আব্দুল মাতিন
গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
_________________________
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। এই পৃথিবীতে যত বড় বড় অভিযান সংঘটিত হয়েছে, সব সময়ই পুরুষের পাশাপাশি নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। পুরুষের তরবারি কখনোই একা হয়নি। সব সময় নারী পুরুষকে যুগিয়েছে শক্তি, দিয়েছে প্রেরণা। কিন্তু পুরুষের কথা যতটা লেখা হয়েছে, নারীর কথা ততটা লেখা হয়নি। আমাদের ভাষা আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রীরা। ভাষা আন্দোলনের মিছিলগুলোতে তাঁরা ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে নারীরাই পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ব্যারিকেড ভেঙেছিলেন। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আহতদের চিকিৎসা করেছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসার জন্য ছাত্রীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছিলেন। আবার অনেকে নিজের অলংকার খুলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য অনেককে জেল খাটতে হয়েছে। অনেকে বহিষ্কার হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এভাবে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সংগ্রাম করে রক্ষা করেছেন আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগান এবং এই আন্দোলনে বাংলার নারীরা যে পুরুষের সহযোদ্ধা হয়ে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছেন- এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মহান ভাষা আন্দোলনে নারীর উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও ভাষাসৈনিকদের তালিকায় নারীর অবদান সেভাবে উঠে আসেনি ইতিহাসের পাতায়! যার জন্য ভাষাসৈনিক নারীদের অবদান বাংলার সিংহভাগ মানুষের কাছে অজানা। বিষয়টা দুঃখজনক এবং হতাশারও বটে। অথচ মায়ের মুখের ভাষা রক্ষা করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও রয়েছে অসামান্য অবদান। বাংলার সর্বস্তরের জনগণের কাছে যে ইতিহাস জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখের সামনে; সেদিনের পুলিশ আর্মিদের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফির, শফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা অসংখ্য ভাষাসৈনিক। কিন্তু সেইদিন পাকিস্তানি আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নল উপেক্ষা করে ভাষার দাবি নিয়ে রাজপথে নামা মিছিলগুলোতে নারীরা ছিলো সামনের সারিতে! সেদিন নারীরাই সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস দেখান। তৎকালীন দৈনিক আজাদসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদে ভাষাসৈনিক নারীদের স্মৃতিচারণ এবং দলিল দস্তাবেজে ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার চিত্র ভেসে ওঠে। নারীদের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলে। ধাপে ধাপে মিছিল মিটিং এবং সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে অসংখ্য নারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পুলিশের টিয়ারসেল, লাঠিচার্জ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মুখোমুখি হন ভাষাসৈনিক অসংখ্য নারী। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন।
৫০-এর দশকে বাংলার নারীরা ছিলো অনেকটা শৃঙ্খলিত, তবুও তারা রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার দাবিতে গৃহ ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন সমান তালে। রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনে সংগ্রামে সভা-সমাবেশে সমান তালে সোচ্চার ছিলেন বাংলার ভাষাকন্যারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতের অন্ধকারে ভাষার দাবি নিয়ে মিছিলে যাওয়ার প্রস্তুতিপূর্ব বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত পোস্টার তৈরি করতো, আর দিনের আলো ফুটলেই সেসব পোস্টার নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে ভাষার দাবি সম্বলিত স্লোগান ধরতো, নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিল নিয়ে বের হতো। পাকিস্তানী মিলিটারিরা ছাত্রীদের গ্রেপ্তার করে, গাড়ি করে কুর্মিটোলায় নিয়ে যায়।
মাতৃভাষা বাংলার দাবি ওঠে সর্বপ্রথম ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেই। এবং নারীরা শুরু থেকেই এই আন্দোলনে ছিলেন সোচ্চার। ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার অনুরোধ সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আর সেই স্মারকলিপিতে বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে স্বাক্ষর করেছিলেন ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার সম্পাদিকা লীলা রায় এবং মিসেস আনোয়ার চৌধুরী। সিলেট জেলার নারীদের পক্ষ থেকে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব নিশতারের কাছে সিলেটের রাজকীয় বালিকা বিদ্যালয়ে ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এতে স্বাক্ষর করেছিলেন বহু মহিলা বগুড়ার কবি আতাউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম কমিটি। এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন রহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সকল দাবি নাকচ করে দিলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ১১ মার্চ ডাকা হলো সাধারণ ধর্মঘট। আর এখানেও সম্পৃক্ত ছিলেন জাগ্রত নারীসমাজ। যাদের মধ্যে অন্যতম নিবেদিতা নাগ, নাদেরা বেগম, লিলির খান, লায়লা সামাদ প্রমুখ। আর সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ুয়া ছাত্রী নাদেরা বেগম। বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্রী রওশন আরা বাচ্চু এসময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ধর্মঘট, সভা ও মিছিল করেন। ওইসময়ে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বাইরে বের হওয়া নিষেধ থাকলেও তিনি রাজপথে অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে নেতৃত্বে ছিলেন। যশোরে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ওইদিন হরতাল ডাকা হলে যশোরের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বি.এ পড়ুয়া ছাত্রী হামিদা রহমান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা নাগাদ হাজারো ছাত্রছাত্রীর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-স্লোগানে মুখরিত চারদিক। এ সময়ে তিনবছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করে মুক্তি পেয়েই ভাষা আন্দোলনে আবারো সক্রিয় হলেন নাদেরা বেগম। নারায়ণগঞ্জের বিক্ষোভ সভায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মর্গান বালিকা স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম। অবশেষে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলে ক্ষিপ্ত জনতা কোর্ট হাউস ঘেরাও করে। অতঃপর তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ জনতা সংঘর্ষে আহত হয় অনেকে এবং শেষ পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে ডাকতে বাধ্য হন প্রশাসন। একপর্যায়ে অন্যান্যদের সাথে গ্রেপ্তার হন ইলা বখসী ও ছাত্রী রেণু। পরবর্তী সময়ে মমতাজ বেগমকে মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নে সরকারপক্ষ এক স্বীকারোক্তিতে সই করার প্রস্তাব দিলে; তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরমধ্যে স্বামী কর্তৃক তিনি তালাকপ্রাপ্ত হন এবং এভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনে তিনি হারালেন স্বামীরসংসার। আন্দোলনের একপর্যায়ে মর্গান স্কুলেরই ছাত্রী মতিয়া চৌধুরী নিজের আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ ব্যানার লিখেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ভাষা আন্দোলনে এই যে নারীদের অপূরণীয় ত্যাগের কথা; তা কতটুকু লেখা হয়েছে? ময়মনসিংহে ড. হালিমা খাতুন ও অন্যান্যরা, খুলনায় সাজেদা আলীর নেতৃত্বে মেয়েরা মিছিল করে। রংপুর আবতাবুন খাতুনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের আয়োজনের কারণে গ্রেপ্তার করা হয় তার মেয়ে নিলুফার আহমেদকে। এর পরেও তিনি থেমে থাকেননি। ঢাকায় ছাত্র মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণে ছাত্র হত্যার খবর পেয়ে বিকাল তিনটায় আবারো রাজপথে নেমে আসে ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিভা মুৎসুদ্দী ও তালেয়া রহমান মিছিল নিয়ে আসেন ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে, ওখান থেকে গাড়িতে চড়ে “মন্ত্রিসভার পদত্যাগ চাই”, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”-এসব শ্লোগানে সারা শহর প্রদক্ষিণে নেতৃত্বে ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী হালিমা খাতুন-জওশন আরা রহমানসহ আরো অনেকে। ভাষা আন্দোলনে নারী সমাজের অবদানে দেখি একদিকে সক্রিয়ভাবে মিছিল প্রতিবাদ সভা ও অন্যদিকে সাংগঠনিক কাজ ছাড়াও তারা তহবিল গঠন, চাঁদা সংগ্রহ এবং পোস্টার তৈরি করে বিক্রি করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলনের ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘১১ মার্চ ভোর বেলা থেকে শতশত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করলো। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হলো। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। আনোয়ারা খাতুনসহ অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে (অধিবেশনে) ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘যে কয়দিন আমরা কারাগারে ছিলাম; সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে শ্লোগান দিতে শুরু করতো। আর ৪টায় শেষ করত। ছোট্ট-ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’-এমন নানা ধরনের শ্লোগান। এরপর জিন্নাহর ঘোষণা-পরবর্তী সব কর্মসূচিতে নারীরা সরব ছিলেন। পরে বায়ান্নর ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক জিন্নাহর ঘোষণা পুনরাবৃত্তি হলে মহান একুশের মূলক্ষেত্র তৈরিতে ছাত্রীরা সাহসী ভূমিকা রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন চাঙ্গা করতে অর্থসংগ্রহ ও রাতভর পোস্টার লেখার কাজ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরো কয়েকজন ছাত্রীর দ্বারাই হয়। কারণ দশজন করে বের হওয়া প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা ব্যারিকেডের ওপর ও নিচ দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। পরে তৃতীয় দলে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানির কাজ শুরু করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। এরমধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বক্তৃতা করেছেন গণজমায়েতে। নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলে। সহ্য করেছেন পুলিশি নির্যাতনের সকল প্রক্রিয়া- কারাবরণ, হুলিয়া ভোগ, সাময়িক আত্মগোপনকারীদের আশ্রয় দিয়ে একথাও প্রকাশ করেছেন। অথচ ইতিহাসে নারীদের উপস্থিতির কথা বলা এবং ভাষাসৈনিক নারীদের পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়নি। সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নারীদের রচনাবলি, বিশ শতকের শেষাবধি। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় অগণিত ভাষাসৈনিক একুশে পদক পেলেও, ভাষাকন্যারা আজও অবহেলিত রয়ে গেছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct