শিক্ষামূলক ভ্রমণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান (সুন্দরবন)
সজল মজুমদার
শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জীব বৈচিত্রের আধার বা আঁতুড়ঘর হল সুন্দরবন। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকার কে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরবন মানেই অগণিত গাছ পালা, হরেক রকম কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, পশুপাখি, ও সরীসৃপ সমৃদ্ধ এক অজানা জঙ্গলমহল। সুন্দরবন মানেই নোনা জল, কাদা মাটিতে ঘন হয়ে থাকা হেতাল, সুন্দরী, কেওড়া,গর্জন,বাইন, গরান, প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ গাছ, নানান ছোট বড় নদী, খারি, চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বদ্বীপের সমারোহ। ৫৬ টি ব দ্বীপ রয়েছে এই অসাধারণ বনাঞ্চলে। ৪২৬৪ বর্গ কিমি জুড়ে এর বিস্তার। এর মধ্যে ২৫৮৫ বর্গ কিমি সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ। বাঘ এই অরণ্যের রাজা হল ভয়ঙ্কর তীব্র গতির লবণাক্ত কুমির, শুশুক, কাঁকড়া, চিতল হরিণ, রিসার্স বাঁদর, বুনো শুয়োর, মেছো বিড়াল, বেজী,ভোঁদড়, ও নানা রকমের বিষধর সাপ এখানে দেখা যায়। অন্যদিকে পাখি প্রেমীদের কাছে স্বর্গ এই সুন্দরবন। মূলত অক্টোবর থেকে মার্চ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরণ্য ভ্রমণের আদর্শ সময় হলেও জুন থেকে সেপ্টেম্বরের সময়ে নানান বৈচিত্র্যময় পাখির আগমন ঘটে এখানে। পানকৌড়ি, কাস্তে চোরা, শকুন, শামুকখোল, বিভিন্ন ধরনের সারস, মাছরাঙ্গা, বক, টিয়া, সামুদ্রিক ঈগল, বালি হাঁস, গাংশালিক, বুলবুল, শঙ্খচিল প্রকৃতি পাখির হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কলতান পর্যটকদের আকর্ষণ করবেই। এখানকার সজনে খালিতে রয়েছে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। জীব বৈচিত্রের এসব অপার সৌন্দর্য একেবারে কাছে থেকে উপভোগ করবার জন্য এখানে নানা স্থানে তৈরি করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক ভ্রমণ বা excursion এর ক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে সুন্দরবন একটি আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে। মূলত ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সৌন্দর্য এবং সুন্দরবনকেন্দ্রিক স্থানীয় মানুষজনের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রা সমীক্ষা করবার ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের এই স্থানে শিক্ষামূলক ভ্রমণ বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে। বাঘের আতঙ্ক ও আক্রমণের অভিজ্ঞতার কাহিনী এবং পরিসংখ্যান স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে একেবারে সামনাসামনি কথা বলে সেগুলো প্রজেক্ট এর মাধ্যমে পরবর্তীকালে তারা তুলে ধরতেই পারে। অন্যদিকে আইলা, ফনি,আম্পান, ইয়াসের তুমুল তান্ডব লীলার ফলে সুন্দরবনের সাম্প্রতিক অবস্থাও লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। মানুষের অবিবেচক পূর্ণ, নৈতিকতাহীন, কাজ কর্মের ফলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ কিভাবে ধ্বংস হচ্ছে তা সম্পর্কেও সামগ্রিক একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য কিছু মানুষের ও সমাজসেবী সংস্থার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথাও না বললেই নয়। ম্যানগ্রোভ এর চারা রোপন, পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষনের কাজে নিযুক্ত স্থানীয় মানুষদের নিরলস পরিশ্রম পর্যটক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কাছে একটা শিক্ষনীয় বিষয় হিসেবেও দেখা যেতেই পারে। উদাহরণস্বরূপ,পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি নামক সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাটি এখানে দীর্ঘ সময় ধরে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের মহান কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হয়ে রয়েছে। তাই শুধু সুন্দরবন ভ্রমণ নিজের ভালোলাগা র জন্য সময় অতিবাহিত করবার স্থান হিসেবে নয়, নোনা জল, জঙ্গল, এবং জীবনে প্রতিমুহূর্তে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা প্রান্তিক মানুষ গুলোর করুন অবস্থা কাছে থেকে উপলব্ধি করা, ক্ষেত্র সমীক্ষা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেগুলো নথিবদ্ধ করে সঠিক জায়গায় উপস্থাপিত করবার উদ্দেশ্য হিসেবে সুন্দরবন ভ্রমণ করা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।এই প্রসঙ্গে নদী বিশেষজ্ঞ এবং বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড: মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন “ সুন্দরবন হলো প্রকৃতিগত, সামাজিক ও ইতিহাসগত দিক থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণের একটি আদর্শ জায়গা। এখানে প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র, সমস্ত জায়গায় যেমন লুকিয়ে আছে, তথাপি সামাজিক দিক থেকে এখানে একটি করুন অবস্থাও বিরাজ করছে। এখানে সমুদ্রের অবিরত জোয়ার ভাটার সাথে প্রকৃতি কিভাবে অভিযোজিত হয়েছে তা লক্ষ্য করা যায়, এখানে ছোট ছোট জলধারা,ক্রিক, ক্রিসক্রস চ্যানেল রয়েছে যেগুলো খুব সহজে সমীক্ষা করা যেতে পারে। সুতরাং সুন্দর বনে শিক্ষামূলক ভ্রমণ পড়ুয়াদের যেমন চোখ নতুনভাবে উন্মোচিত করবে, তেমনি এখানকার সামগ্রিক সমস্যাকে কোন ভাবে আগামীতে দেখা উচিত সেই ধারণাও তাদের সুস্পষ্ট হতে পারে”। অন্যদিকে সমাজ ও বাস্তু তন্ত্র বিদ্ উমাশঙ্কর মন্ডলের ভাষায় “সুন্দরবন হলো পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রে ভরপুর একটি স্থান, এক কথায় একে জীবন্ত গবেষণাগারও বলা যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা তাদের পাঠ্যক্রমে প্রত্যেকটি বিষয়ের খুঁটিনাটি শিক্ষামূলক ভ্রমণ তথা পর্যটনের মাধ্যমে এখানে এসে জানতে পারে। পাশাপাশি সম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখানে তার কিরকম কুপ্রভাব পড়ছে তা পড়ুয়ারা এখানে এসে সামনাসামনি অনুধাবন করতে পারবে। পড়ুয়াদের মধ্যে ম্যানগ্রোভ প্ল্যান্টেশনের গুরুত্বের একটি বার্তা দেওয়া যেতে পারে ভ্রমণের মাধ্যমে। তাই পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পড়ুয়াদের সুন্দরবনে আসা ভীষন জরুরী”।তাই বলা যায় এক্ষেত্রে পর্যটকদের থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের শিক্ষামূলক ভ্রমণের গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই অনেকটাই বেশি। অন্যদিকে সুন্দরবনের সংস্কৃতি, হস্তশিল্প, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, এখানকার মহিলাদের অবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশু-কিশোরদের শিক্ষার চাল চিত্র, মৎস্য শিকারের পদ্ধতি, শিক্ষামূলক পর্যটন, একটিং পর্যটন বা ট্যুরিজম,NGO ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থান প্রভৃতি নানান বিষয় গুলোর সঠিক তথ্য পড়ুয়াদের শিক্ষামূলক ভ্রমণের সমীক্ষার মাধ্যমে উঠে আসতেই পারে।তাই আসুন ,সকলে মিলে আমরা বাদাবন রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct