্ট্রি, দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড ওয়াস লেফট উইদাউট আ ক্যালিফ, হুজ নেম কুড বি সাইটেড ইন দ্য ফ্রাইডে প্রেয়ার্স।” ‘এই প্রথম মুসলমান উম্মাহ খলিফাহীন হয়ে পড়ল, যাঁর নাম কিনা জুম্মার নামাজের সময় উচ্চারিত হত।’ গভীরতম যন্ত্রণা আর বেদনার কথা, বাগদাদ তার অতীত গৌরব আর আন্তর্জাতিক সহরত, শান-শওকত উদ্ধার করতে পারেনি আজও। বাগদাদ আলোর জগৎ থেকে অন্ধকারে পর্দার অন্তরালে চলে গেল। (সূত্র: জর্জ ই. কার্ক, আ শর্ট হিস্ট্রি অব দ্য মিডল ইস্ট, পৃ. ১০-৫৭)।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct