অধ্যাপক মনোজ মাইতি
বাজকুল মিলনী মহাবিদ্যালয়
পূর্ব মেদিনীপুর
_________________________
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের যোগ্যতমের উদবর্তন সূত্র থেকে পরিষ্কার হয়েছে পরিবেশে কোন প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য সর্বদা লড়াই করতে হয়, এই লড়াইয়ে জয়ী প্রাণীরাই বেঁচে থাকে বা বেঁচে থাকার সুযোগ পায় এবং বাকিরা মারা যায়। এই লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ আমাদের মস্তিস্ক বা স্নায়ুতন্ত্র নির্ভরশীল। স্নায়ুতন্ত্র পরিবেশ থেকে উদ্দীপনা বা ক্রিয়া পেয়ে থাকে যার সাহায্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা প্রাণীটিকে বাঁচতে সাহায্য করে। আমাদের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যকারিতা গুলি সবই স্নায়ুতন্ত্র নির্ভরশীল। আমাদের খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছা বা খিদে পাওয়া না পাওয়া পাকস্থলী থেকে এইচ সি এল বা হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণ ক্ষুদ্রান্ত থেকে পালনকারী রস ক্ষরণ চোখের তারা রন্ধ্রের সংকোচন হওয়া প্রসারিত হওয়া মূত্রথলির সংকোচন হওয়া প্রসারিত হওয়া গরম এবং ঠাণ্ডা পরিবেশে আমাদের স্বাভাবিক তাপমাত্রা দেহের নিয়ন্ত্রিত হওয়া, ঠান্ডা গরম অনুভুতি দর্শন কোন শব্দ শুনতে পারা ঘ্রাণ বা গন্ধের অনুভূতি কেউ স্পর্শ করলে বুঝতে পারা চলাফেরা করার সময় পায়ের পেশী সংকোচন প্রসারণ কোন বিষয়বস্তু মনে রাখা ইত্যাদি প্রতিটি শারীরবৃত্তীয় কাজ স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এই নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধান উপাদান হচ্ছে উদ্দীপনা যা পরিবেশ থেকে প্রাণীরা পেয়ে থাকে এর প্রভাবে মস্তিষ্ক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা আজ্ঞাবাহী স্নায়ু দ্বারা পরিবাহিত হয়।
জীবদেহের গঠনগত ও কার্যগত একক হল কোশ। অনেকগুলি কোষ একত্র ভাবে অবস্থান করে কলা গঠন করে। কলার দ্বারা গঠিত হয় অঙ্গ এবং অঙ্গ দ্বারা গঠিত হয় সিস্টেম তন্ত্র। মানবদেহে অনেকগুলি সিস্টেম বা তন্ত্র রয়েছে, এরা ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ তন্ত্র গুলি হল পরিপাকতন্ত্র এর দ্বারা আমাদের গৃহীত খাদ্যবস্তু পরিপাক হয় এবং এদের প্রয়োজনীয় উপাদান গুলি রক্তে প্রবেশ করে যেমন কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য থেকে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ গ্যালাকটোজ উৎপন্ন হয় এবং রক্তে প্রবেশ করে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য থেকে অ্যামাইনো এসিড তৈরি হয় এবং রক্তে প্রবেশ করে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য থেকে ফসফোলিপিড কোলেস্টেরল ইত্যাদি তৈরী হয় এবং রক্তে প্রবেশ করে। রক্তে প্রবিষ্ট উপাদানগুলি কোষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে যায় এবং এই বিপাক প্রক্রিয়ার জন্য দরকার হয় অক্সিজেন অক্সিজেন রেসপিরেটরি সিস্টেম বা শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বিপাক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড যা শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমিক দেহ থেকে নির্গত হয়। বিপাক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন রেচন পদার্থ নির্দিষ্ট রেচন অঙ্গ রক্ত বাহির মাধ্যমে বখ রক্ত সংবহন এর মাধ্যমে কিডনীতে পৌঁছায় এবং মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত হয়। মানবদেহের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তন্ত্র হলো অনাক্রম্যতন্ত্র এই তন্ত্রের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ জাতীয় পদার্থ বা জীবাণু বা ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যায়, দেহে রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গঠন করে। অন্তঃক্ষরা তন্ত্র বিভিন্ন হরমোন ক্ষরণে সাহায্য করে হরমোন বিপাক নিয়ন্ত্রণ এর পাশাপাশি দেহের বৃদ্ধি এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে মানবদেহের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হলো জনন তন্ত্র এর মাধ্যমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন জাইগোট গঠন এবং নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানব দেহ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তন্ত্র নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়তন্ত্র এর প্রধান উপাদান হলো ব্রেইন বা মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ড এই তন্ত্রটি দেহের যাবতীয় কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্য তন্ত্র গুলির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে।
আমাদের খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছা বা অনুভূতি বা খাদ্য খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়ার অথবা পাকস্থলী ভর্তি হয়ে যাওয়ার খবর মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস দ্বারা তৈরি হয় ও নিয়ন্ত্রিত হয়। হাইপোথ্যালামাসের মধ্যেই রয়েছে পাকস্থলী থেকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। পিটুইটারি গ্রন্থি বা মাস্টার গ্রন্থি থেকে ট্রপিক হরমোন যেমন থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন, গোনাডোট্রপিক হরমোন, সোমাটোট্রফিক হরমোন বা গ্রোথ হরমোন ক্ষরণের কেন্দ্র। আমাদের দেহে জলের পরিমাণ হ্রাস পেলে প্লাজমার পরিমাণ বা রক্তের পরিমাণ কমতে থাকে এবং এর প্রভাবে রক্তচাপও হ্রাস পায় তখন আমাদের তৃষ্ণা অনুভূতি তৈরি হয় হাইপোথ্যালামাসের দ্বারা। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হল গুরু মস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান এর দুটি হেমিস্ফিয়ার বা খন্ডে বিভক্ত৷ এই স্থানটিতে পাঁচটি খন্ড রয়েছে। যথা ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল, টেম্পোরাল, অক্সিপিটাল এবং লিম্বিক৷ প্রতিটি খন্ড গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে বা নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। প্যারাইটাল লোব এবং অক্সিপিটাল লোব যথাক্রমে সাধারণ সংবেদন যেমন তাপ, চাপ, স্পর্শ ইত্যাদির অনুভূতি এবং বিশেষ সংবেদন কেন্দ্র যথা দর্শন, শ্রাবণের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। হাইপোথ্যালামাস ও লিম্বিক লোভ বা খন্ড যৌথভাবে ইমোশনাল বিহেভিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যার মাধ্যমে আমাদের আবেগ, উত্তেজনা, হাসি, কান্না ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স এর মধ্যে ফ্রন্টাল লোব এর 9 থেকে 14 তম স্থান মনের কেন্দ্র মাস্টার-মাইন্ড হিসাবে পরিগণিত৷ এই স্থান আমাদের জাজমেন্ট, বিভিন্ন সমস্যার বিশ্লেষণ, স্মৃতিশক্তি এর কেন্দ্র। এই স্থানের উন্নতির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুটিত হয়৷ যাদের এই স্থানটি উন্নত হয়েছে বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধান করতে পারে অন্যদিকে নতুন বিষয়বস্তু চিন্তাভাবনা করতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানুষের প্রতিটি কাজ যথা দর্শন, শ্রাবণের অনুভূতি বিশ্লেষণ ক্ষমতা, পেশির সংকোচন-প্রসারণ, তৃষ্ণা অনুভূতি, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, যদিও বাহ্যিক পরিবেশ বসবাসকারী মানুষজন, পরিবারের অন্যান্য মানুষজনের ব্যবহার দ্বারা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা প্রভাবিত হতে পারে।
বিভিন্ন উদ্দীপনা পরিবেশ থেকে গ্রহণের জন্য রিসেপ্টর বা গ্রাহক আমাদের দেশে অবস্থিত, গ্রাহকগুলি উদ্দীপিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট তীব্রতার উদ্দীপনার দরকার হয়। গ্রাহকগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকে সংজ্ঞাবাহি স্নায়ু বা অন্তর্বাহী স্নায়ু বা এফারেন্ট নিউরন এর মাধ্যমে গ্রাহকের মধ্যে উৎপন্ন অ্যাকশন পটেনশিয়াল বা ক্রিয়া বিভব মস্তিষ্কে পরিবাহিত হয়।মস্তিস্ক রেস্পন্স উৎপন্ন করে যা বহির্বাহী স্নায়ুর বা মোটর নিউরন বা চেষ্টীয় স্নায়ু মাধ্যমে কারকে যথা পেশি বা গ্রন্থিতে পরিবাহিত হয়। গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন হরমোন বা অন্য পদার্থ ক্ষরণ হতে পারে অথবা পেশির সংকোচন ঘটে যার ফলে আমরা চলাফেরা বা নড়াচড়া করতে, তারান্ধ্য সংকোচন, মূত্রথলির সংকোচন বা মূত্রত্যাগ, পিত্ত ক্ষরণ, কোন শব্দ শুনতে পাওয়া, কোন বস্তুকে দর্শন, কোন বস্তুর গন্ধ অনুভব করা, পায়ে কাঁটা ফুটলে পায়ের পেশি সংকোচন হওয়া পায়ের সেই জায়গা থেকে সরে সরিয়ে আনি ইত্যাদি প্রতিটি কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় এর ফলে পরিবেশে প্রাণীটি বা আমরা শত্রুদের হাত থেকে বাঁচা, অন্যদিকে খাদ্য সংগ্রহ, বাসস্থান তৈরি এবং প্রজনন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারি৷ মায়ের দুগ্ধ ক্ষরণের জন্য দরকার সন্তানের দ্বারা সাকিং রিফ্লেক্স, যার অনুভূতি মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি তে পৌঁছানোর দ্বারা সম্ভব অর্থাৎ সৃষ্টিশীল চিন্তা ভাবনা শুধু নয় মানবজীবন সৃষ্টি থেকে শুরু করে মৃত্যুকাল পর্যন্ত স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে যেমন অন্যান্য তন্ত্র গুলি বেঁচে থাকার জন্য সাপোটিং বা সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct