পৃথিবীর ষষ্ঠ দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ হল কল্লোলীনি কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। বিগত ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা ও হাওড়া শহরকে যুক্ত করে রেখেছে এই ব্রিজটি। এর উপর দিয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক গাড়ি ও মানুষ যায়। তবে এই ব্রিজটি কিন্তু সহজে গড়ে ওঠেনি। প্রথম হাওড়া ব্রিজ পুরোপুরি খুলে ফেলা হয় ১৯৪৫ সালে। দ্য ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া) ক্যালকাটা গেজেড, কলকাতা বন্দর থেকে পাওয়া বিভিন্ন নথিপত্র, তৎকালীন গভর্নরদের বক্তৃতা, বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের রিপোর্ট, বাংলার আইনসভার প্রতিবিধানের কথা এবং তখনকার সংবাদপত্রের বিভিন্ন অংশ থেকে পাওয়া গিয়েছে হাওড়া ব্রিজ তৈরির নানান তথ্য।
১৮৭৪ সালের যে দিন এই সেতুর উদ্বোধন হয়েছিল, ১৮৭০ সালের সেই দিনই কলকাতা বন্দর আইন পাস হয়। দিনটা ১৭ অক্টোবর। ১৮৭০ সালে কলকাতা বন্দরের জন্য আইন তৈরি হয়। তার পরে প্রথম হাওড়া ব্রিজ তৈরি হয় ১৮৭৪ সালে। এই সেতু তৈরি হয়েছিল শুধু বন্দরের জন্য নয়, একই সঙ্গে কলকাতা ও কলকাতাবাসীদের কথা মাথায় রেখেও। ততদিন এই জায়গা পারাপারের জন্য ভরসা ছিল নৌকা-স্টিমার।কলকাতা বন্দর ও দুই সেতুর যোগসূত্র প্রথম স্থাপিত হল একটি পন্টুন ব্রিজের মাধ্যমে। পন্টুন ব্রিজ হল ভাসমান সেতু। এই সেতুর নকশা করেন স্যর ব্র্যাডফোর্ড লেসলি, সেই সময় তিনি রেলের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
আগে জাহাজ যাওয়ার সময় এই সেতুর মাঝের অংশ খুলে ফেলা হত। পরে জুড়ে দেওয়া হত। সেই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছোট্ট একটা জায়গা থাকত, যেখানে সেতু বন্ধ হওয়া ও জোড়ার সময় দেওয়া থাকত। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ চাইতেন যাতে মূলত রাতের দিকেই সেতু খোলা হয়, তাতে দিনের বেলায় লোকে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারেন। চাপ বাড়ার ফলে নতুন একটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা কলকাতা বন্দর প্রথম অনুভব করে ১৯০৫ সালে। চেয়ারম্যান চিঠিও দেন সরকারকে। ১৯২৬ সালে হাওড়া ব্রিজ আইন তৈরি হয়। ১৯৩৪-৩৫ সালে যখন কাজ শুরু হবে, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা প্রায় বাজতে চলেছে। এদিকে প্রচুর ইস্পাত দরকার। এত বড় সেতু এই প্রথম সৃষ্টি হল দেশজ ইস্পাত দিয়ে। তখন টাটা আয়রণ অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি এই ব্রিজের জন্য একটি বিশেষ ধরনের ইস্পাত তৈরি করলেন। টিসক্রম নামে এই ধাতুসংকর তৈরি হল শুধুমাত্র এই সেতুর জন্য। প্রিস্ট্রেসড বা লাগানোর পরে বেঁকে যাবে না এমন প্রায় ২৩.৫ হাজার টন ইস্পাত তৈরি হল হাওড়া ব্রিজের জন্য। মোট ২৬ হাজার টন ইস্পাত লেগেছিল। হাওড়া ব্রিজে কটা নাট-বল্টু আছে? উত্তর, একটাও নেই। এই ধারনা একেবারেই ঠিক নয়। নাটবল্টু আছে, তবে খুব কম। তৈরির সময় এটি ছিল বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সাসপেনশনটাইপ ব্যালান্সড ব্রিজ, কানাডা ও স্কটল্যান্ডের পরে।
প্রথম হাওড়া ব্রিজটি উদ্বোধনের আগেই শহরে আছড়ে পড়ে সাইক্লোন, ১৮৭৪ সালের ২০ মার্চ। তাতে শহর তছনছ হয়ে যায় ক্ষতি হয় নির্মীয়মাণ সেতুরও। তারও পরে ইজেরিয়া নামে একটি জাহাজ এই সেতুতে ধাক্কা মারে। তখন গঙ্গায় যেমন জোয়ার-ভাটা খেলত ব্যাপক ভাবে, তেমননি উল্টো দিকে জাহাজও অত উন্নত ছিল না। তারই ফলে এই ধাক্কা। যখন এই সেতু তৈরি হচ্ছে তখন তার প্লিন্থের একটা বড় অংশ পড়ে যায়। তার ফলে আশপাশে ভূকম্পনও অনুভূত হয়। কলকাতা শহরের ভূকম্পন মাপরার যন্ত্রেও সেটি ধরা পড়ে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে কলকাতায় একের পর এক বোমা পড়েছে। কিন্তু জাপানিরা তো এই সেতুতে বোমা ফেলেনি! কিছুদিন আগেও একটি জাহাজ হাওড়া ব্রিজে ধাক্কা মেরেছিল তার নাম ছিন এমভি মণি, তাতেও সেতুর ক্ষতি হয়েছিল। বহু ঝড়ঝাপটা সহ্য করেই এখনও টিঁকে রয়েছে হাওড়া ব্রিজ। চার-পাঁচ বছর অন্তর এই সেতু রং হয় সিসা-বিহীন রং দিয়ে। সে জন্য ২৬,০০০ লিটার রং প্রয়োজন হয়, সময় লাগে সাড়ে সাত মাস। ২০১৪ সালে শেষ বার রং করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে এই সেতু প্রথম আলোকিত করা হয় চেয়ারম্যান অনুপ চন্দের উদ্যোগে।এখন সব মিলিয়ে বছরে আন্দাজ ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা মতো খরচ হয় এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। ১৯৬৫ সালে এই সেতুর নাম হয় রবীন্দ্র সেতু।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct