নেতৃত্বের অভাবেই কি বিবিধের মাঝে মিলন-মহানের অবলুপ্তি?
মোঃসাহিদুলইসলাম (গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ,গুজরাট)
____________________________________________
সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে একনায়কতন্ত্র স্থাপন যখন মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন খুব সহজেই আমাদের মনে আসে, পরিবর্তন একমাত্র ধ্রুবক হিসেবে প্রতিধ্বনিত হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে স্বৈরাচারী একনায়কতন্তের বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। সমাজে ন্যায় এর ধারণা যেন পুরো পুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেখানে সমাজ তথা দেশ তার নাগরিকের সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্যে একটি ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া প্রদান করে থাকে কিন্তু কয়েকবছর ধরে নাগরিক তার অধিকার ও ন্যায় এর আশায় বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ মূলক মিছিল ও ধর্নায় বসতে বাধ্য হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, কৃষক আইন, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি নির্মম প্রতিদান , নাগরিক আইন এবং আমাদের এরাজ্যে শিক্ষা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন সহ বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপের বিপক্ষে দেশের ভিন্ন প্রান্তে আজকে আওয়াজ উঠছে যেটি সংকেত দিচ্ছে যে সরকার তার নাগরিক কল্যানে ব্যর্থ। অন্যভাবে দেখলে মনে হয় , কার্ল মার্কস এর ভাষায় নিপীড়িত (সাধারণ নাগরিক ) ও নিপীড়ক (রাষ্ট্র ব্যবস্থা ) দুটি শ্রেণী নতুন ভাবে প্রজ্বলিত হচ্ছে এবং মানব অধিকার যেন কোথাও খর্ব হচ্ছে।
সম্প্রতি ইসলাম ধর্মের প্রবক্তা পয়গম্বর মুহাম্মদ কে (আল্লাহ উনার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন-সাঃ) নিয়ে কটূক্তির জেরে বিশ্ব-ইসলাম সহ ভারতবর্ষে যে ঝড় উঠেছে সেটি যে সাম্প্রদায়িকতার একটি জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডু তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই কটূক্তির অগ্নিকুণ্ডটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় রাজনৈতিক রূপধারণ করে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রতে অভিহিত হচ্ছে।যার ফলে দেশ জুড়ে যে হিংসা সহ প্রতিবাদ মিছিল চলছে তা দেশের অভন্তরীন শান্তি কে ভঙ্গ ও সাধারণ জনজীবন দুর্বিসহ করে তুলছে এবং মানুষের মধ্যে জাতপাতের বিভেদ সৃষ্টি করছে। শুধুমাত্র মুসলমান নয় বরং সমস্ত ধর্মের মানুষের মনে প্রশ্ন হওয়া উচিত যে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষ যেখানে বিবিধ ভাষাভাষীর জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাংবিধানিক নিয়মনীতি মেনে মহান মিলনের মাধ্যমে বসবাস করে থাকে সেখানে এই রকম একটা বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল কিভাবে গড়তে পারে অর্থাৎ নির্দিষ্ট করে ইসলামিক ধর্মের বিশ্বাসকে বিদ্রুপ করা হবে ?
এই বৈচিত্রময় ভারতবর্ষে একদিকে যেমন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্রতা , বৈষমতা ইত্যাদির রেখা গুলো উর্দ্ধগামী, সেই সাথে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র গঠনের রণহুঙ্কার বেজে উঠছে। কিন্তু মনে রাখা খুব প্রয়োজন যে মরীচিকার পিছনে অযথা সময় নষ্ট না করাই শ্রেয়। এ দেশের মাটিতে যুগে যুগে মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে এবং সমকালীন সামাজিক ব্যাধি গুলোকে বধ করা হয়েছে। এ দেশের বুকে শান্তি সহনশীলতা ও ভাতৃত্বের কোনো ত্রুটি নেই। গৌতম বুদ্ধ জ্ঞানার্জনের মধ্যে মোক্ষ শিখিয়েছে , কালজয়ী স্বামী বিবেকান্দ শূদ্র মুচি মেথর আমার ভাই, ডঃ আম্বেদকর জাত-পাত এর বিনাস করা শিখিয়েছে , গান্ধীজি অহিংসা ও সত্যাগ্রহীর দিকদর্শন দিয়েছেন, ক্ষুদিরাম ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র দেশের জন্যে আত্মত্যাগ শিখিয়েছে, সৈয়দ আহমদ খান পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা শিখিয়েছে , কবি সুকান্ত এ দেশের বুকে আঠারো বছরের আহ্বান কি ভাবে করতে হয় ও রবি ঠাকুর আধ মরাদের কি ভাবে ঘা মেরে বাঁচাতে হয় সেই সব গুলো কাঁচাদেরকে শিখিয়েছেন। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে একনায়কতন্ত্র গঠন যে সম্ভব নয় সেটা সহজেই উপলব্ধ করা যায়। ইতিহাসে জার্মান সম্রাট হিটলার এর দৃষ্টান্ত। সুতরাং চতুর্দিকে আজকের পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও বহিস্করণ মনোভাব যেভাবে গড়ে উঠছে, সেক্ষেত্রে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারবো না। এমতবস্থায় , আমাদের সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনার নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন এবং সংকীর্ণ পক্ষপাতীত্ব গভর্নমেন্টালিজম বর্জনের প্রয়োজন। আমাদের গণতান্ত্রিক বৈচিত্রময় দেশ ভারতবর্ষে ,সমাজের একটা স্তর কে অবহেলা করে দেশের সার্বিক উন্নতির রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব নয়। দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল এর ভাষায় যদি আমরা বলি ‘পুরোটা তার অংশের যোগফলের চেয়ে বড়’ অর্থাৎ একটা সমাজের বর্ণ-গোত্র -শ্রেণীর সমষ্টি করণের মাধ্যমেই একটা পূর্ণাঙ্গ সার্বিক সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা তথা দেশ গড়ে তুলতে পারি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct