সজল মজুমদার
শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
_____________________
বর্তমান পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মনুষ্য ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও চরম ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবনযাত্রার প্রতি মুহূর্তে আমরা প্লাস্টিক নির্মিত বিভিন্ন দ্রব্যাদি ব্যবহারে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু যেহেতু প্লাস্টিক অপচনশীল বস্তু তাই এগুলো মৃত্তিকার সাথে সরাসরি বিছানায় গিয়ে উল্টে মৃত্তিকার চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। প্লাস্টিক বিভিন্ন ক্ষতিকর দুষক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। তাই যখন প্লাস্টিক নির্মিত বিভিন্ন বস্তু সমূহ সামগ্রিকভাবে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের পরিবেশে ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটায় তখন এই ধরনের দূষণ কে প্লাস্টিক দূষণ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য সারা বিশ্বে 300 মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিবছর উৎপাদিত হয়ে থাকে। বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের মতে 1950 সালের পর থেকেই বিশ্বে 8.3 বিলিয়ান টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু হয়েছিল, অবশ্য এই মোট উৎপাদিত প্লাস্টিকের 60% প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরাট করন(Landfill) করা হয়েছিল, যার ফলে ততটা পরিবেশ দূষণ সে সময় হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যাবে শতকরা 100 ভাগের মধ্যে 9 ভাগ প্লাস্টিক কেবলমাত্র পুনর্ব্যবহারযোগ্য। 12% প্লাস্টিক কে পোড়ানো হয়ে থাকে, আর বাকি 79 ভাগ প্লাস্টিক কে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরাট করন এর মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে প্লাস্টিক নির্মিত সবথেকে চেনা বস্তুগুলো হলো জলের বোতল, বিভিন্ন প্লাস্টিক নির্মিত বোতলের ছোট-বড় ঢাকনা, প্লাস্টিকের মোড়ক, প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ প্রভৃতি। বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্লাস্টিক সর্বদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন শুধু নয়, নদ-নদী, পুকুর দীঘি তে ও অসংখ্য প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের দ্বারাই সর্বদা নিক্ষেপিত হয়ে আসছে। সমুদ্র দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিভিন্ন নদ নদী। কারণ এই নদ নদী গুলোর মাধ্যমে ই প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক পরিবাহিত হয়ে মোহনায় সমুদ্রের সাথে মিলনস্থলে এসে সরাসরি সমুদ্রে মেশে। যার ফলে সমুদ্রের জলজ বাস্তুতন্ত্র অনেক সময় বিপন্নতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ যদি এই ভাবেই বাড়তে থাকে তাহলে নাকি 2050 সাল নাগাদ মহাসাগরে সামুদ্রিক মৎস্য এর তুলনায় প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বাড়বে। তবে শুধু বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, প্রতিটি মানুষ বসবাসের স্থানীয় এলাকাতেও প্লাস্টিক দূষণ প্রতিনিয়তহয়ে চলেছে। শহরের নিকাশি নালার দূষিত জলের সাথে প্রচুর প্লাস্টিক বস্তু সামগ্রী থাকে, সেগুলো সরাসরি নদীর বিশুদ্ধ জলের সাথে মিশে জলকে কলুষিত করে তুলছে। অন্যদিকে বিভিন্ন শহর এবং মফস্বল অঞ্চলে প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ নিষিদ্ধকরনের ব্যাপারে আরও জোরদার সচেতনতামূলক অভিযান চালানোর প্রয়োজন। শীতকালে পিকনিকের মরশুমে বিভিন্ন ফরেস্ট গুলিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ, থার্মোকলের পাতা, গ্লাস ,বাটি ইত্যাদি। এককথায় আমরাই সজ্ঞানে জেনে বুঝে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি, আবার আমরাই সেসব বস্তু সামগ্রী ব্যবহার করার পরে তার প্রয়োজনীয়তা মিটে গেলে পরিবেশে নিক্ষেপ করছি। ভূগর্ভস্থ জল দূষণ (Groundwater pollution) ঘটানোর ক্ষেত্রেও প্লাস্টিকের পরোক্ষে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ভূমি দূষণ ঘটনা ক্ষেত্রেও এটি প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং সরকার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন ধরনের দূষণ থেকে শহরগুলিকে মুক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্লাস্টিক দূষণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে zero plastic waste campaign উল্লেখযোগ্য। মূলত পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উদ্যোগে প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারমূলক কার্যক্রমে বিভিন্ন এনজিও এবং বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নির্মল বিদ্যালয় এবং স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অংশহিসেবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ গুলিতেও প্লাস্টিক মুক্ত করবার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের অধীন উন্নত ভারত অভিযান প্রকল্পে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা প্রায় 11000 গ্রামীণ এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্লাস্টিক বন্ধ করবার জন্য একটি সহনশীল সমাধান(sustainable solutions) করবার লক্ষ্যে অনেকটা এগিয়েছে। তবে যাই হোক, প্লাস্টিকের পুরোপুরি ব্যবহার বন্ধ করতে আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে, প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব বস্তু সামগ্রী ব্যবহারে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে।আমরাই পারবো এই পৃথিবী কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নির্মল ও সুস্থ বানাতে।আর সেটা শুরু এখন থেকেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct